বিচ্ছুরিত আলোর ঝলকানি

 

 

 

এ যেন প্রজেক্টরে চলমান রিল হঠাৎ ছিন্ন হয়ে যাওয়ারই মতো। চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়ে, হাস্যময়ী–লাস্যময়ী অভিনেত্রী কবরী, চিত্র পরিচালক কবরী, সাংসদ কবরীর জীবনও হঠাৎ ছিন্ন হয়ে গেল করোনার কবলে পড়ে।

কবরীর (১৯৫০—২০২১) চলে যাওয়া মানে অনেক কিছু চলে যাওয়া। তিনি ছিলেন ইতিহাসেরও অংশ। চলচ্চিত্র, মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি, সমাজকল্যাণ, সাংস্কৃতিক সংগঠক—কত কিছুর সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

মনে পড়ে, তাঁর ইতিহাস সৃষ্টিকারী সুভাষ দত্তের সেই সুতরাং (১৯৬৪) ছবির কথা। কতই–বা বয়স তখন তাঁর। ১৩–১৪ বছর। সেই বয়সেই এই ছবিতে অভিনয় করে তিনি পাকিস্তানি-ভারতীয়-হলিউডি ছবির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জয় করেছিলেন দর্শক–হৃদয়। ছবিটি হয়েছিল সুপার–ডুপার হিট। ১ লাখের কিছু বেশি টাকা বাজেটের এই ছবি তখন আয় করেছিল ১০ লাখ টাকা। আর ফ্রাঙ্কফুর্ট চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি পেয়েছিল দ্বিতীয় সেরার পুরস্কার। বিলেতের রাজা-রানি সেই ছবিতে কবরীর অভিনয় দেখে আবেগে হয়েছিলেন আপ্লুত।

সুতরাং-এ কবরী অভিনীত চরিত্রটির নাম ছিল জরিনা। সে নায়ক জব্বারকে ভালোবাসত। উপহার দিয়েছিল ফ্রেমে বাঁধা নকশি করা রুমাল। তাতে লেখা ছিল:

‘ফুল ফুটে ঝরে যায়

দুনিয়ার রীতি

তুমি কিন্তু বন্ধু বটে

রেখো মোর স্মৃতি।’

কিন্তু দুজনের মিলন হয়নি। জরিনার বিয়ে হয় অন্যত্র। শেষ পর্যন্ত সে মারা যায় জব্বারের কাছে তার সদ্যপ্রসূত সন্তানকে রেখে। এ ছবিতে তাঁর সাবলীল, বাস্তবানুগ, আবেগঘন, রোমান্টিক ও বিষাদময় অভিনয় দর্শককে করেছিল বিমোহিত। ছবিতে জরিনা মারা গেলেও কিশোরী অভিনেত্রী কবরীর ভাগ্যে জুটেছিল বিজয়মুকুট। ফুলে ফুলে ভরে উঠেছিল তাঁর পথ। আর ঝলসে উঠেছিল নতুন সে অভিনয়শিল্পীর বিচ্ছুরিত আলোর মন্তাজ।

ষাটের দশকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশে বিভিন্ন ছবিতে কবরীর অভিনয় দর্শকদের মধ্যে সৃষ্টি করেছিল নতুন প্রত্যাশা। তিনি হয়ে উঠেছিলেন তাদের মানসকন্যা। রাজ্জাকের সঙ্গে জুটি বেঁধে তৈরি করেছিলেন নতুন রসায়ন। তাঁর হাসি–সংলাপ–প্রক্ষেপণ দর্শকেরা গ্রহণ করেছিল। গ্রামীণ, সাধারণ, মধ্যবিত্ত পরিবারের চরিত্রে তিনি ছিলেন অতুলনীয়।

সুতরাং–এর জরিনা, ময়নামতির ময়না, নীল আকাশের নীচের কলেজছাত্রী, সোয়ে নদীয়া জাগে পানির সার্কাস–কন্যা, বিনিময়–এর বোবা মেয়ে, রংবাজ-এর বস্তির মেয়ে চিনি, তিতাস একটি নদীর নাম-এর অনন্তের মা, বধূ বিদায়–এর নির্যাতিত বধূ, সুজন সখীর সখী, সারেং বউ–এর নবীতুন, দেবদাস–এর পার্বতী হিসেবে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আবহমান বাংলার রমণীর প্রতীক। দর্শকেরা তাঁর মধ্যে খুঁজে পেয়েছিল তাদের মানসীকে। এখানেই কবরী সার্থক, অতুলনীয়। কবরীর আরেকটি বড় ইমেজ গড়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। পরবর্তীকালে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে সাংসদও হয়েছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। জীবনের শেষ পর্যায়েও তিনি ছিলেন চলচ্চিত্র অনুদান কমিটির সদস্য।

 

একদা রুপালি পর্দার নায়িকা থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য হয়ে তিনি বাংলাদেশে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। এ সবই তাঁর অর্জন এবং শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কারণ।

এই শ্রদ্ধাঞ্জলি শেষ করতে চাই কবরীর শেষ ইচ্ছার কথা জানিয়ে। ১৯৭৬ সালের ১৯ মে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আপনাদের ভালোবাসা পাই…।’

হ্যাঁ, চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার মেয়ে পরবর্তী সময়ে কবরী হয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে অবদান রেখে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পেয়েছেন।