আঠারোশ শতকের একটা গ্রামোফোন উলটে-পালটে দেখছিলাম, পাশেই বেশ কিছু দুর্লভ রেকর্ডস, মাইকেল জ্যাকসন থেকে ম্যাডোনা, গানস অ্যান্ড রোজেস থেকে নুসরাত ফতেহ আলি খাঁ, কে নেই সেখানে। আসলে এখন আমি দাঁড়িয়ে আছি তাগুস নদীর পার ঘেষে ক্যাথেড্রালের পিছনে চোর বাজার বা ফ্লি মার্কেটে যার কেতাবি নাম ফিয়েরা দ্যা লাডারা।
গতকাল ঘুরে এসেছি লিসবন থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরবর্তী শহর সিন্ত্রা থেকে, সেই সাথে উপরি পাওনা হিসেবে ইউরোপের সর্বপশ্চিমের বিন্দু কাবো দ্য রোকা আর সমুদ্রপাড়ের ভ্যাকেশন সেন্টার কাসকাইস থেকে। সেই সৌন্দর্যের রেশ নিয়ে ঘুম ভেঙেছিল বেশ দেরিতেই। যথারীতি কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট সেরে ব্যাগ গুছিয়ে মামা আর খালুর জন্য ওয়েট করতে লাগলাম। আজ এ হোটেল থেকে চেকআউট করে আমি বাঙালিপাড়ার কাছে একটা পেনসিওতে উঠবো।
যথারীতি তাদের আসতে দেরি হয়ে গেল। তাদের সহায়াতয়ায় লাগেজ স্থানান্তর করে পাশের এক ক্যাফেতে নাতা আর কফি খেয়ে নিলাম। খালুকে জিজ্ঞেস করলাম আজকে কী প্ল্যান। খালু জানালো আমার জন্য একটা চমক আছে। খালুর ওপর আস্থা আছে, আর খালুও আমার টেস্টটা জানেন, তাই আর বেশি ব্যাক্যব্যায় না করে খালুকে ফলো করতে লাগলাম। কালকে বেশ অনেকটা হাটতে হয়েছে, পাহাড় বেয়েও উঠতে হয়েছে, তাই শুরুতেই খালু নিশ্চিত হয়ে নিলেন আজ হাঁটার মতো অবস্থা আছে কিনা। তাকে আশ্বস্ত করলাম।
লিসবনের সিগনেচার কিছু সিঁড়ি পাড়ি দিয়ে কাই সো দ্রে আর আলফামাকে পেছনে রেখে পাথর বিছানো পথ ধরে এগিয়ে চললাম। সামনেই দেখা যাচ্ছিল সোউ জর্জ ক্যাসেল আর সি ক্যাথেড্রাল। তবে খালু দেখি সেদিকে না গিয়ে আরো সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। সামনে এগিয়ে গিয়ে তো আমি লা জওয়াব। চলে এসছি চোর বাজার, ইয়ে মানে ফ্লি মার্কেট। চোর বাজার বললে কেমন কেমন শোনালেও আদতে এটি পুরাতন জিনিসপত্র বেচাকেনার স্থান। দিল্লির জামে মসজিদের পেছনে প্রতি শুক্রবারে বসে এই ধরনের বাজার যার নাম চোর বাজারি। তাই দুনিয়ার যেখানেই এই ধরনের পুরাতন জিনিসের বিকিকিনি হয়- তাই অনেকে চোর বাজার নাম দিয়ে ফেলে। আপনারা আবার আমাদের অনলাইন পুরাতন জিনিস বেচা কেনার হাট “রিসাইকেল বিন”কে চোর বাজার নাম দিয়ে ফেলেন না। সাও ভিনসেন্টে দ্যা ফোরা নামক চার্চের পেছনে ক্যাম্পো দ্য সান্টা ক্লারাতে প্রতি শনি আর মঙ্গলবারে বসে এই ফ্লি মার্কেট। এই মার্কেটের আদি ইতিহাস কিন্তু অনেক পুরানো। সেই ১২১২ সাল থেকে লিসবন নগরীর বিভিন্ন স্থানজুড়ে ছড়িয়ে ছিল এই ফ্লি মার্কেট। পরে এক জায়গায় করা হয়।
“ফিয়েরা দ্য লাদরা”র বাংলায় অনুবাদ করলে বলা যাবে “মহিলা চোরদের বাজার”। ঐতিহাসিকদেরমতে এই বাজার বহু পুরানো। ১২শ খ্রিস্টাব্দে এটার সূচনা। তবে “ফিয়েরা দ্য লাদরা” নামকরণ হয় ১৭শ খ্রিস্টাব্দে। কথিত আছে যে বছরের শেষ রাতে অন্তত কিছু একটা চুরি করতে না পারলে, সারা বছর রোজগারপাতি খারাপ যাবে- মহিলা চোরেদের জগতে এমন একটি প্রবাদ সেসময় খুবই চালু ছিল ।৩১ ডিসেম্বর রাত ছিল লিসবনের সব ধরনের চোরেদের হালখাতা করার রাত। মানে এই রাতটিতে কোথাও না কোথাও চুরি করে চোরেরা তাদের নতুন ‘চৌর্যাব্দ’ শুরু করতো । ডিসেম্বর জুড়ে সন্ধে থেকেই হরেক রকমের বাতির আলোয় ভেসে যায় লিসবন। সুতরাং সেই আলো আর জেগে থাকা অত মানুষের চোখ এড়িয়ে যে-চোর কোনও গেরস্তবাড়ি থেকে কিছু চুরি করে আনতে পারে, বোঝা যায়, সত্যিই সে ভাল বংশের চোর । আর এই ধারণাটি থেকেই সম্ভবত এই রাতে কিছু না কিছু চুরি করে মহিলা চোরেরা নতুন বছরের কর্মজীবন শুরু করতো। পরে বিক্রির জন্য নিয়ে আসতো এই খোলা বাজারে।কালের পরিক্রমায় এটা আজ পরিণত হয়েছে সাপ্তাহিক পুরোনো জিনিসের খোলা হাটে।
হোক না যতই বিশ্বায়ন, খোলাবাজার, সুপার মার্কেট, অনলাইন শপিং, ব্রেন্ডেড জিনিসের দিন। তবুও মানুষের পুরাতন জিনিসের প্রতি খুব আকর্ষণ। পুরোনো বইয়ের সোঁদা গন্ধে, কিংবা কোন এক পুরানো ছবির রঙের পোঁচে ডুবে যেতে সবারই মনে হয় খুব ভালো লাগে। এখানে মানুষের কাছে যেন অঢেল সময়। লন্ডনের মতো সময়ের আগে আগে অহেতুক দৌড়নোর চেষ্টা দেখি না। এক ধীর স্থির শান্তি বিরাজমান এই শহরের প্রানে, ছন্দে।শনিবার এখানে বাচ্চাদের ও চাকরিজীবীদের ছুটি থাকে। শুধু লিসবনে না গোটা ইউরোপজুড়ে শনিবার বা রোববার জায়গায় জায়গায় সারাদিনের হাট বসে। দিনটা যদি রৌদ্রদীপ্ত উজ্জ্বল হয়, ইউরোপিয়ান হাটের এই শান্ত বেচা কেনা, লেনদেন এক সুন্দর নিশিন্তির ছবি তুলে ধরে। আদতে ব্যাবহৃত জিনিসপত্রের বেচাকেনার স্থান হলেও জহুরীর চোখ থাকলে মিলে যেতে পারে অমূল্য রতন। ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম, বই, ম্যাগাজিন, ক্যাসেট প্লেয়ার, টিভি, সাইকেল, ফার্নিচার কি নেই সেখানে। আফ্রিকান মুখোশ, ছবি থেকে শুরু করে মরোক্কান নক্সা কাঁটা মাটির বাসন, ভারতবর্ষের শাড়ি, টুপি, ব্যাগ, জুতো, ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী সবই দেখি নিজের জায়গা করে নিয়েছে এই হাটে।
এক দোকানে কয়েকটা ম্যাগাজিনে চোখ আটকে গেল। প্লে বয় ম্যাগাজিনের নাম শুধু শুনেছি কিন্তু হাতে নিয়ে দেখা হয়নি। এখানে দেখি এক দোকানি পুরাতন প্লে বয়ের পসরা সাজিয়ে বসেছে। কিন্তু বিধি বাম, সাথে মুরব্বি থাকায় মনের দুঃখ মনেই চাপা দিয়ে সযতনে দোকানটা পাশ কাটিয়ে গেলাম। একটু সামনেই দেখি একটা দোকানে আর্মির জওয়ানদের ভিড়। উঁকি মেরে দেখি সেনাবাহিনীর ব্যবহারের বিভিন্ন জিনিস বিক্রি হচ্ছে সেখানে। এগুলো অবশ্য আনকোরা। একটা ব্যাগপ্যাক বেশ পছন্দ হয়ে যাওয়ায় আর দামের দিকে তাকালাম না। নিজের জন্য তো কিছুই কেনা হয় না। একটা ব্যাকপ্যাক অন্তত কিনি, এটলিস্ট ট্যুরের সময় কাজে দিবে।
সে ক্যাথেড্রালফ্লি মার্কেটের খুব কাছেই সে ক্যাথেড্রাল। তিন দিন আগে রাতের বেলায় ঘুরে গিয়েছিলাম। তবে আজ দিনের আলোয় আরেকবার ঘুরে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। ইউরোপের অন্যতম পুরাতন আর বিখ্যাত চার্চ বলে কথা। সেই খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ সাল থেকে, ফিনিশিয়ান, কার্থেজিয়ান, ভিসিগথ, আরব, ইহুদী এবং খ্রিস্টানদের হাত ধরে তাগুস নদীর ধারে গড়ে উঠেছিল যে শহর তার মূল ভিত্তি ছিল ক্যাসেল আর তার আশেপাশে নদীর কিনারা পর্যন্ত গড়ে উঠা ঘড়বাড়ি আর টেমপল। কালে কালে শহর আরো বিস্তৃত হয়েছে, কিন্তু শহরের মূল কেন্দ্র কিন্তু একই রকমই রয়ে গেছে। ১১৩৯ সালে যখন লিসবন প্রতিষ্ঠিত হয় তখনও কিন্তু আলফামা আর তার ক্যাসেলই ছিল এই শহরের প্রাণ।
সেই সময় লিসবন ছিল একটি আরব শহর। আরবদের শক্তিশালী দুর্গ আর তাকে ঘিরে গড়ে উঠা গোলকধাঁধাই ছিল আল-হাম-মা যা অপভ্রংশ হয়ে রূপ নিয়েছে আলফামায়। ১১৪৭ সালে যখন পর্তুগালের প্রথম রাজা ডম আলফানসো মুরিশ তথা মুসলমদের হটিয়ে দুর্গ জয় করেন, তখনি তিনি এখানে একটি মনুমেন্টাল ক্যাথেড্রাল নির্মানের আদেশ দেন। এই ক্যাথেড্রালের সামনেই আমরা এখন দাঁড়িয়ে, স্থানীয়দের কাছে যা সে ক্যাথেড্রাল নামে পরিচিত। পদুয়ায় স্থানতরের আগে এখানেই সেইন্ট এন্থনি অব লিসবনের ব্যাপটাইজেশন করা হয়েছিল ১১৯৫ সালে। ক্যাথেড্রালের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এঁকে যতটা না ক্যাথেড্রালের মত মনে হচ্ছিল, তার চাইতে বেশি মনে হচ্ছিল কোন দুর্ভেদ্য দুর্গের মত। দুইপাশে দুই বিশাল খিলানের মাঝে আর্চওয়ে আর তার উপরে গোলাকার বেলজিয়ান গ্লাসের নকশা করা রঙিন জানালা। ইচ্ছে ছিল ভিতরে ঢুকে একটু ঘুরে দেখার, কিন্তু বিধি বাম, বড্ড অসময়ে চলে এসেছি, এ সময় পার্থনার কারনে ভিতরে প্রবেশ নিষেধ। কি আর করা আমার মনের দুঃখ বুঝতে পেরে খালু প্রস্তাব দিলেন পার্কা দ্য কমাওর্সিওতে আরেকটা চার্চ ঘুরে দেখার- যার নাম চার্চ অব দ্য লেডি অফ কন্সেপশন।