চীন-পাকিস্তান মৈত্রী, উইঘুরদের নতুন বিপদ

মুসলমানদের মুক্তির ভূমি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে পাকিস্তান, উইঘুরের মুসলমানেরা সেখানে পালিয়েও টিকতে পারছে না। চীনের নির্দেশে তাদের আটক করা হচ্ছে, বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে উইঘুরদের প্রতিষ্ঠান। অনেককে আবার চীনে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। ওই সব ফেরত পাঠানো ব্যক্তির আর খোঁজ মিলছে না।

পাকিস্তান অতীব চমৎকার! যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হিসেবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদের অংশীদার ছিল, যেমন এখনো রয়েছে ইয়েমেনের বিরুদ্ধে সৌদিদের যুদ্ধে। ইদানীং অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে পাকিস্তান মুরব্বি বদল করে চীনের ‘জানি দোস্ত’ হয়েছে। যথারীতি উইঘুরদের বিরুদ্ধে, চীনের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও শামিল পাকিস্তানি সেনাসমর্থিত ইমরান খানের সরকার। আগে টাকা দিত যুক্তরাষ্ট্র। এখন বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর (সিপিইসি) নামের মেগা প্রকল্পে ৬৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে চীন। এটাই এখন মুষড়ে পড়া পাকিস্তানি অর্থনীতির ধমনি। টাকাই কথা বলে। তাই চীনকেন্দ্রিক এই উন্নয়নের বলি হতে হচ্ছে পাকিস্তানের উইঘুর প্রবাসীদের।

চীনের যে জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলমানদের বসবাস, তারই লাগোয়া হলো পাকিস্তানের গিলগিট-বাল্টিস্তান এলাকা। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোডের সড়ক সংযোগ সাংহাই থেকে জিনজিয়াং স্বায়ত্তশাসিত এলাকার ভেতর দিয়ে গিলগিট দিয়েই পাকিস্তানে প্রবেশ করে চলে গেছে বাল্টিস্তানের গদর বন্দর অবধি। এই গিলগিট-বাল্টিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার এক উত্তপ্ত ভূরাজনৈতিক কেন্দ্র। এর পাশেই রয়েছে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর, এর পাশেই চীন। চীন চাইছে গিলগিট এলাকায় উইঘুরদের বিতাড়ন করতে হবে, চীনের হাতে তুলে দিতে হবে। ওদিকে বালুচ স্বাধীনতাকামীরা চীনের শত্রুকে নিজেদের বন্ধু মনে করছে। তারা আশ্রয় দিচ্ছে উইঘুরদের। তখন চীন বলছে, বালুচ বিদ্রোহীরা উইঘুরদের পূর্ব তুর্কমেনিস্তান স্বাধীনতা আন্দোলনে মদদ দিচ্ছে। চীনা রাষ্ট্রদূত অল্পের জন্য বোমা হামলা থেকে বেঁচে গেছেন। চীনা প্রকল্পে বালুচ বিদ্রোহীদের হামলার বড় বড় ঘটনাও আছে।

জর্জ বুশের ভাষা সি চিন পিংয়ের মুখে
জর্জ বুশ আফগানিস্তানে গণতন্ত্র, শান্তি ও উন্নতি আনতে আগ্রাসন চালিয়েছিলেন। ডোনাল্ড রামসফেল্ড বলেছিলেন, ইরাক আগ্রাসনের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও গণতন্ত্র আসবে। কিন্তু আসেনি। চীনের মুকুটহীন সম্রাট প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংও উইঘুরে উন্নতি, সুখ ও নিরাপত্তা বাড়ার দাবি করেছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের অভিযোগমতে, চীন প্রায় ১০ লাখ উইঘুরকে রি-এডুকেশন সেন্টার নামের বন্দিশালায় আটকে রেখেছে। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মবিশ্বাস ও আচরণ বদলে দিয়ে চীনাকরণ চালাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যেমন আফগান নারীদের মুক্তির জন্য যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল, চীন বলছে, তারা উইঘুর নারীদের কেবল সন্তান জন্ম দেওয়ার হাত থেকে মুক্তি দিচ্ছে। মুক্তি দিচ্ছে বন্ধ্যকরণ করে। বন্দিশালায় ধর্ষণের অভিযোগও করেছে পালিয়ে আসতে পারা উইঘুরেরা।

চীনা জাতীয়তাবাদ ও ভূরাজনীতির বলি
শুধু মুসলমান বলেই নয়, উইঘুরেরা উইঘুর বলেও আক্রান্ত। চীনে অনুমোদিত ৫টি ধর্মের মধ্যে ইসলামও রয়েছে। চীনের অন্য অঞ্চলের মুসলমানেরা চীনা বংশোদ্ভূত হওয়ায় তাদের ইসলাম চীনা ধরনের। কিন্তু উইঘুরদের জাতিগত উৎস তুর্কি। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্ম তিনটিই চীনের একশিলা জাতীয়তাবাদে অগ্রহণযোগ্য।

তৃতীয় এবং আশু পারিপার্শ্বিক কারণটি অর্থনৈতিক। জিনজিয়াং বিরাট প্রদেশ হলেও জনসংখ্যা কম। তার ওপর এই অঞ্চলে রয়েছে খনিজ। সাংহাই থেকে বেল্ট অ্যান্ড রোডের সংযোগ গেছে উইঘুর শহর কাশগরে, সেখান থেকে পাকিস্তানে। মিয়ানমার যেভাবে আরাকানে চীন ও ভারতের বিনিয়োগের জন্য রোহিঙ্গাদের বসতি থেকে উচ্ছেদ করছে, চীনও উন্নয়নের দরকারে অগ্রহণযোগ্য জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় খাঁচায় ঢোকাচ্ছে।

আর এ কাজে তাদের কায়দাটা স্প্যানিশ রিকনকুইস্তাদোরদের মতো। আন্দালুসিয়ার মুসলিম সাম্রাজ্য হটানোর পরে তারা সেখানকার ইহুদি ও মুসলমানদের বলেছিল, নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্ম ত্যাগ করে স্প্যানিশ খ্রিষ্টান হয়ে যেতে। আরব খ্রিষ্টানদেরও স্পেনীয়করণ চলে। একই কাজ হয় সাবেক অটোমান সাম্রাজ্যভুক্ত বলকান অঞ্চলে। উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের শুরু পর্যন্ত তুর্কি ভাষাভাষীর নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি দমন করা হয়। চীনের মডেলও সেটাই যে তোমরা চীনা হয়ে যাও।