আজও কপিরাইট হলো না বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে উজ্জীবনী শক্তি ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ওই ভাষণের মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি।

স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর ২০১৭ সালে এ ভাষণকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। অথচ ওই ভাষণের কপিরাইট বা সৃজনশীল সৃষ্টিকর্মের স্বত্ব এখনও নিশ্চিত করেনি সরকার বা বঙ্গবন্ধু পরিবার।

কপিরাইট আইনের ৭৮ ধারা অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই তাঁর এই ভাষণের স্বত্বাধিকারী। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে এর স্বত্বাধিকারী তাঁর দুই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। তা ছাড়া ইউনেস্কোর স্বীকৃতির ফর্ম অনুযায়ী, বাংলাদেশের আইসিটি মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ ও বাংলাদেশ বেতার বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটির স্বত্বাধিকারী।

তবে কপিরাইট আইন অনুযায়ী, ভাষণটির স্বত্ব নিশ্চিত না করায় ইউটিউবসহ নানা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যক্তি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নানাভাবে ভাষণটির অপব্যবহার করছে, যা ডিজিটাল কপিরাইট আইনের লঙ্ঘন।

এর আগে প্রায় ৮ বছর বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ছলচাতুরীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটির কপিরাইট দখলে রেখেছিল ভারতীয় কোম্পানি ইনরেকো এন্টারটেইনমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড। ডিজিটাল লাইসেন্সের মাধ্যমে এই ভাষণ দখলে রাখা হয়। তারা ‘রক্তের প্রতিশোধ রক্তেই নেব’ এবং ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে’ নামে গান ক্যাটেগরিতে ভাষণটির ভিডিও কনটেন্ট ইউটিউবে আপলোড করে। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি ইউটিউব থেকে রয়্যালটি বাবদ অন্তত ১০ লাখ ডলার ব্যবসা করেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ কপিরাইট সমিতি।

২০২১ সালে জনস্বার্থে কপিরাইট বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার ওলোরা আফরিনের তৎপরতায় বঙ্গবন্ধুর ১৮ মিনিটের ওই ভাষণটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটির দখল থেকে অবমুক্ত হয়। তিনি এ বিষয়ে ওই প্রতিষ্ঠানকে আইনি নোটিশ পাঠালে তারা লাইসেন্স প্রত্যাহার করে। এর পর সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুততম সময়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কপিরাইট নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও এর অগ্রগতি হয়নি।

সংস্কৃতি সচিব খলিল আহমদ সমকালকে বলেন, ‘জাতির পিতার বিষয়ে সম্ভবত মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। কপিরাইট-সংক্রান্ত বিষয়গুলো কপিরাইট অফিস হয়তো বলতে পারবে।’

বিষয়টি রেজিস্ট্রার অব কপিরাইটস (অতিরিক্ত সচিব) দাউদ মিয়া সমকালকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ কপিরাইটের বিষয়ে কোনো আবেদন আমাদের কাছে জমা নেই। কপিরাইট হওয়ার কোনো তথ্যও আমার কাছে নেই।’ তিনি জানান, ভাষণটি কপিরাইট করতে হলে আইন অনুযায়ী অবশ্যই তাঁর পরিবার বা ওয়ারিশদের আবেদন করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি সংরক্ষণে যে ট্রাস্ট আছে, সেখান থেকেও আবেদন আসতে পারে। আবেদন পাওয়া গেলে দেড় মাসে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব।

বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণসহ কোনো ভাষণেরই কপিরাইট করা হয়নি। ফলে ভাষণের বিভিন্ন অংশ দেশ-বিদেশ থেকে নানাভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার হচ্ছে। খণ্ডিতভাবেও সম্প্রচারিত হয়। ফলে অনেক সময় প্রেক্ষাপট অনুযায়ী ভুল ব্যাখ্যা হওয়ার শঙ্কা থাকে।

কপিরাইট বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার ওলোরা আফরিন বলেন, অনলাইনে বিভিন্ন পন্থায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ব্যবহার করা হচ্ছে। তখন এটির মালিকানার খোঁজ করতে গিয়ে দেখি, ইনরেকো এন্টারটেইনমেন্ট নামের ভারতীয় কোম্পানি ২০১২ সাল থেকে বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এটিকে ব্যবহার করছে। তারা এটিকে অন্য নাম দিয়ে ডিজিটাল লাইসেন্স নিয়েছে। অথচ সেটি প্লে করলে ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুরু হয়। অথচ ওই ভাষণটির স্রষ্টা জাতির পিতা নিজেই। তাই ২০২০ সালে ভারতীয় কোম্পানিকে আইনি নোটিশ দিয়েছিলাম। ফলে কপিরাইট ছেড়ে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। তিনি বলেন, এর পর চার দফা প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকজন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক হয়। এতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কপিরাইট করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হলেও আর অগ্রগতি হয়নি। তিনি এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করেন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট একই অঙ্গীকার করেছিল। এ বিষয়ে ট্রাস্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাশুরা হোসেন  বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কপিরাইট সংক্রান্ত কোনো আবেদন প্রক্রিয়াধীন অবস্থায় নেই।

সিদ্ধান্ত পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ ট্রাস্টের কিউরেটর নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে আলোচনা হয়েছিল। তবে অগ্রগতি হয়নি।’

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকেও বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আর্কাইভ করার কথা বলা হয়েছিল। এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, প্রকল্পের কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি। তবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ মন্ত্রণালয়ের আর্কাইভে সংরক্ষণের বিষয়টি প্রকল্পের প্রস্তাবনায় রয়েছে।

বিশিষ্ট মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী সমকালকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনেই সাত কোটি বাঙালি স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। এই ভাষণের গুরুত্ব অনেক। সেই ভাষণের কপিরাইট থাকবে না– তা হতে পারে না। অবিলম্বে এটিসহ বঙ্গবন্ধুর সব ভাষণের কপিরাইট হওয়া প্রয়োজন। নয়তো ভাষণগুলো বিকৃত হবে, ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার বাড়বে। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের পাশাপাশি রাষ্ট্রেরও এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।