বিশ্বজুড়ে নির্বাচন, কিন্তু গণতন্ত্রের দুর্দিন

বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি সংখ্যক লোক এ বছর নিজ নিজ দেশের জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেবে। একই বছর বিশ্বের এত দেশ এর আগে কখনও নির্বাচনে যায়নি। সেদিক থেকে বছরটি এক মাইলফলক হতে যাচ্ছে। দেশগুলোতে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোয় ভোটার উপস্থিতির ভিত্তিতে বলা যায়, এ বছর ৭০টিরও বেশি দেশে প্রায় ২০০ কোটি মানুষ নির্বাচনে অংশ নেবে। ব্রিটেন থেকে বাংলাদেশ, ভারত থেকে ইন্দোনেশিয়ায় এ ভোট হবে। গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের জন্য এ ঘটনা দারুণ একটি উৎসবের উপলক্ষ হতে পারে। তবে সে আশার গুড়ে বালি পড়বে বলে মনে হচ্ছে। কারণ গণতান্ত্রিক নির্বাচন বলতে যা বোঝায়, একটা বড় অংশ তার ধারেকাছে না থাকার আশঙ্কাই বেশি।

এমন আশঙ্কা প্রকাশও ভুল হবে না– এ বছর অনুষ্ঠেয় অনেক নির্বাচনের মাধ্যমে উদারনীতি পরিপন্থি শাসকরাই দেশগুলোতে শিকড় গেড়ে বসতে পারেন; অন্যান্য নির্বাচনে দুর্নীতিবাজ ও অযোগ্য লোকদেরই ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে। এমনকি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা যে নির্বাচনে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, সেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও হবে বিষাক্ত এবং জনগণের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টিকারী। নির্বাচনটিতে এসব নেতিবাচক বিষয় এতটাই প্রভাব বিস্তার করবে যে, এটি নিঃসন্দেহে বিশ্ব রাজনীতিকে ধাক্কা দেবে। এর ফলে সংঘাতে জর্জরিত ইউক্রেন থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো নিয়ে মার্কিন অবস্থানে পরিবর্তন আসতে পারে। এমনকি আমেরিকান নেতৃত্ব এতদিন যে বিশ্বব্যবস্থার পক্ষে ওকালতি করে এসেছে, সেটাও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। অর্থাৎ নতুন বছরে একদিকে স্নায়ুচাপ বাড়বে, আরেকদিকে হবে বিপজ্জনক।

কিছু নির্বাচন তো একেবারে বাজে হবে। উদাহরণস্বরূপ বেলারুশ বা রুয়ান্ডার কথা বলা যায়; যেখানে একমাত্র প্রশ্ন হলো, ক্ষমতাসীনদের প্রাপ্ত ভোট ১০০ শতাংশের কতটা কাছাকাছি হবে। বেলারুশে লুকাশেঙ্কো ১৯৯৪ সাল থেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশটির সর্বময় ক্ষমতা ভোগ করছেন। ২০০৪ সালে তিনি দুই মেয়াদের পর প্রেসিডেন্ট না থাকার সাংবিধানিক বিধানটি বাদ দেন; যদিও ২০২২ সালে আবারও বিধানটি সংবিধানে ফিরিয়ে আনা হয়, তা প্রযোজ্য শুধু নতুন কোনো প্রেসিডেন্টের জন্য।

রুয়ান্ডাতে পল কাগামে ২০০০ সাল থেকে প্রেসিডেন্ট পদে আসীন। সেখানে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ সাত বছর। সংবিধানে কারও দুই মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট থাকায় বাধা ছিল। কাগামে ২০১৫ সালে সে সাংবিধানিক বাধা অপসারণ করেন। এখন তিনি আরও এক দশক দেশটির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

রাশিয়াতেও আইন ছিল– কোনো ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। ২০২০ সালে প্রেসিডেন্টের মেয়াদের ওই সীমা অপসারণের জন্য ভ্লাদিমির পুতিন অবৈধভাবে সংবিধান পরিবর্তন করেন। এখন এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ভ্লাদিমির পুতিন এ বছর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে টানা তৃতীয় মেয়াদে (এবং সামগ্রিকভাবে পঞ্চমবারের মতো) অভিষিক্ত হবেন।

এ বছর বেশির ভাগ ব্যালট কাস্ট হবে এশিয়ায়। মহাদেশটির সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র– বাংলাদেশ, ভারত ও ইন্দোনেশিয়া– সবাই এ বছর নির্বাচনে যাচ্ছে। এখানেও দুর্ভাগ্যবশত উদারতাবাদের বিপদ ক্রমেই বাড়ছে। নরেন্দ্র মোদির অধীনে একদিকে ভারত উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক সাফল্য পেয়েছে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর মুসলিমবিরোধী উগ্র চিন্তা এবং গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠান গুঁড়িয়ে দেওয়া গুরুত্ব পাচ্ছে না ভারতীয়দের চোখে। ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডো একটি রাজবংশ প্রতিষ্ঠার দিকে মনোনিবেশ করেছেন বলে মনে হচ্ছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে কর্তৃত্ববাদের দিকে মোড় নিয়েছে। সেখানে বিরোধী নেতাদের কারাগারে বন্দি করা হয়েছে এবং কোনো ভিন্নমত সহ্য করা হয় না।

আফ্রিকা মহাদেশে এ বছর সবচেয়ে বেশি নির্বাচন হবে। কিন্তু সেখানকার ভোটাররা গণতন্ত্র কীভাবে কাজ করে, তা নিয়ে দিন দিন হতাশ হয়ে পড়ছে। সামরিক অভ্যুত্থান মহাদেশটিতে একটি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ২০২০ সাল থেকে ৯টি দেশে সেনা সরকার ক্ষমতা দখল করেছে। জনমত জরিপ বলছে, সামনের দিনগুলোতে আরও বহু আফ্রিকান দেশ সামরিক সরকারের অধীনে যেতে ইচ্ছুক হতে পারে। নতুন বছরে দক্ষিণ আফ্রিকায়ও জাতীয় নির্বাচন হবে। কিন্তু তা ধারাবাহিক হতাশারই স্মারক হবে বলে মনে হচ্ছে। বর্ণবাদ-পরবর্তী প্রথম নির্বাচনে সে আন্দোলনের প্রধান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস-এএনসি ক্ষমতায় আসে। ইতোমধ্যে তিন দশক পার হলেও সেখানে এএনসিই ক্ষমতায় আছে। তবে দেশটি এখন দুর্নীতি, অপরাধ এবং বেকারত্বের পঙ্কে নিমজ্জিত এবং আবারও সেখানে এএনসি ক্ষমতায় আসছে।

চারদিকে এত হতাশার মধ্যেও অবশ্য কিছু ভালো খবর আছে। ২০২৪ সালে মেক্সিকো তার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করতে যাচ্ছে। জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীই নারী এবং ক্ষমতাসীনদের চেয়ে কম পপুলিস্ট বা জনতুষ্টিবাদী। ব্রিটিশ ভোটাররা অবশেষে দুই যোগ্য প্রার্থীর মধ্যে একজনকে বেছে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। টানা ১৪ বছর টোরি তথা রক্ষণশীল শাসনের পর লেবার পার্টির জয়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে ব্রিটেনের বাইরে তেমন কেউ এ পরিবর্তন টের পাবে না।

এ বছর এমন কিছু দেশে নির্বাচন হচ্ছে, যাদের নির্বাচনের প্রভাব তাদের সীমানার বাইরের লোকেরাও টের পাবে। তাইওয়ানের ১ কোটি ৮০ লাখ ভোটার ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি এবং কুওমিনতাং (কেএমটি)-এর মধ্যে যাকে বেছে নিক, সেখানকার বিরোধী পক্ষ চীনবান্ধব হলে এর প্রভাব তাইওয়ান প্রণালির দুই পাড়ের সম্পর্কের ওপর পড়বে এবং ফলস্বরূপ মার্কিন-চীন উত্তেজনার মাত্রাও প্রভাবিত হবে। কেএমটির বিজয় স্বল্প মেয়াদে ওই অঞ্চলে সংঘর্ষের আশঙ্কা হয়তো কমাবে, কিন্তু মধ্য মেয়াদে তাইওয়ানের এই আত্মতুষ্টি একসময় চীনা অভিযানের ঝুঁকি বাড়াতে পারে এবং শেষমেশ তা বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে সংঘর্ষেরও সূত্রপাত ঘটাতে পারে।

তবে ভয়ংকর দৃশ্য বা সম্ভাব্য পরিণাম বিচারে মার্কিন নির্বাচনের সঙ্গে অন্য কোনো নির্বাচনের তুলনাই চলবে না। এটা বিশ্বাস করা কঠিন– নির্বাচনটি হতে যাচ্ছে দুই বৃদ্ধের মধ্যে, তাও ফিরতি ম্যাচের মতো, যাদের উভয়েই অধিকাংশ মার্কিন ভোটারের পছন্দের প্রার্থী নন। সিংহভাগ ভোটার চায় কোনো দলই এদের প্রার্থী না করুক।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রার্থিতা তো মার্কিন গণতন্ত্রের জন্য রীতিমতো অবমাননাকর। রিপাবলিকান পার্টি এমন একজন ব্যক্তিকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী করতে যাচ্ছে, যিনি বিগত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল উল্টে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এটা গণতন্ত্রের বাতিঘর হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ম্লান করে দেয়। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ যুক্তরাষ্ট্রকে এক বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতার পাগলাটে লোকের হাতে তুলে দেবে; এবং সেটাও এমন সময়ে যখন দেশটি গুরুতর ভূরাজনৈতিক বিপদের মধ্যে আছে। লৌহমানব, বিশেষত পুতিনের মতো লোকদের তিনি পছন্দ করেন। আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শেষ করার তাঁর ঘোষণাটি বাস্তবে ইউক্রেনকে বলি দিয়ে বাস্তবায়ন করারই ইঙ্গিত দেয়।

কারও কারও মতে, ট্রাম্প মনোনয়ন না-ও পেতে পারেন এবং মনোনীত হলেও তিনি হয়তো হেরে যাবেন। তবে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা আশঙ্কাজনকভাবে বেশি। গণতন্ত্র ও বিশ্বের জন্য এর পরিণতি হতে পারে বিপর্যয়কর।

জ্যানি মিন্টন বেডোস: প্রধান সম্পাদক, দি ইকোনমিস্ট; ভাষান্তর সাইফুর রহমান তপন