পশ্চিমাদের ভণ্ডামি তুলে ধরতে চাইছে চীন

চীনের শিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলিমদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর মতে, ১০ লাখের অধিক উইঘুর মুসলিমকে জিনজিয়াং প্রদেশের পুনর্বাসন কেন্দ্রে রাখার নামে বন্দি রেখেছে চীন সরকার। তাদের ওপর নিয়মিত নিপীড়ন চালানো হয় বলে একাধিক অভিযোগ রয়েছে।

এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ এই ইস্যুতে চীনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি দেশ রয়েছে। মার্কিন প্রশাসন নতুন করে চীনের আরো কিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে গণমাধ্যম বলছে।

গত এপ্রিলে চীনের জিনজিয়াংয়ে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের ওপর নিপীড়নকে প্রথমবারের মতো গণহত্যা হিসেবে ঘোষণা দেয় ব্রিটেন। সেই সঙ্গে এর নিন্দা জানিয়ে পার্লামেন্টে একটি বিলও পাশ করে দেশটির আইনপ্রণেতারা। তার আগে নেদারল্যান্ডস, কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্র একই রকম বিল পাশ করে। তবে চীন বরাবরই উইঘুরদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। চীন সরকার তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ অস্বীকার করে একে পশ্চিমা ষড়যন্ত্র বলে উড়িয়ে দিয়েছে। চীনের ভাষায় পশ্চিমারা উইঘুর ইস্যুতে ভুল করছে। তাদের উচিত নিজেদের এই ভুল সংশোধন করা।

উইঘুর ইস্যুতে পশ্চিমাদের ক্রমাগত চাপের মুখে চীন তাদের নীতি ও কৌশলে পরিবর্তন আনতে শুরু করেছে। সিএনএনের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, চীনা কূটনীতিকদের জন্য এখন আক্রমণই প্রতিরক্ষার বড় অস্ত্র। জিনজিয়াংয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ যখন বাড়ছেই তখন চীন পালটা আক্রমণের কৌশল নিয়ে নেমেছে। কিছু পশ্চিমা দেশের বিরুদ্ধে তোপ দেগে তারা বলছে, চীনের মানবাধিকার ইস্যুতে কথা বলার আগে এসব দেশের উচিত নিজেদের জটিল মানবাধিকার পরিস্থিতির রেকর্ড দেখা।

কানাডায় আদিবাসী জনগণের প্রতি দেশটির সরকারের আচরণ নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ এবং নিরপেক্ষ তদন্ত করার জন্য গত সপ্তাহে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে চীন। সম্প্রতি কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া ও সাসকাটচেওয়ানে সাবেক এক আবাসিক স্কুলের জমিতে ৭৫০টির বেশি বেওয়ারিশ কবর পাওয়া গেছে। দেশটিতে আদিবাসীদের একটি সংগঠন কাউয়েসেস ফার্স্ট নেশন এই কবরগুলো খুঁজে পায়। কানাডায় এতো বিশালসংখ্যক অচিহ্নিত কবর পাওয়ার এ ঘটনা বিরল।

দেশটির আদিবাসী সম্প্রদায়ের শিশুদের সভ্য করে তুলে কানাডার মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দী ধরে এ স্কুলগুলো পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের ওপর। এসব স্কুলে পড়ালেখা করার সময় মারা যায় আনুমানিক ৬ হাজার শিশু— মূলত স্কুলের ভেতর খুবই অস্বাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশে বাস করার কারণে। শিক্ষার্থীদের প্রায়শই রাখা হতো এমন সব ভবনে যা খুবই নিম্নমানের, সেখানে ঘর গরম রাখার তেমন ব্যবস্থা ছিল না এবং ছিল না শৌচকাজের জন্যও ব্যবস্থা।

চীন বলছে, এই মর্মান্তিক ঘটনায় শুধু দুঃখ প্রকাশ করাটা যথেষ্ট নয়, কানাডার ভুল শোধরানোর জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। জেনেভাস্থ জাতিসংঘে চীনা মিশনের মিনিস্টার জিয়াং ডুয়ান এ কথা বলেন। তার এ বক্তব্য বেশ কিছু চীনা গণমাধ্যমে গুরুত্ব পেয়েছে। এমনকি চীনের রাষ্ট্র পরিচালিত গ্লোবাল টাইমস কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর একটি কার্টুন প্রকাশ করেছে যেখানে তাকে দেখা যাচ্ছে কঙ্কালের খুলির স্তূপের ওপর বসে আছেন তিনি। সেখানে ক্যাপশন ছিল— ‘আমরা তোমাদের জমি কেড়ে নিয়েছি, তোমাদের পুরুষদের খুন করেছি, বাচ্চাদের কবর দিয়েছি, এখন আসো মিটমাট করে ফেলি।’

উইঘুরদের ওপর চীন নির্যাতন করছে এ অভিযোগ তদন্তের জন্য পশ্চিমা ৪৪টি দেশের সঙ্গে মিলে কানাডা জাতিসংঘকে আহ্বান জানানোর পর চীন এ অবস্থান নিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেবে চীন

কানাডা প্রথম দেশ নয়, যাদের বিরুদ্ধে চীন এই ভূমিকা নিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া আধিবাসীদের ওপর নির্যাতন করছে বলে এর আগে অভিযোগ করেছে বেইজিং। গত ছয় মাস ধরে চীন অস্ট্রেলিয়াকে আক্রমণ করে আসছে। এমনকি আফগানিস্তানে অস্ট্রেলীয় সেনারা যুদ্ধাপরাধ করেছে বলে চীন অভিযোগ করেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মাধ্যমে মূলত মানবাধিকার ইস্যুতে পশ্চিমাদের ভণ্ডামিকে তুলে ধরতে চাইছে চীন। তবে তারা বলছেন, এক্ষেত্রে চীনও ঝুঁকিমুক্ত থাকছে না। চীনের প্রচেষ্টার জবাবে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন, উইঘুরদের ওপর নির্যাতনের দায় কেন নিচ্ছে না বেইজিং। কানাডা বলছে, তারা অতীতে ভুল করেছে, কিন্তু চীন কেন তাদের ভুল স্বীকার করে না। চীনে কানাডার সাবেক রাষ্ট্রদূত গাই সেন্ট জ্যাকস বলছেন, কানাডায় যে তদন্তের দাবি চীন করছে, সেই একই তদন্ত জিনজিয়াংয়ে করতে দিতে চাইছে না কেন তারা?