উন্নত চিকিৎসার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে তাঁর চিকিৎসার জন্য গঠিত ১০ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড। কিন্তু তিনি বিদেশে যেতে পারছেন কি না, সেই আলোচনা নতুন দিকে মোড় নিয়েছে একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৩ জুন হাইকোর্টের তরফে জারি করা আদেশের কারণে।
হাইকোর্টের ওই আদেশে খালেদা জিয়ার জন্মদিনসংক্রান্ত বিভিন্ন কাগজপত্র চেয়ে পাঠানো হয়েছে। এখন হাইকোর্ট কী সিদ্ধান্ত দেন, সেটি যেমন বেশ তাৎপর্যপূর্ণ; তেমনি বিদেশে যেতে হলে খালেদা জিয়ার পাসপোর্টের প্রয়োজন হবে। কিন্তু ওই পাসপোর্ট গত প্রায় দেড় মাস যাবৎ পড়ে আছে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে। সরকার তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মতি ছাড়া সেটি পাওয়া যাবে না।
গত ৬ মে নবায়নের জন্য জমা দেওয়া ওই পাসপোর্টের জন্ম তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট। একই জন্ম তারিখের কথা উল্লেখ রয়েছে খালেদা জিয়ার জাতীয় পরিচয়পত্রেও (এনআইডি)। ফলে ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিন নিয়ে আদালতের সিদ্ধান্ত কেমন হবে সেটি যেমন বেশ তাৎপর্যপূর্ণ; তেমনি উল্লিখিত জন্মদিনে সরকার পাসপোর্ট দেবে কি না সেটিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
অনেকের মতে, হাইকোর্টে রিট আবেদন, খালেদা জিয়ার পাসপোর্ট পাওয়া এবং চিকিৎসার জন্য বিদেশযাত্রা—সবই এক সূত্রে গাথা। তবে মূল বিষয় হচ্ছে, এসব কিছুর জন্য তাঁর জন্মদিনের বিষয়টি আগে নিষ্পত্তি হতে হবে। বিএনপি মনে করছে, সরকার ওই তারিখ বদলানোর জন্য রাজনীতি করছে। দলটির নেতাদের মতে, হাইকোর্টে রিট আবেদন ওই চাপেরই অংশ। অর্থাৎ পাসপোর্ট পেতে হলে ‘ভুল স্বীকার’ বা খালেদা জিয়াকে নমনীয় হতে হবে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে শেষ পর্যন্ত এতে খালেদা জিয়া রাজি হবেন বলে কেউ মনে করেন না।
হাইকোর্টে রিট করার ওই ঘটনাকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলে আখ্যায়িত করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত সোমবার বলেছেন, ‘একদলীয় শাসনে দেশ চলছে। জুডিশিয়ারি ইজ নট ফ্রি—এটাই তার প্রমাণ। তাদের এটি (রিট আবেদন) আমলেই নেওয়া উচিত ছিল না। দে শুড হেল বিন টোটালি রং।’ তিনি বলেন, ‘এখন পার্টিকুলার একটি ডেটে কেউ জন্ম নিতে পারবে না, এটা ঘোষণা দিয়ে দিলেই তো হয়ে যায়।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা কী করব সেটি এখনো ঠিক করিনি। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, হাইকোর্টে রিট আবেদন এমনি এমনি করা হয়নি, উদ্দেশ্য আছে।’ হতাশ কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আফসোস যে, তিন তিনবারের একজন প্রধানমন্ত্রীর চিকিৎসা নিয়েও সরকার রাজনীতি করছে।’
গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতে, ‘খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে রাজনীতি চলছে। কিন্তু এটা না হওয়াটাই বাঞ্ছনীয় ছিল।’ তিনি বলেন, ‘সরকারের মধ্যে ১৫ আগস্ট নিয়ে স্পর্শকাতরতা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু পাশাপাশি এটিও সত্যি যে আমাদের দেশের ষাট বা সত্তরোর্ধ্ব বেশির ভাগ মানুষেরই জন্মদিনের ঠিক নেই। কারণ ওই আমলের মা-বাবারা সন্তানের জন্মদিন লিখে রাখতেন না।’ ‘হাইকোর্টে রিট আবেদন, খালেদা জিয়ার বিদেশযাত্রা ও পাসপোর্ট হাতে পাওয়া সবই রাজনীতির অংশ। তবে এটাও ঠিক, ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন করা বিএনপির ঠিক হয়নি। এটা আমিই বলে-কয়ে বন্ধ করিয়েছি’ দাবি করেন বিশিষ্ট এই মুক্তিযোদ্ধা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ফলে ওই দিন জন্মদিন পালন নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছাড়াও প্রায় সব মহলে ক্ষোভ রয়েছে। এমনকি বিএনপিরও সিনিয়র বেশির ভাগ নেতা ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালনের পক্ষে নন। তাঁদেরই চাপে ২০১৫ সালের পর থেকে ১৫ আগস্ট কেক কাটার আনুষ্ঠানিকতা থেকে সরে আসে বিএনপি।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়ার পর তত্কালীন সরকারের অতি উৎসাহী কিছু কর্মকর্তা এবং বিএনপির কিছু জুনিয়র নেতার পরামর্শে ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালন শুরু হয়। ডানপন্থী বলে পরিচিত কয়েকজন নেতা ও সমর্থক বুদ্ধিজীবীর তৎপরতায় এই মাত্রা আরো বেড়ে যায় ১৯৯৬ সালের পর। বিরোধী দলে থাকতে তখন ২৯ মিন্টো রোড ও পরে গুলশান কার্যালয়ে ওই কর্মকর্তা ও নেতাদের পরামর্শেই খালেদা জিয়া পরিচালিত হয়ে এমন অবস্থানে গেছেন; যেটি আজকের রাজনীতির জন্য ‘ভুল’ বলে মূল্যায়ন করছেন এখনকার বিএনপির সিনিয়র নেতারা। তাঁরা বলছেন, বিএনপিতে ওই কর্মকর্তারা এখন ‘অতীত’ হয়ে গেছেন। তাঁরা কোথাও নেই। কিন্তু ওই ঘটনার বোঝা বা ঘানি এখন দলটির সিনিয়র নেতাদের বহন করতে হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলটির স্থায়ী কমিটির একাধিক নেতা কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, খালেদা জিয়ার কোনো জন্মদিন বা কোনো তথ্যই তাঁর নিজের ঠিক করে দেওয়া নয়। সব সময়ই তাঁর পাশে থাকা ভিন্ন ভিন্ন লোকদের পরামর্শ বা তত্ত্বাবধানে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে শুরু করে তাঁর পাসপোর্ট, এনআইডিসহ সংশ্লিষ্ট সব কিছু হয়েছে। কিন্তু কখনো কোথাও কোনো কাজ সমন্বয় করে করা হয়নি। ফলে আজকের এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
গত ৩১ মে হাইকোর্টে করা রিট আবেদনে খালেদা জিয়ার একাধিক জন্মদিনের কথা উল্লেখ করেছেন রিট আবেদনকারী। এর মধ্যে তাঁর এসএসসির নম্বরপত্র, বিবাহ নিবন্ধনে জন্মতারিখ, মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের জন্মতারিখ এবং সর্বশেষ করোনাভাইরাস পরীক্ষার রিপোর্টের ভিন্ন ভিন্ন তারিখ উল্লেখ করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করা হয়েছে।
তবে করোনাভাইরাস রিপোর্টের তারিখ সরকার সমর্থকরা কারসাজি করে বদলে দিয়ে অপপ্রচার করেছে বলে অভিযোগ করে আসছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ওই ঘটনাকে ‘ফেইক’ বলে উল্লেখ করেছেন। গতকাল মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য খালেদা জিয়ার জন্মতারিখ নিয়ে রিট করা হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য হলো একটাই; দেশের মূল সমস্যা থেকে জনগণের মনোযোগ অন্যদিকে ডাইভার্ট করা।’