"Defaulting on World Bank-IMF terms is also strategic politics"

রিজার্ভ ধরে রাখতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ, টাকার মূল্য ধরে রাখতে বিনিময় হারে সীমা বেঁধে দেয়া- সরকারের এমন অনেক সিদ্ধান্তই বিলম্বিত এবং হিতে বিপরীত প্রমাণিত হয়েছে। হুন্ডিতে বেশি দর পেলে রেমিট্যান্স সে পথেই যাবে আর দেশে দূর্নীতি দূর না হলে টাকাও পাচার হবেই । বিশেষ সাক্ষাৎকারে এসব বলেছেন ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। জুলিয়া আলম এর সাথে দীর্ঘ আলাপে তিনি আরো বলেন, আর্থিক খাতের বড় সমস্যা-ঋণখেলাপির কারণও সবারই জানা, তবু সমাধান না করতে পারার কারণ রাজনৈতিক অর্থনীতি।

জুলিয়া: অনেক বছর পর আবার আমরা দেখলাম বাজেট ঘাটতি মেটাতে, ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ভারসাম্য আনতে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফসহ দাতাদের কাছে যেতে হলো আমাদের। বাংলাদেশের একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখেন?
ড. জাহিদ: আমাদের সার্বিক বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্য কথা যদি বলি সেখানে গত গত দেড় বছরে আমি বলবো, বাণিজ্য ঘাটতি অনেক বেড়ে গেছে। আগে বড় ধরণের ঘাটতি থাকলেও সেটা রেমিট্যান্স এবং বৈদেশিক অর্থায়ন থেকে নিয়ে সংকুলান হয়ে যেতো। ফলে বড় ধরণের কোন ঘাটতি আমরা ইদানিংকালে দেখি নাই। কিছু সময় ধরে বরং উদ্বৃতই দেখা গেছে। কিন্তু গত দেড় বছর ধরে একদিকে বানিজ্য ঘাটতি বেড়েছে অন্যদিকে রেমিট্যান্স কমেছে তাই ফাইনান্সিয়াল একাউন্টের মাধ্যমে ঘাটতি পূরণ হয়নি, একটা গ্যাপ সৃষ্টি হয়েছে। এটাই সামাল দেয়া হয়েছে মূলতঃ রিজার্ভ খরচ করে। যেহেতু কোভিড এর সময় ইনফরমাল চ্যানেলগুলো প্রায় বন্ধ হয়েছিল সে কারণে অর্থবছর একুশে আমরা রেমিট্যান্সের বিরাট বৃদ্ধি দেখেছি যা ছয়শ কোটি ডলার বা তারও বেশি। ওটাই রিজার্ভকে এক সময়ে আটচল্লিশ বিলিয়ন ডলারে উঠিয়েছিলো এবং বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতাকে সামাল দেয়া সম্ভব হয়েছে। গত বছরও প্রায় সাতশ ষাট কোটি ডলারের মত বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবহার করেছে। এই বছর এই পর্যন্ত প্রায় পাঁচশ নব্বই কোটি ডলার ব্যবহার হয়ে গেছে। এভাবে যদি রিজার্ভ থেকে খরচ চলতে থাকে, তাহলে একসময় রিজার্ভটা ফুরিয়ে যাবে। কাজেই সময় থাকতেই এডিশনাল অর্থ যোগানের ব্যবস্থা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

দেখেন আইএমএফ এর কাছে একটা দেশ যায় দুই ধরণের সিচুয়েশনে-একটা হল শ্রীলংকার মত সিচুয়েশন যখন অর্থনীতি খাঁদে পড়ে গেছে, বিপদ চলে এসেছে, সেটাকে সামাল দেয়ার জন্য আইএমএফ ছাড়া কোন বিকল্প থাকে না। আমরা যে শ্রীলংকার মত ক্রাইসিসে পড়ে গেছি তা কিন্তু না। অনেক দেশ আবার সংকট আসতে পারে সেই আশংকায় আগাম প্রস্তুতি হিসাবে আইএমএফ এর কাছে ঋণ চায়। ব্যাংকে যেমন অনেক ব্যবসায়ী একটা ক্রেডিট লাইন খুলে রাখে যা জরুরি হলে তারা ব্যবহার করে।

জুলিয়া: অর্থনীতির এমন দশা হলো কেন? এটা কি শুধু যুদ্ধ বা বিশ্ব সংকটের প্রভাব নাকি অদূরদর্শীতা ও ভুল নীতিও এক্ষেত্রে দায়ী? অনেকে কিন্তু এমনটি বলতেও শুরু করেছেন।
ড. জাহিদ: এখানে খুব সহজ সরল উত্তর দেয়াটা বোধহয় ভুল হবে। বর্তমানে অর্থনীতি দুই ধরণের চাপে আছে, একটা হল ব্যক্তি পর্যায়ে বা পরিবার পর্যায়। নিন্ম আয়ের পরিবারগুলো জীবিকার যোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছে – আয় এবং ব্যয়ে ভারসাম্য রাখাটা কঠিন হয়ে গেছে মূল্যস্ফীতির কারণে। যে হারে আপনার ব্যয় বাড়ছে, সে হারে আপনার আয় বাড়ছে না। প্রশ্ন হলো এই মূল্যস্ফীতিটা কি কারণে হলো? একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য মূল্যের বৃদ্ধি যেটা কোভিড পরবর্তীকালে সাপ্লাই চেইন ডিসরাপশনে হয় তা সব দেশেই দেখেছি। দ্বিতীয়ত ডলারের মূল্য বৃদ্ধি। ডলারের মূল্যবৃদ্ধিটাও কিন্তু যুদ্ধের আগেই শুরু হয়েছিল যুদ্ধ মাত্রাটা আরও বাড়িয়েছে। আমাদের যে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি এরও প্রধান কারণ কিন্তু এই দুইটিই ।
তৃতীয় কারণ-সেখানে আপনি যে বিষয়টা নিয়ে আসছেন-কোভিড কমার পর অর্থনীতির গতি পুনরুদ্ধার শুরু হয় সে সময়ে চাহিদাটা বেড়েছে। কোভিডের সময়ে আমি যে খরচটা করতে পারি নাই। কাজেই আভ্যন্তরীণ চাহিদারও একটা বৃদ্ধি তখন ঘটেছে। কোভিড সময়ে অনেক সহায়তা কর্মসূচী- স্টিমুলাস বা ফাইনান্সিয়াল স্টিমুলাস প্যাকেজও অনেক ছিলো। বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং মাঝারি, ক্ষুদ্র শিল্পে আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়েছে, সামাজিক সুরক্ষা খাতেও ব্যয় বেড়েছে। এগুলো সবই চাহিদাকে বৃদ্ধি করে, সেইটা মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে একটা অবদান রেখেছে। তবু মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণ কিন্তু এই ডলারের মূল্য বৃদ্ধি আর আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি।

জুলিয়া: এখানে আমাদের অদূরদর্শীতা বা ভুল নীতি এরকম কিছু দেখেন কি না?
ড. জাহিদ: অদূরদর্শীতার ক্ষেত্রে আপনি ধরেন আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি সংক্রমণ আমাদের আভ্যন্তরীণ বাজারে রোধ করতে গিয়ে সরকার কিছু কাজ করেছে যেগুলো আসলে সংক্রমণটাকে থামিয়েছে, মানে যেটা আগে হতে পারতো সেটা পড়ে হয়েছে। যদি সময়মত ধীরে ধীরে এডজাস্টমেন্টটা করা হতো তাহলে ভালো হতো।  যেমন ধরেন গত আগস্টে একধাপে আপনি তেলের দাম বাড়িয়ে দিলেন পঞ্চাশ শতাংশের মতো। এটা এক ধাপে না করলে ভালো হতো। তেলের দামতো বাড়া শুরু হয়েছে ২০২১ থেকেই- কাজেই আপনি অল্প অল্প করে কয়েকবারে যদি বাড়াতেন তাহলে মানুষের বোঝাটা, অন্ততঃ মনস্তাত্তিক বোঝাটা কম হতো। হঠাৎ করে বেশী দাম দেয়ার মত একটা সিচ্যুয়েশন তৈরি হতো না। রিজার্ভ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও যদি একটু ধীর গতিতে রিজার্ভটা খরচ করা হতো। অবশ্য সেখানে একটা হয়ত মূল্য দিতে হতো-ডলার রেট আগেই বেড়ে যেতো। আমরা সেটাকে পিছিয়ে দিয়েছি বলেই গত মে মাসের পর সংকট এতোই বেড়ে গেলো যে এখন টাকার মূল্য এডজাস্ট করতে দিতেই হবে। পঁচাশি টাকায় ডলার আপনি সারা বছর ধরে রাখলেন-তারপর মে থেকে নভেম্বরের মধ্যেই ডলারের দাম একশ হলো- এটা অল্প সময়ের মধ্যে বেড়েছে। কাজেই যদি আপনি বলেন অদূরদর্শীতা-এই অদূরদর্শীতার জায়গাটা হচ্ছে এডজাস্টমেন্ট প্রসেসটা আগে থেকে করতে পারলে হয়ত সিচ্যুয়েশনটা আরও বেটার হতে পারত।
জুলিয়া: অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির প্রশংসা করে আসছিল বিশ্বব্যাংকও। কিন্তু দুই দশক এমন উচ্চ প্রবৃদ্ধির পরও আমাদের অর্থনীতির ভিত এতো দূর্বল থাকলো কেন?
ড. জাহিদ: দেখুন আপনি মোটা দাগে যদি চিন্তা করেন, এই প্রবৃদ্ধির পেছনে চালিকাশক্তিগুলো কি। মূলত তিনটি-এক হলো কৃষিখাত। আমাদের জনসংখ্যা বেড়েছে, খাদ্য উৎপাদনও বেড়েছে যদিও কৃষি জমি কমেছে নগরায়ন ও ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট এসবের কারণে। আমাদেরতো এমনিতেই জমি কম তারপর সতের কোটি মানুষের খাদ্যের যোগান দেয়া নিজস্ব উৎপাদন থেকে-এটা অন্তত চালের ক্ষেত্রে করতে সক্ষম হয়েছি। তবে কৃষিতে বহুমুখীকরণ এবং আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে যদি ভিয়েতনাম বা চীনের সাথে তুলনা করি এমনকি অনেক ইন্ডিয়ান রাজ্যের সাথেও তুলনা করি আমরা এখনো কিন্তু ঐ পর্যায়ে পৌঁছুতে পারিনি। উৎপাদন সহায়তার দিকে আমরা এগিয়েছি কিন্তু আমাদের সমতুল্য অনেক দেশ আরও বেটার করছে।
দ্বিতীয় চালিকা শক্তি হিসাবে প্রবৃদ্ধিকে বাড়িয়েছে আমাদের এক্সপোর্ট। তবে এক্সপোর্টে একটা সেক্টরে নির্ভরশীলতা থেকে আমরা বেরুতে পারিনি বরং এটা ইদানিংকালে বেড়েছে। গার্মেন্টস এক্সপোর্টের  আশি শতাংশের উপরেই ছিল এখন চুরাশি শতাংশ। এক্সপোর্টের বহুমুখীকরণের কথা আমরা অনেকদিন থেকেই বলে আসছি কিন্তু  দৃশ্যমান কোন ফলাফল পাওয়া যায়নি।
তৃতীয় যেটা- সেটা হল ২০০০ এর পর থেকে বাংলাদেশে বড় প্রবৃদ্ধির জায়গা রেমিট্যান্স। বিদেশে আমাদের শ্রমিক সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু আনস্কিলড লেবার মাইগ্রেশনের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ কারিগরী শিক্ষার একটা ঘাটতির কারণে। এখন এক কোটির কাছাকাছি বাংলাদেশী শ্রমিক বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে জিসিসি কান্ট্রিগুলোতে কাজ করছে কিন্তু সেখান থেকে মাথাপিছু রেমিট্যান্সের যদি আপনি ফিলিপিন্সের বা শ্রীলংকার সাথেও তুলনা করেন দেখবেন অনেক কম। তাই সার্বিকভাবে আপনার প্রশ্নের উত্তর হলো অর্থনীতির আকার বৃদ্ধিতে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে আমরা সাফল্য যে পাইনি তা-না, কিন্তু সাফল্যর উত্তরণ যে এক পর্যায় থেকে আর এক পর্যায়ে যাবে সেখানে গিয়ে হয়ত আমরা কিছুটা হোঁচট খাচ্ছি।
জুলিয়া: বিশ্বের অনেক দেশে মূল্যস্ফীতির হার কিন্তু  বাংলাদেশের চেয়েও অনেক বেশী কিন্তু আমাদের দেশে এই ভারই সইতে পারছে না। তাহলে কি আসলে সাধারণ মানুষের আয় না বেড়ে গণিতের হিসাবেই শুধু অর্থনীতির আকার বেড়েছে?
ড. জাহিদ: বাংলাদেশে বর্তমানে মূল্যস্ফীতি আট থেকে নয় শতাংশ।  আপনি যদি গ্লোবালি কমপেয়ার করেন- তুরস্ক  বা পাকিস্তান বা শ্রীলংকা সেখানেতো অনেক বেশী। গ্লোবালি আামাদের হার মাঝামাঝি পর্যায়ে-আমাদের নীচেও অনেক দেশ আছে উপরেও অনেক দেশ। কিন্তু এটা যদি আপনি একজন রিক্সাওয়ালাকে বলেন যে, মূল্যস্ফীতি নিয়ে কেন অভিযোগ করছো তুরস্কেতো মূল্যস্ফীতি আশি পারসেন্ট সেটা বললেতো হবে না। সে যে দিনে কামাই করছে তার পরিবারের জন্য তিন বেলা খাবার যোগানই কঠিন হয়ে পড়েছে। তুরস্কে মূল্যস্ফীতি আরো বেশি বললেওতো তার কষ্ট কোনভাবেই কমছে না। প্রশ্ন যে এই ধরণের মূল্যস্ফীতি তাহলে কি ইংগিত দিচ্ছে? আমাদের অর্থনীতি আকারেই বেড়েছে? এই বৃদ্ধির উপকার কি সব পর্যায়ে গেছে নাকি কিছু জায়গায় রয়ে গেছে? সেটাই বৈষম্যের ইস্যু। আমরা ২০১০ এর পরে জড়িপগুলোতে দেখতে পাচ্ছি আয়ের বৈষম্য ও ব্যয়ের বৈষম্য কিছুটা বাড়ার দিকে। ধনীদের জন্যও মূল্যস্ফীতি বিরক্তির বিষয় কিন্তু তাদের পক্ষে এফরডেবল। মধ্যবিত্তদের জন্য এটা সঞ্চয়ের সংকট-তাদের আয় যে হারে বেড়েছে ব্যয় তার চেয়ে বেশী বেড়ে গেছে যার কারণে তার সঞ্চয় এর সামর্থ্য সংকুচিত হয়ে গেছে অথবা সঞ্চয় ভেঙ্গে তাকে চলতে হচ্ছে-সেটাও মোটামুটি সহনীয়। তার কষ্ট হচ্ছে যে আমার ভবিষ্যতে কি হবে এই নিয়ে উদ্বেগ । কিন্তু নিম্ন আয়ের পরিবার এবং দরিদ্র পরিবারগুলোর তাদের জন্য এটাতো জীবিকার সংকট এবং এখানে ইভেন সিক্স পারসেন্ট ইনফ্লেশনও তার জন্য অনেক হাই। কারণ, সে বলছে আমার আয়তো সেই তুলনায় বাড়েনি আপনি মজুরী ডেটা যদি দেখেন বিবিএস এর সিপিআই-এ সেখানে দেখবেন যে, গত তিন মাস ধরে আগে কিন্তু দেখা যেত মূল্যস্ফীতির সাথে পাল্লা দিয়ে মজুরীও হয়ত ছয় পারসেন্ট বৃদ্ধি। তার মানে আপনার রিয়েল ওয়েজ বাড়ছে না বাট আপনার এটা কমছেও না কিন্তু ইদানিংকালে যেটা দেখা গেছে যে, মূল্যস্ফীতি মজুরী বৃদ্ধির তুলনায় অনেক বেশী। কাজেই তাদেরতো প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। অদক্ষ শ্রমিকদের সবই দরিদ্র ঘরের শ্রমিক কাজেই সেখানে কিন্তু সমস্যাটা আরও বেশী এখানে আন্তর্জাতিক তুলনা করে লাভ নাই।
জুলিয়া:  অনেক বছর ধরে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়ার পরও আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট নিয়ে এখন ভাবতে হচ্ছে কেনো? এক্ষেত্রে নীতি ও ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা কি দেখেন?
ড. জাহিদ: কিছুক্ষণ আগে আপনি বলছিলেন আমরা অদূরদর্শী নীতি গ্রহণ করেছি কি না বা কোন ভুল করেছি কি না সেখানে আমি বলব যে ইদানিং কালে আমরা কিছু পলিসি গ্রহণ করেছি যেগুলো হিতে বিপরীত হচ্ছে। ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতি মেটাতে বিদেশী ঋণ যথেষ্ট হবে না আর এটা টেকসই কোন সমাধান না। আপনি কি বারবার ঋণ নেবেন?  কাজেই আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার যোগানটাকে বাড়াতে হবে। স্বল্প মেয়াদে বৈদেশিক মুদ্রার যোগান বাড়ানো আর এক্সপোর্ট দিয়ে হবে না, কারণ এক্সপোর্ট বাজার ইউরোপে এখন মন্দা ঘনীভূত হলে ইমিডিয়েটলি এক্সপোর্ট বাড়ানোর সম্ভাবনা খুব কম।
সে সুযোগ আছে রেমিট্যান্সে। গত দেড় বছরে বাংলাদেশের প্রায় পনের লক্ষ নতুন শ্রমিক বাইরে কাজে গেছে এটা কিন্তু একটা রেকর্ড। কোথায় গেছে? ষাট শতাংশই গেছে সৌদি আরবে, পনের শতাংশ ওমানে, প্রায় দশ শতাংশ গেছে কুয়েতে। এই দেশগুলো বর্তমানে বিশ্ব সংকটের সুবিধা পাচ্ছে-তাদের তেলের দাম বেড়েছে গ্যাসের দাম বেড়েছে তাই রেভিনিউ অনেক বেড়ে গেছে। এদের জিডিপি গ্রোথ পাঁচ ছয় পারসেন্ট আর মূল্যস্ফীতি তিন থেকে চার। কাজেই আমাদের রেমিট্যান্সটা ব্যাপকভাবে বাড়ার কথা। সেটাই হচ্ছিল। আপনি যদি দেখেন এই বছরের এপ্রিল পর্যন্ত মাসে দুইশ কোটি ডলারের মত রেমিট্যান্স পেয়েছিলাম। তখন অনেকে বলেছিলেন, রমজান ও  ঈদের ইফেক্ট পরে দেখা গেল মে-জুন মাসেও একশ নব্বই কোটি ডলার করে গড়ে রেমিট্যান্স আসলো যখন আমাদের নরম্যালি আসতো একশ পঞ্চাশ থেকে একশ সত্তর কোটি ডলারের মত। জুলাই-আগস্টে গিয়ে আবার এটা দুইশো কোটি ডলারে উন্নীত হলো, সেপ্টেম্বরের প্রথম দুই সপ্তাহে একশ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে তখন আমরা মনে করেছি হ্যাঁ আমরা তো দুইশো কোটির ঘরে পৌঁছে গেছি। কিন্তু সেপ্টেম্বরের শেষ দুই সপ্তাহে একটা ধ্বস নামল। আসলো মাত্র পঞ্চাশ কোটি এবং অক্টোবরেও সারা মাসে দেড়শ কোটি। প্রশ্ন হচ্ছে যে এমন কি ঘটল, সেপ্টেম্বরে হঠাৎ করে রেমিট্যান্সটা পড়ে গেল- কিছুইতো বদলায়নি।  কি বদলেছে? আমাদের এক্সচেঞ্জ রেইট সিস্টেমটা বদলেছে। আপনার হয়ত খেয়াল আছে  বাফেডা এবং এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স মিলে তারা একটা নতুন পদ্ধতি চালু করল যে এক্সপোর্টে আমরা নিরানব্বই টাকার বেশি দিতে পারব না। মানে একটা ক্যাপ আমরা বসিয়ে দিলাম। এলসির জন্য আমরা একটা ফরমুলা দিয়ে দিলাম ওয়েটেড এভারেজের ভিত্তিতে এলসি খুলতে হবে তার মানে ছাপ্পান্নটা ডিলার আছে ছাপ্পান্ন রকম এভারেজ হবে এবং ছাপ্পান্ন রকমের এলসি সেটলমেন্ট গৃহীত হবে এই যে একটা মালটিপল রেইট সিস্টেম করা হল এবং এখানে ক্যাপ বসিয়ে দেয়া হল আমার মতে সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স যে হঠাৎ করে কমে গেল এইটাই একমাত্র কারণ। কারণ, অন্য কোন কিছু ঘটে নাই।
আর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আমরা কি করেছি এ পর্যন্ত যে সমস্ত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সেখানে ধরেন, এই ডলার সংকটটাকে মাথায় রেখে কিন্তু পদক্ষেপগুলো বেশি এসেছে। আমদানির উপরে অনেক ধরণের শুল্ক বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে এলসি মার্জিন বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, এলসির উপর সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, আবার ধরেন ডিজেল এবং গ্যাস এটাকে সাশ্রয়ী হওয়ার জন্য বিদ্যুতের উৎপাদন কমানো হয়েছে যার জন্য লোড শেডিং বেড়ে গেছে। এমন সময় লোড শেডিংটা হয়েছে যখন দেশে একটা খড়া যাচ্ছিল আমনে সেচের প্রয়োজন ছিল এবং সেটাতো হয় ডিজেল দিয়ে করতে হবে অথবা বিদ্যুৎ দিয়ে করতে হবে দুইটারই যদি সংকট থাকে তাহলে আপনি সেচ কিভাবে করছেন।
কাজেই এখানে যে প্রশ্ন আসে আমরা যে পদক্ষেপগুলো নিচ্ছি এই পদক্ষেপগুলোর অনাকাঙ্খিত ফলাফলগুলো কেন আগে থেকে ভাবা হয়নি। আপনি যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করছেন ডিজেলের আমদানি কমিয়ে বা গ্যাসের আমদানি কমিয়ে, লোড শেডিং এর কারণে অর্থনীতির উৎপাদনে যে একটা ইমপ্যাক্ট হচ্ছে এটার ফলে যদি আমার আমদানি বেড়ে যায় সেটি কিন্ত আমরা যতটা সাশ্রয় করছি আর চেয়ে বেশি।
সেটা আমরা ভাবিনি। দেখুন  শ্রীলংকা কেমিক্যাল ফার্টিলাইজারের ইমপোর্ট ব্যান্ড করে দিয়েছিল তখন যেই যুক্তিটা দেখানো হয়েছিল ব্যালেন্সের পেমেন্টে সমস্যা আছে, বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করতে হবে ইমপোর্ট কমাতে হবে আর একটা যুক্তি দেয়া হয়েছিল যে কেমিক্যাল ফার্টিলাইজার না আসলে অরগানিক এগ্রিকালচার গ্রো করবে যেটা পরিবেশের জন্য ভাল হবে। পরিবেশবাদীরা এটাকে কিন্তু খুব বাহবা দিয়েছিলেন । পরে যেটা দেখা গেল কেমিক্যাল ফার্টিলাইজার আমদানি বন্ধে তাদের সাশ্রয় হলো চারশ মিলিয়ন ডলার  কিন্তু ফার্টিলাইজার না থাকার কারণে চালের উৎপাদন কমেছে, চায়ের উৎপাদন কমেছে শুধুমাত্র চালের ঘাটতি মেটানোর জন্য তাদেরকে চারশ মিলিয়ন ডলারের আমদানি করতে হল। চায়ের উৎপাদন কমার ফলে তাদের এক্সপোর্টও অনেক কমে গেছে।  এগুলোতো আমাদেরও চিন্তা করতে হবে আমাদের ক্ষেত্রে কিন্তু লোড শেডিংটাও তাই। আমি গ্যাস দিতে পারছি না শিল্প-কারখানাগুলোতে, গার্মেন্টওয়ালারা কমপ্লেইন করছে। বিটিএমইএ যেমন একটা প্রস্তাব দিয়েছিল আমাদের ছয় মাসে প্রতি মাসে দুইশো মিলিয়ন ডলারের এলএনজি ইমপোর্ট করে দেন তা আমরা বাজার মূল্যে কিনবো এতে উৎপাদন হবে এবং এক্সপোর্ট হবে তিন চার বিলিয়ন ডলারের মতো।
মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রেও আপনি দেখেন মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত আমরা কি পদক্ষেপ নিয়েছি সরকারী ব্যয়ে অস্টারিটির কথা কৃচ্ছতার কথা বলা হচ্ছে।  আইডিয়াটা হল যে এটা করলে একদিকে ব্যয় কমবে আর চাহিদা কমলে মূল্যস্ফীতির উপর চাপ কমবে। শুধুতো বললে হবে না যে আপনি সাশ্রয়ী হন, এটা বললে যে সবাই শুনবে তাতো আপনি নিশ্চিত হতে পারবেন না কিন্তু আপনি যদি সেই সাথে কিছু পলিসি নেন যেটা সাশ্রয়ী হওয়ার জন্য একটা প্রণোদনার সৃষ্টি করবে একটা ইনসেনটিভ তৈরী করবে, তখনতো তারা সাশ্রয়ী মানে নিজে স্বপ্রণোদিত হয়ে সাশ্রয়ী হবে। ঐ ক্ষেত্রে কিন্তু আমাদের পলিসির ঘাটতি আছে।
জুলিয়া: আর্থিক খাতে অব্যবস্থাপনা দূর করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সব সময় চাপ দিয়ে আসছে বিশ্বব্যাংক কিন্তু পাহাড় সমান খেলাপি ঋণ এবং নানা আর্থিক কেলেঙ্কারি প্রমাণ করেছে সুশাসন হয়নি। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার ব্যর্থ হলো কেনো?
ড. জাহিদ: এখানে আপনি যদি বলেন যে ডিজিজটা কি? বড় রোগটা কি? তাহলে দুই ধরণের রোগ আছে-একটা অনেক পুরোনো রোগ যা খেলাপী ঋণ এনপিএল এটি সরকারী ব্যাংকগুলোতে বেশি। দ্বিতীয়টি ব্যক্তি খাতের ব্যাংকগুলোতে- আরপিএল বা রিলেইটেড পার্টি লেন্ডিং মানে স্বজনদের ঋণ দেয়া এক ব্যাংকের ডিরেক্টর হয়ত অন্য ব্যাংকের মালিকদের ঋণ দিচ্ছে। কারণ আমি নিজের ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবনা। ওটাকে বাইপাস করার জন্য এই রিলেইটেড পার্টি লেন্ডিং বা ইনসাইডার লেন্ডিং-  দুটোই  আবার খেলাপী। এক্ষেত্রেই এনপিএল সমস্যাটাই বেশি এটেনশন পাচ্ছে এর অংকটা পাওয়া যায়। আরপিএল সম্পর্কে খুব একটা তথ্য পাওয়া যায় না, ধরাও খুব কঠিন। তবে কিছুদিন আগে বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট বলেছে আরপিএল এর পরিমাণ প্রাইভেট সেক্টরের মোট ঋণের প্রায় বিশ শতাংশের মত হতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো যে শুধরানোর যা করণীয়, এইটা কিন্তু সরকারও জানে। গত দশ বছরের বাজেট বক্তৃতা,  ইকনোমিকপলিসি স্টেটমেন্ট ও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ডকুমেন্টে বলা হয়েছে নন পারফরমিং লোন কমাতেই হবে। অলরেডি নন পারফরমিং হয়ে গেছে তা আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে কারণ রক্ত ক্ষয়টা বন্ধ করেন তারপরে রোগটাকে সারেন। সেইটা করতে গেলে কি করতে হবে? ঋণ দেয়ার সময় আমার ডিউ ইন্টেলিজেন্সটা উন্নত করতে হবে। যাদের ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তাদের ক্ষেত্রে তারা কি না জেনে ঋণ দিয়ে দিচ্ছেন খেলাপীদের নাকি জেনেশুনেই দেয়া হচ্ছে? এটা বাইরে থেকে রাজনৈতিকচাপ হোক হোয়াটএভার? –ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডিরেক্টরস যারা আছেন তাদের ভূমিকা আরও বাড়ানো জরুরি ।
আর ঋণ আদায়ের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক দূর্বলতা আছে। কোর্টে গিয়ে কেস করলে দশ বছর ঝুলে থাকে মানে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ঘাটতি আছে। আইনের সংস্কার ব্যাংকিং কোম্পানী আইনের সংস্কার করতে হবে। আসলে কি করা প্রয়োজন এগুলো কিন্তু মোটামুটি ভালভাবে চিহ্নিত, অজানা কিছুনা, সরকারও জানে বাংলাদেশ ব্যাংকও জানে। আমাদের দেশীয় অর্থনীতিবিদরা ব্যাংকিং এ কিন্তু একই পরামর্শ দিচ্ছেন কিন্তু বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। কেনো  সেই উত্তর দেয়া খুব কঠিন। সোনালী ব্যাংক বলেন বা জনতা ব্যাংক বলেন বোর্ডে যাদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে এরা কি আসলে একটা ব্যাংক চালানোর মত অভিজ্ঞ বা দক্ষ।  যদি সরিষার ভিতরে ভুত থাকে বোর্ডে যদি আপনার প্রবলেম থাকে, তাইলে আপনি খেলাপীঋণ থেকে মুক্ত থাকবেন কিভাবে। এট দ্য এন্ড অব দ্য ডে আমরা সমাধানগুলো জানি, সমস্যাও চিহ্নিত কিন্তু সমাধানে কোথাও না কোথাও গিয়ে হোচট খাচ্ছি কারণ, এক্সটারনাল একটা প্রেসার আসছে। এটা পলিটিক্যাল ইকনোমি রাজনৈতিক অর্থনীতির ব্যাপার। এ ছাড়া আমি তো আর কোন উত্তর খুঁজে পাই না।

জুলিয়া: টাকার মান গত কয়েক মাসেই প্রায় ২০ শতাংশ কমেছে। সাধারণ মানুষ কিন্তু এটিকে অর্থনীতির দুর্বলতা ভাবছে? আপনি কি বলবেন? এতে কি হুন্ডি ও অর্থপাচার বাড়তে বা কমতে পারে?
ড. জাহিদ: শুধু যে টাকার মান কমেছে তা না ডলার ছাড়া অন্য সব কারেন্সির মানই কমেছে। কিন্তু এটাকে ঠিক অর্থনীতির ”দুর্বলতা”বা এটাকে অর্থনীতির একটা ”স্ট্রেংথ”এভাবে বিচার করা ঠিক হবে না। দেখতে হবে যে বিদেশী মুদ্রার যে যোগানের সাথে চাহিদার ভারসাম্য রক্ষার জন্য মুদ্রা বিনিময় হারটা সঠিক পর্যায়ে আছে কি নাই। যদি ডিমান্ডের তুলনায় সাপ্লাই কম থাকে তাহলে তো আমার বলতে হবে যে টাকার মান আরও কমা দরকার কারণ যেই পরিমাণ কমেছে এতে আমার সমস্যার সমাধান হয়নি। কারণ টাকার মান কমলে যারা বাইরে থেকে আমাকে বিদেশী মুদ্রা পাঠাচ্ছেন তারা যেহেতু বেশী টাকা পাবেন এটা অর্থনীতির উপকারে আসবে। অন্যদিকে যেহেতু ডলারের দাম বেড়ে গেলে অনেক সাশ্রয়ী আচরণও দেখা যাবে যে, বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা কমাতে এটা সহায়ক হবে।
যার কারণে আমি বলছি যে, রেটটা ক্যাপ করে দেয়াটা ঠিক হয়নি- এটা মার্কেটের সাপ্লাই ডিমান্ডের ব্যালান্সিংএ বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখতে হবে যে টাকার মান কি কারণে কমেছে সেইটা কি আমাদের অর্থনীতির কোন দুর্বলতা থেকে সৃষ্টি হয়েছে নাকি এটা এক্সটারনাল কোন কারণে কমেছে। যদি দেশের কোন কারণে এক্সপোর্ট হতে পারছে না, ফ্যাক্টরি চলতে পারছে না, শ্রমিক অসন্তোষ বা কোন নীতির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমে গেছে। সেক্ষেত্রে আপনি বলতে পারেন না এই যে টাকার মান কমলো এটা অর্থনীতির দুর্বলতার কারণে।
এখন যেটা ঘটেছে সেটাতো হলো মূলত: আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের দাম বৃদ্ধি। আর সেই সাথে আমরা আমাদের পলিসিটাকে ঠিক সময়মত সমন্বয় করতে ব্যর্থ হয়েছি। পরের দিকে আমরা কিছু উল্টো পথের পদক্ষেপ নিয়েছি। যদি সঠিক পদক্ষেপ নেয়া হতো, ক্যাপ না হতো তাহলেতো এক্সপোর্টার ডলার বিক্রি করতো একশ পাঁচ টাকা একশ ছয় টাকায়। যে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে সে হুন্ডিতে না গিয়ে ফরমাল চ্যানেলেই  ট্রান্সফার করতো ফলে রেমিট্যান্স আরও বেশী হতো।
অনেক সময় টাকার মান বেড়ে যাওয়া অর্থনীতির উপকারে আসবে অনেক সময় টাকার মান কমে যাওয়া অর্থনীতির জন্য ক্ষতি করতে পারে ক্ষতিকর হতে পারে। কাজেই আপনি কারণটা থেকে আলাদা করে টাকার মান বৃদ্ধিটাকে মূল্যায়ন করাটা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হবে না।
টাকা পাচার বন্ধের ক্ষেএে-টাকা পাচারের মৌলিক জায়গায় আপনাকে হাত দিতে হবে।
আমার সাবেক এক ড্রাইভার গত তিন বছর ধরে সৌদি আরবে গেছে সে আমাকে টেলিফোন করে বলল যে স্যার আমি তো সবসময় ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠাতাম টাকা। এখন দেখছি যে, এক রিয়েলে আমি যদি ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠাই সেখানে আমাকে সাতাশ টাকা দেয় আর আমাকে হুন্ডি ওয়ালারা বাসায় এসে বলছে  ঊনত্রিশ টাকা প্রতি রিয়েলে দিবে  আর কিছু করতে হবে না। ব্যাংকে গেলে সেখানে সৌদিতে একটা ভ্যাটও কাটে। তাই যদিও আড়াই পার্সেন্ট প্রণোদনা হিসেবে করলেও সব মিলে হুন্ডিতে বেশি পায় সেক্ষেত্রে সে হুন্ডির পথে যাবে না কেন? এখানে হুন্ডির কারণ হচ্ছে, এক্সচেঞ্জ রেটের ডিফারেন্স।
হুন্ডি মার্কেটে যেই ডলারগুলো কিনছে যারা ডলারগুলো কিনছে এই চাহিদাটার উৎসটা কি? কেন কিনছে তারা এই ডলারগুলো। একটা হচ্ছে অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে আর দ্বিতীয় হচ্ছে যে ম্যানপাওয়ার এক্সপোর্টের জন্য। নাইনটি পারসেন্ট ভিসাটা কিনতে হয় মিডলম্যানদের কাছ থেকে। হুন্ডির ডলারটা কিনে ওখানে পে করতে হচ্ছে। এখানে পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা কঠিন। কানাডার বেগম পাড়া বলেন বা মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম বলেন বা সিঙ্গাপুরের শপিং সেন্টার বলেন সেখানেও যেই অর্থ চলে যাচ্ছে।
আর পাচারের কথা যদি বলি- অনেক সময় পকেটে করে টাকা ডলার মানুষ বাইরে নিয়ে যায় কিন্তু এর সমাধান কি এটা হবে যে আমরা এখন থেকে বলে দেব প্যান্টে পকেট রাখা যাবে না!  ডাইগোনোসিসটা ঠিক যে পকেটে করে টাকা যায়  কিন্তু আপনার চিকিৎসাটা কি ঠিক?  আমরা এখন বলছি যে মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে অনেক হুন্ডির টাকা লেনদেন হয় তার মানে এর উপরে  যদি নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দেন তাহলে কিন্তু ওটা পকেট বন্ধ করার সল্যুশনের মত হয়ে যাবে। গোড়ায় হাত দিতে হবে যে টাকা যারা পাচার করছে এরা কারা এদেরকে আপনার চিহ্নিত করে সেখানে যদি এটা ধরেন দূর্নীতির কারণে হয় তাহলে তো আপনার ঐ জায়গায় হাত দিতে হবে ঐ জায়গায় হাত দিতে যদি না পারেন কোন না কোনভাবেই এই টাকা বাইরে যাবেই।
জুলিয়া: ২০২৩ সালের অর্থনীতি নিয়ে শংকা আছে সবার। আপনি কি দেখছেন?
ড. জাহিদ: কি ধরনের শর্ত ঋণের সাথে আসছে এটা নির্ভর করে কোন ধরনের ঋণ আপনি নিচ্ছেন। ধরেন আপনি একটা প্রকল্প করতে চাচ্ছেন। আপনাকে হয় বিশ্বব্যাংক নয়তো এডিবির কাছে যেতে হবে। অন্যথায় যারা প্রকল্প সহায়তা দিয়ে থাকেন তাদের কাছে যেতেই হবে তবে তারা তখন জানতে চাইবে আপনি যেই প্রকল্প বা কাজের জন্য টাকাটা নিচ্ছেন ঐ কাজটা করে আপনি টাকাটা ফেরত দিতে পারবেন কি না। প্রকল্প নকশা ঠিক আছে কিনা, ওয়ার্ক প্লানটা ঠিক আছে কিনা, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট সময়মত নিয়োগ দেবেন কি না? প্রকিউরমেন্ট পলিসিও তারা দেখবে। তাদের ঋণ দেওয়ার সময় এটা নিশ্চিত করা দরকার যে ঋনটা ফেরত দিতে হবে। এই ঋণের কারণে যাতে ঐ সক্ষমতা তৈরি হয় তা নিশ্চিত করতে চাইবে।
শর্তবিহীন ঋণতো কেউ দিবেনা কখনো। আপনি ব্যাংকে  ঋণ চাইলেও বলবে, ঋণ দিয়ে আপনি করবেন কি? আগে বিস্তারিত ব্যালেন্স দেখান, ইনকাম স্টেটমেন্ট দেখান। বিশ্ব ব্যাংক থেকে যদি বাজেট সহায়তাও নিতে যান এগুলো কোনো প্রকল্পের বিপরীতে দেওয়া হয় না। দেয়া হয় পলিসি রিফর্মের ভিত্তিতে। এখন এই পলিসি রিফর্মকে আমি কি রিফর্ম বলবো না কনডিশনাল বলবো এটা ভাষার ব্যাপার। কিন্তু শর্ত একটা থাকবেই। আপনি নগদ সহায়তা চাচ্ছেন নগদ সহায়তা আমরা দিবো যদি আপনি নগদ সহায়তা পাওয়ার জন্য অর্থনীতিতে সংস্কারের জন্য যে সমস্ত খাতগুলো আছে সেখানে কিছু কাজ করেন। কারণ আপনিতো সহায়তা নিচ্ছেন একটা ফাইন্যান্সিং গ্যাপ মেটানোর জন্য অর্থ্যাৎ আপনার একটা অর্থায়নে ঘাটতি আছে। হয় বাজেটে নয়তো বহির্বানিজ্যে ঘাটতি আছে অথবা দুইটাতেই আছে। ঐ ঘাটতির কারণটাকে যদি আপনি এড্রেস না করেন তাহলেতো আপনি সাময়িক যে স্বস্তিতে আছেন সময়টা ফুরিয়ে গেলে আবার ঐ সমস্যা নিয়ে দ্বারস্থ হতে হবে ঋণদাতার কাছে। সেজন্যই সেখানে সংস্কারের বিষয়টা চলে আসে।
আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় যেটা দেখেছি- আপনি যেভাবে  বলেছেন এখানে সরকারকে অনেক রাজনৈতিক মূল্য দিতে হয়। সেটা নির্ভর করে ধরুন আপনি আর্থিক খাতে সংস্কারের কথা বললেন এবং সংস্কারের ক্ষেত্রে বললেন, নন পারফর্মিং লোন কমাতেই হবে। প্রভাবশালীদের কাছে যেগুলো ইচ্ছাকৃত  ঋণখেলাপী হয়ে আছে সেখান থেকে আদায় করতে হবে। সেখানে যদি আপনি কোনো শক্ত পদক্ষেপ নিতে চান তাহলেতো সেটার একটা রাজনৈতিক মূল্য দিতেই হবে। প্রশ্ন হলো যে, পলিসি মেকার হিসেবে আপনি কোনটাকে বেশি অগ্রাধিকার দেবেন? কারণ এই রাজনৈতিক মূল্যটাও আপনাকে ঘায়েল করতে পারে আবার আপনি যদি রিফর্মটা না করেন তাহলেতো অর্থায়নও পাবেন না তাই সমস্যাটাতো থেকেই যাচ্ছে। আবার অনেক সময় ঐ ধরনের কঠিন রিফর্মের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশ এটা করে থাকে যে  যেগুলো পলিটিক্যালি করা খুব কঠিন সেগুলোও এমন কন্ডিশনে  ঢুকিয়ে দিলাম। মানে অন্যের ঘারে বন্দুক রেখে গুলি করার মতো। এটাতো দেশের উপকারেই আসবে।
এক্ষেত্রে আইএমএফ বিশ্বব্যাংকও কিন্তু ঘারটা পেতে দিতে খুব একটা অরাজি তা না। তারা বলছে, যতদূর সম্ভব আপনি টার্গেট ঠিক মত হিট করেন এবং সমস্যাটার সমাধান হোক। তারপর বললেন, বিশ্বব্যাংক বলেছে আইএমএফ বলেছে এই সংস্কার করতে বাধ্য হয়েছি, না হলে হয়তো করতাম না। আসলে কৌশলের ব্যাপার- কাজেই আমার মনে হয় বিদেশী ঋণ এবং শর্ত-এগুলো দেশীয় স্বার্থের পক্ষে না বিপক্ষে সেটা মূল্যায়ন করাটা থেকে বেশি ফোকাস করা উচিৎ আমরা আসলে কী কাজটা করছি? এখানে সংস্কার কী, কে করাচ্ছে-এটা কী বিশ্বব্যাংক বলছে সেজন্য করছি না আমি স্বপ্রণোদিত হয়ে করছি। ইস্যু হচ্ছে, কাজটা করেছেন এবং ঐ কাজটা করলে আপনার কী উপকার হবে।
এখানে আমরা জানি না যে, এখানে কী শর্ত থাকবে? প্রোগ্রামে অনেক আলোচনা করেছে। তবে পরামর্শ দিয়ে গেছে বিভিন্ন ধরনের করনীতি কর প্রশাসন, সামাজিক সুরক্ষা খাত, মুদ্রানীতি ব্যবস্থাপনা, সরকারী ব্যয়- এইসব খাতে এই ব্যাংকিং সেক্টরে সংস্কারের কথা বলে গেছে। এরমধ্যে কোনগুলো প্রোগ্রামে থাকবে এটা আমরা এখনো জানি না। কিন্তু ট্যারিফ যৌক্তিককরণের কথাও থাকতে পারে বা ভ্যাট রেটের ক্ষেত্রে এতগুলো রেট কমিয়ে আনার কথা বলা হতে পারে বা এক্সামশনস রিবেটস অনেক ধরনের ছাড় দেয়া হচ্ছে। এগুলোর ফলে প্রচুর রাজস্ব লস হয় ঐ ছাড়গুলো কমানোর কথা বলা হতে পারে। আপনাকে ঐ বিষয়টা দেখতে হবে সংস্কারগুলো আসলে আমাদের জাতীয় স্বার্থে কতোটা কাজে দিবে।

জুলিয়া: ২০২৩ সালের অর্থনীতি নিয়ে শংকা আছে সবার। আপনি কি দেখছেন?
ড. জাহিদ: এখানে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এবং জাতিসংঘ আঙ্কটাড এবং আঞ্চলিক ব্যাংকগুলোর অনেক ধরণের প্রজেকশন রয়েছে। তবে সবার একটা কনসেনসাস হচ্ছে যে গ্রোথ ২০২৩-এ ২০২২ এর তুলনায় কমবে। বিশ্বমন্দার সংজ্ঞাটা হলো বিশ্বে মাথাপিছু আয় পার ক্যাপিটা জিডিপি যদি কমে যায় কোন এক বছরে সেটাকে বলা হয় মন্দা আর এটা যদি  না কমে এটার গ্রোথটা যদি কমে যায় সেটা গ্রোথের মন্দা কিন্তু বিশ্ব মন্দা না। কাজেই গ্লোবাল জিডিপি কমার কোন প্রজেকশন কিন্তু আমি এ পর্যন্ত দেখিনি, যেটা দেখেছি সেটা হচ্ছে ইউরোপের জিডিপি নেগেটিভ হয়ে যেতে পারে গ্রোথ নেগেটিভ হতে পারে। কাজেই যেহেতু ইউরোপেরএনার্জি সংকটটাই বড় ধরণের সংকট এবং ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ যেটার প্রধান কারণ আর অতিশীঘ্রই এর সুরাহা হবে সেরকম কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কাজেই এখানে গ্রোথ দূর্বল হবে। মূল্যস্ফীতির উচ্চতা এখন অতীত হয়ে গেছে এখন মূল্যস্ফীতি কমার দিকেই যাবে কিন্তু ২০২৩ এ যেই পর্যায়ে নামবে সেইটা স্বাভাবিক অবস্থার তুলনায়ও অনেক বেশী থাকবে। একই প্রজেকশন দেখা যাচ্ছে ডলারের ক্ষেত্রে যে ডলার এখন অতিমূল্যায়িত। ডলার দামটা কমতে বাধ্য ইদানিংকালে পেমেন্ট ডলারের দাম কিছুটা কমেছেও এবং আগামীতেও ডলারের দাম কমবে কিন্তু ঐ কোভিডের আগে যে একটা স্বাভাবিক পর্যায়ে রেট ছিল সেই পর্যায়ে হয়তো ২০২৩ এ আসবে না। ২০২৩ এর শেষের দিকে অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে পারে। মানে এটা কেটে যাওয়ার একটা প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে বিশেষ করে যুদ্ধে যদি একটা সুরাহা হয়ে যায়। আমাদের অর্থনীতির ক্ষেত্রেও দুশ্চিন্তার জায়গাটা হলো এক্সপোর্টের ক্ষেত্রে ইউরোপ যেহেতু আমাদের একটা বড় বাজার, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের একটা বড় বাজার। ইউরোপে মন্দা আসবে এটা নিয়ে বোধ হয় এখন অতটা অনিশ্চয়তা নাই। অনিশ্চয়তা যেটা আছে সেটা হচ্ছে এটা কতটা গভীর হতে পারে এবং কতটা দীর্ঘ হতে পারে। আমেরিকায় মন্দা আসবে কি আসবে না এটা নিয়ে কিন্তু এখনও অনিশ্চয়তা আছে কেননা প্রথম দিকে বলা হয়েছিল যে আমেরিকায় মন্দা আসতে যাচ্ছে কিন্তু গত প্রান্তিকে যেই ডেটা দেখা গেল সেটাতে দেখা যাচ্ছে জিডিপি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, কাজেই মন্দা হয়তো আসতে পারে হয়তো নাও আসতে পারে। আমেরিকায় যদি মন্দা আসে তাহলে আমাদের জন্য সেটা বড় দুঃসংবাদ কারণ একক দেশ হিসাবে সেটা আমাদের সবচাইতে বড় বাজার।
মন্দার কিন্তু আবার একটা আপসাইড রিস্কও আছে কারণ ধরেন যদি ইউরোপের মত অর্থনীতি একটা বড় ধরনের মন্দায় পড়ে যায় তাদের চাহিদা কমে যায় তারা বাজার থেকে যে পরিমাণে তেল গ্যাস এখন কিনছে বা ফার্টিলাইজার বা ইন্ডাষ্ট্রিয়াল র-ম্যাটারিয়ালস কিনছে তখন সে পরিমাণে কিনতে পারবে না তখন কমোডিটি প্রাইসেস যেটা উর্ধ্বগতি আমরা ২০২১ থেকে দেখতে পাচ্ছি সেইটা কিন্তু কমে যাওয়ার প্রবণতাও আরও শক্তিশালী হবে। আমাদের আমদানী ব্যয়ের চাপটা কমিয়ে দেবে কিন্তু আবার যদি রপ্তানীর উপর মন্দার একটা প্রভাব আসে তাইলে কিন্তু আয়-ব্যয় দুইটাই ঘটতে পারে। তো সেই ক্ষেত্রে আমাদের আবার অন্য আরেকটা জায়গা আছে যেহেতু অনেক নতুন কর্মী বিদেশে যাচ্ছে সেজন্য আমরা যদি এক্সচেঞ্জ ম্যানেজমেন্টটাকে ঠিক করতে পারি হুন্ডির বাজারের সাথে আমাদের ফরমাল রেইটের ডিফারেন্সটা কমিয়ে আনতে পারি মাল্টিপল রেট থেকে আমরা যদি বেড়িয়ে যেতে পারি তাহলে কিন্তু গড়ে আমাদের রেমিট্যান্স মাসে ২০০ কোটি ডলার বা তার বেশী না আসার কোন কারণ খুঁজে পাই না। কাজেই দুই দিক থেকেই ডাউনসাইড রিস্কটাই বেশী এখন। অনেকেই আবার ধরেন ইভেন আমাদের প্রধানমন্ত্রীও সতর্ক করেছেন যে এখানে দুর্ভিক্ষেরও একটা সম্ভাবনা আছে। তো দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনাটা আমি মনে করি এটা একটা টেইল রিস্কের মত মানে এটার সম্ভাবনা কম। কিন্তু যদি হয় তাহলে আপনার ক্ষতিটা অনেক বড় ধরণের হবে। সেই জন্য আগাম প্রস্তুতি দরকার সেখানে দুটো জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ- একটা হচ্ছে আপনার খাদ্য নিরাপত্তাটা নিশ্চিত করা তাই খাদ্য উৎপাদনের দিকে বেশী মনোযোগ দিতে হবে। আর ঐটা ঠিক রাখতে আপনার জ্বালানি নিরাপত্তাটাও গুরুত্বপূর্ণ।
জুলিয়া: আপনাকে ধন্যবাদ
ড. জাহিদ: আপনাকেও ধন্যবাদ