শিল্প-কলকারখানায় কাজ করা শ্রমিকের জীবনের মূল্য এত কম? সরকারি বিধান অনুযায়ী মৃত্যুর পর নিহত শ্রমিকের পরিবারের ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তারা পান মাত্র ২ লাখ টাকা। বাকি ৩ লাখ টাকা কখনোই পান না। কেন এই ৩ লাখ টাকা তারা পান না? জানতে চাইলে বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, শ্রম আইনে বলা আছে, এক জন শ্রমিকের মৃত্যুর পর ইনসিওরেন্স কোম্পানি দেবে ২ লাখ, সরকার দেবে ২ লাখ এবং মালিক দেবে ১ লাখ টাকা। সরকারি ২ লাখ টাকা নিহত শ্রমিকদের পরিবার পেয়ে থাকে। বাকি ৩ লাখ টাকা তারা পান না।
ইনসিওরেন্সের বাধ্যবাধকতা থাকলেও অধিকাংশ কারখানা এটা করে না। ফলে ইনসিওরেন্সের টাকা শ্রমিকরা পান না। মালিকরাও তাদের যে ১ লাখ টাকা দেওয়ার কথা সেটাও দেন না। কোনো দুর্ঘটনার পর দু-এক দিন আলোচনা হয়, এরপর সবকিছু থেমে যায়। ফলে শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়টি অগোচরেই থেকে যায়। বাংলাদেশে পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানায় আগুনসহ যেসব ঘটনায় শ্রমিকরা মারা যান তাকে ‘দুর্ঘটনা’ বলতে রাজি নন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস)-এর পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, এসব ঘটনার অধিকাংশই ‘হত্যাকাণ্ড, ফৌজদারি অপরাধ’। কারণ, শ্রমিকরা যে পরিবেশে কাজ করেন এবং আগুন বা অন্য কোনো ঘটনায় যেভাবে মূল ফটকে তালা মারা থাকে, তা শ্রম আইনবিরোধী। সেক্ষেত্রে শ্রমিকদের আসলে হত্যা করা হয়। এই অবহেলাজনিত হত্যার ঘটনা প্রমাণ করতে পারলে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ আরো বেশি। কিন্তু কোনো মালিককে এখনো শাস্তি পেতে দেখা যায়নি।
রূপগঞ্জের হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায় আগুনে পুড়ে ৫২ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস ঐ প্রতিষ্ঠানে অবহেলার প্রমাণ পেয়েছে। ভবনটি তালাবদ্ধ ছিল। আগুন লাগার পরও তালা খোলা হয়নি। তারা ভবনে প্রয়োজনীয় অগ্নিনির্বাপণ-ব্যবস্থাও খুঁজে পায়নি। ছিল না আগুনের জন্য বিকল্প সিঁড়ি। তাই এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে অবহেলাজনিত হত্যা মামলা দায়ের করেছে। মামলায় প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানসহ আট জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা এখন রিমান্ডে আছেন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে অবহেলাজনিত হত্যার জন্য দণ্ডবিধির ৩০৪ ও ৩০৭ ধারায় তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে ১০ বছর। যেখানে ৩০২ ধারায় হত্যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
কোনো কারখানায় জরুরি বিকল্প সিঁড়ি না থাকলে ফায়ার সার্ভিসের অনুমতি দেওয়ার কোনো বিধান নেই। তারপরেও হাশেম ফুডের এই ফ্যাক্টরিতে ছিল ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন পত্র। কীভাবে অনুমোদন পেয়েছে এই কারখানা? এমন প্রশ্নের জবাবে ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক (রূপগঞ্জ) তানহারুল ইসলাম বলেন, আমরা পর্যাপ্ত ফায়ার সেফটির বিষয়ে প্রতিটি কারখানাকে নোটিশ করে থাকি। এই কারখানা কর্তৃপক্ষকে অনেক বার নোটিশ করা হয়েছিল। পরিবেশ অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জের উপপরিচালক মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেছেন, ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্স পাওয়ার পরেই তাদের সনদ দিয়েছি।
বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী যেসব কারখানায় কমপক্ষে ১০০ জন শ্রমিক আছেন সেখানে গ্রুপ বিমা থাকা বাধ্যতামূলক। তবে সব শ্রমিক এই বিমারা আওতায় আসেন না। এক জন শ্রমিক এখান থেকে সার্বোচ্চ ২ লাখ টাকা সুবিধা পান। কিন্তু ২০১৫ সালের পর অধিকাংশ শিল্পকারখানাই আর এই গ্রুপ বিমা করেনি বলে জানা গেছে। ফলে বিমার এই ক্ষতিপূরণের টাকা কখনোই পান না শ্রমিকরা। এগুলো কেউ দেখেও না।
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ আগুনে ১১২ জন গার্মেন্টস শ্রমিক মারা যান। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে মারা যান ১ হাজার ১৭৫ জন শ্রমিক। এর মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে অনেক দুর্ঘটনায় শ্রমিকরা প্রাণ হারিয়েছেন। সর্বশেষ রূপগঞ্জে মারা গেলেন ৫২ জন শ্রমিক। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের হিসাবে, বড় দুটি দুর্ঘটনার বাইরে ২০০৫ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক শ্রমিক শিল্পকারখানার দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।