বিদেশে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ১ কোটিরও বেশি মানুষ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। প্রবাসী কর্মীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চাঙ্গাভাব সৃষ্টি করে রেখেছে অনেক দিন ধরে। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশসহ আমেরিকায় বাংলাদেশের অগণিত মানুষ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। জনশক্তি খাত থেকে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে বর্তমানে তা আরো কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব। কারণ বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের অদক্ষ, কারিগরি জ্ঞান না থাকা অশিক্ষিত কর্মীরা অন্য দেশের দক্ষ অভিজ্ঞ কারিগরি জ্ঞান জানা শিক্ষিত কর্মীদের তুলনায় অনেক কম বেতনে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। অদক্ষ, আধাদক্ষ কারিগরি জ্ঞান না থাকা শ্রমিক, কর্মীদের বেতন নিয়ে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ, মালিকের সঙ্গে দরকষাকষির সুযোগ থাকে না। তারা অন্য দেশের কারিগরি জ্ঞান থাকা শিক্ষিত দক্ষ শ্রমিক-কর্মীদের তুলনায় এক্ষেত্রে অনেক দুর্বল এবং অসুবিধাজনক অবস্থানে থাকেন। ফলে তারা উচ্চ হারে পারিশ্রমিক দাবি করতে পারে না। অনেকটা বাধ্য হয়ে তারা অপেক্ষাকৃত কম বেতনে সেখানে কাজ করেন। এ কারণে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক শ্রমবাজারে বাংলাদেশ এখনো অনেকটা পিছিয়ে আছে। ফলে বাংলাদেশ জনশক্তি রপ্তানি খাত থেকে প্রত্যাশা অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে ব্যর্থ হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ এখাত থেকে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারত। যদি কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তেমন উপযুক্ত কাজ নিয়ে বাংলাদেশের কর্মীরা বিদেশে যেতে পারে তাহলে প্রতিযোগিতামূলক শ্রমবাজারে অন্যান্য দেশের কর্মীদের টেক্কা দিতে পারবে। বাংলাদেশের কর্মীরা অনেক পরিশ্রম করেন বটে, কিন্তু কারিগরি শিক্ষা না থাকায় তাদেরকে অদক্ষ, আধা দক্ষ শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। তারা তাদের শ্রমের উপযুক্ত মূল্যও পাচ্ছে না বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। নিজেদের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতার কারণে তাদের স্বল্প বেতনে চাকরি করে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। উত্পাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন পক্ষসমূহের দক্ষতার ওপর উৎপাদনশীলতা নির্ভরশীল। উত্পাদনে নিয়োজিত বিভিন্ন পক্ষসমূহের দক্ষতার মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে না পারলে কোনো প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক দক্ষ হলেও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং গৃহীত কৌশলের ত্রুটিবিচ্যুতির কারণে দক্ষতার পুরো ব্যবহার সম্ভব হয় না।
যুগের পর যুগ ধরে এভাবে চলছে। এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশে চাকরি নিয়ে যাওয়ার আগে বিভিন্ন ধরনের কারিগরি শিক্ষা গ্রহণের ব্যাপারে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। এজন্য সরকার দেশব্যাপী কারিগরি শিক্ষালাভের জন্য অনেক ইনস্টিটিউট, ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছে। যেখানে মেকানিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল, সিভিল, অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কোর্স করার ব্যবস্থা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে স্বল্প খরচে নানা ধরনের কারিগরি বিষয়ে জ্ঞান লাভের মাধ্যমে নিজেদের দক্ষ, অভিজ্ঞ, কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মী হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে চাহিদাসম্পন্ন করে তোলা সম্ভব। আজকাল অনেকেই এ বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। ফলে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী তরুণ-তরুণীর সংখ্যা বাড়ছে। দেশেই হোক বিদেশেই হোক শ্রমবাজারে নিজের দাম বাড়াতে হলে কারিগরি শিক্ষা অর্জনকারী দক্ষ অভিজ্ঞ কর্মীরা বেশ ভালো এবং সুবিধাজনক অবস্থায় থাকেন। সরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও বিভিন্ন জেলা শহরে এমনকি উপজেলা পর্যায়েও কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আবার কোথাও কোথাও এনজিও কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত তেমনি কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের কারিগরি জ্ঞান এবং প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে অনেক বেকার তরুণ-তরুণী। এভাবেই নিজেদের প্রশিক্ষিত করে তারা দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করছে। শ্রমবাজারে তাদের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা মূল্যায়নের মাধ্যমে পারিশ্রমিক, বেতনের ব্যাপারে দরকষাকষির সুযোগ পাচ্ছে তারা। এভাবেই তারা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে।
আমাদের যে বিপুল জনসংখ্যা, তাকে জনশক্তি বা জনসম্পদে রূপান্তর করতে না পারলে জনসংখ্যার বিরাট বোঝার চাপে আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কাঠামো নানাভাবে বিপর্যন্ত হবে। দিনে দিনে ভয়াবহ সংকট আমাদের সামনে এসে দাঁড়াবে। সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা, অপরাধপ্রবণতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, মাদকাসক্তি প্রভৃতি অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বাড়তেই থাকবে। জনবহুল একটি দেশের বেশির ভাগ নারীপুরুষ যদি কর্মক্ষম এবং উপার্জনক্ষম হন তাহলে সে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি স্বাভাবিকভাবেই মজবুত হতে বাধ্য। আমাদের জনসংখ্যাকে আপদ না ভেবে জনশক্তিতে রূপান্তরের চেষ্টা চালাতে হবে। তখন তা জনসম্পদে পরিণত হবে। আমরা আমাদের জনসম্পদকে দেশের অভ্যন্তরে যেভাবে কাজে লাগাই না কেন, তা আমাদের জন্য সমৃদ্ধির নতুন বার্তা বয়ে আনবে।