প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যের জের ধরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘সিইসি হাস্যকর ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন।’
তিনি আরও বলেন, এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না।
আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
গতকাল প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে না এমন ঘোষণা দিয়েছে। এ বিষয়ে কথা বলতে নির্বাচন কমিশন বিএনপি নেতাদের ডেকেছে, সেখানেও আপনারা যাবেন না বলছেন। তিনি (সিইসি) আপনাদের সহযোগিতা করতে বলেছেন, আপনাদের মত কী—জানতে চাইলে ফখরুল বলেন, উনি এখন হাস্যকর ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন।
ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগ এবং নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে থাকে দেশের সব মানুষ আহাম্মক তাহলে তো হবে না। গত ১০ বছর ধরে প্রমাণিত হচ্ছে, দলীয় সরকারের অধীনে বিশেষ করে আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। এ কথা শামসুল হুদা সাহেব বলেছেন পরিষ্কার করে। হুদা সাহেব তিনিও চাকরি যাওয়ার পরে সেই কথা বলেছেন। আর ইনি (কাজী হাবিবুল আউয়াল) তো বলে দিচ্ছেন এটা সম্ভব না। কাল স্পেসিফিক করেছেন, বিএনপি নির্বাচনে না এলে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না। প্রশ্নটা তাহলে নির্বাচন কমিশনের কাছে নেই। এটা সরকারের কাছে। যারা পরিকল্পিতভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করেছে এবং যারা জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। তাদের সেই জায়গায় শক্ত করতে হবে, জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
বিদ্যুৎ নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত প্রসেঙ্গ ফখরুল বলেন, এখন যে বলা হয়েছে ৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকবে, এরাও পয়সা পাবে। বাকিগুলো পয়সা পেতে থাকবে। আমরা পত্রিকায় দেখেছি, তাদের জন্য বছরে ১ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা গুনতে হবে। এ থেকে দুটি জিনিস প্রমাণিত হয়—শুধুমাত্র দুর্নীতি করার জন্য কোনো বিশেষ কোম্পানিকে অর্থ বানানোর সুযোগ করে দিয়ে নিজেরা উপকৃত হওয়ার জন্য এই কাজটা তারা করেছে। আরেকটি হলো পরিকল্পনা অভাব। এটা সবচেয়ে বড় সমস্যা বাংলাদেশে এখন দেখা দিয়েছে। যেখানে নিজেরা কিছু পয়সা পাবে সেই কাজগুলো করা এবং যেটা প্রয়োজন সেই কাজগুলোর দিকে কোনো নজর না দেওয়া বা করতে না পারা; অযোগ্যতা বলা যেতে পারে। সবচেয়ে বড় সমস্যা বর্তমানে বাংলাদেশে সেটা হলো সুশাসনের অভাব। কারো কাছে কোনো জবাবদিহিতা নেই, কোথাও নেই। কোনো পর্যায়ে নেই।
এমনকি তারা এই বিদ্যুতের বিষয়ে ইনডেমনিটি দিয়েছে। কাউকে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। তারা টেন্ডার করে কিনবে, পাওয়ার প্ল্যান্ট আনবে, কী দামে কিনছে সেগুলোর কোনো বালাই নেই। শুধুমাত্র বিদ্যুতের ক্ষেত্রে না, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে তারা একইভাবে চুরি-দুর্নীতি করার জন্য, জনগণের পকেট থেকে টাকা কেটে নিয়ে সেই টাকা প্রদান করা হচ্ছে সেদিকে তাদের নজর নেই। ফলে আজকে যে সংকট তৈরি হয়েছে তার প্রধান কারণ দুর্নীতি। আমরা বারবার বলেছি, এমন কোনো প্রজেক্ট হাতে নেওয়া উচিত না যেটা আমরা চালাতে পারবো না। আমার ওই ধরনের জুতাই কেনা উচিত যে আমি পরতে পারবো। আজকে সেই ঘটনাটাই ঘটছে আর মূল্য দিতে হচ্ছে জনগণকে, বলেন তিনি।
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সরকারের নেওয়া উদ্যোগ প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে ফখরুল বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত নির্ভর করে গার্মেন্টস সেক্টরের ওপরে। সেই গার্মেন্টস সেক্টরের বিদ্যুৎ-জ্বালানির চাহিদা পূরণে সমস্যার তৈরি হবে, পরিবহনে সমস্যা হবে। বিদ্যুৎ-জ্বালানি অর্থনীতির সঙ্গে অতোপ্রতোভাবে জড়িত। সেখানে যখন র্যাশনাল সিস্টেম চালু করা হবে তখন উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট থাকবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটা টেম্পোরারি মেজার। এটা কাটাতে হলে স্থায়ী সমাধানে যেতে হবে, সেদিকে সরকার যাচ্ছে না। নির্বাচন আসছে চিন্তা করে তারা দাম বাড়াচ্ছে না কিন্তু অর্থনীতিতে প্রচণ্ড ক্ষতির সৃষ্টি হচ্ছে। পাওয়ার প্ল্যান্ট যেগুলো কাজ করছে না কিন্তু তাদের পয়সা দিতে হবে। সেভাবে একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে। অনেকগুলো আছে যাদের ফরেন এক্সচেঞ্জে পে করতে হয়। এটা সামগ্রিক সমস্যা।
এই সমস্যার সৃষ্টি হবে আমরা বহুকাল আগেই বলেছি। যেখানে সরকারের পরিকল্পনা নেই সঠিকভাবে এবং দুর্নীতি চরম পর্যায়ে রয়েছে। সব জায়গায় একটাই তাদের লক্ষ্য দুর্নীতি করা, এটাকে অস্বীকার করলে তো চলবে না। শ্রীলঙ্কা আজকে যে জায়গায় চলে গেছে, আপনারা দেখেছেন ৭টি দেশকে ওয়ার্নিং দেওয়া হচ্ছে যে শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। আগেও বলেছি, রিজার্ভের সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার ইমপোর্ট ডেভেলোপমেন্ট ফান্ডে তারা দিয়েছে। এই টাকাটা তাদের সেই সব লোকজন যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করছে দেশে-বিদেশে এবং তারা এই টাকাটা বিদেশে পাচার করেছে, বাড়ি-ঘর বানিয়েছে। দেশের মধ্যে সেই টাকা আর আসছে না। এটা শুরু। এর পরে দেখা যাবে; আমি না, অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে এই সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে। এখন সরকার চোখে সর্ষের ফুল দেখবে। দেখতে হবে এবং জনগণ ফুসে উঠছে, ফুসে উঠবে। তাদের পতন তরান্বিত করবে।
দলের স্থায়ী কমিটির সভার সিদ্ধান্ত তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, সম্প্রতি নড়াইল জেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের এক যুবকে দেওয়ার স্ট্যাটাসের কারণে হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকটি বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। বিএনপি মনে করে, এই ঘটনা সরকারবিরোধী জনরোষকে ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করার অপতৎপরতা। বর্তমান আওয়ামী লীগের অনির্বাচিত সরকারের উদ্দেশ্যমূলক নিষ্ক্রিয়তাই এই ধরনের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের কারণ। এই সরকারের আমলে একের পর এক বিভিন্ন ধর্মালম্বীদের, উপসনালয়, বসত বাড়ি ও ব্যবসা কেন্দ্রে পরিকল্পিত হামলা, জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার হীন চক্রান্ত। জনগণ যখন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, জ্বালানি তেল, গ্যাস ও পানির অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কারণে ফুসে উঠছে তখন সেই জনরোষকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার হীন অপচেষ্টা। বিএনপি অবিলম্বে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ ক্ষতিপূরণের দাবি জানাচ্ছে।
সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যের—’কেউ যদি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ায়; আপনাকে রাইফেল বা আরেকটি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়াতে হবে, আমরা সহিংসতা বন্ধ করতে পারবো না,’ বিষয়ে বিএনপি মনে করে, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বিএনপিসহ বিরোধী দলের নির্বাচন সম্পর্কে বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণিত হয়েছে। বিএনপি বরাবরই বলে আসছে যে, দলীয় সরকারের, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কখনই কোনো নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ, অবাধ, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারবে না। একমাত্র নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানই সংকট উত্তরণে একমাত্র পথ। নির্বাচন কমিশন সংহিসতা বন্ধ করতে না পারার অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে। প্রমাণিত হয়েছে এই সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন কতটা ক্ষমতাহীন। আর সেই কারণেই বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দল বর্তমান নির্বাচনকালে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানিয়ে আসছে।
এ সময় দলের পক্ষ থেকে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃক আবারও পানির দাম ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করায় তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানান ফখরুল। তিনি বলেন, এ নিয়ে গত ১৪ বছরে অন্তত ১৫ বার পানির দাম বাড়ানো হলো, অথচ ঢাকায় নাগরিকেরা শতকরা ৪০ ভাগও সুপেয় পানি পায় না।
সেই সঙ্গে ৫৩টি অত্যাবশকীয় ওষুধের মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে ক্ষোভ ও নিন্দা প্রকাশ করা হয়।