নাম তার মোবারক খলিফা। ফরিদপুর পৌরসভার ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং শহর শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক। বিতর্কিত সম্মেলনের মাধ্যমে শ্রমিক লীগের পদ পেয়ে সেটি আঁকড়ে আছেন। আগে থেকেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে পরিচিত খলিফা চরকমলাপুরের জনপ্রতিনিধি হয়েছিলেন। এবার জাতীয় নির্বাচনে ভোটের মাঠে ফরিদপুর-৩ আসনে নৌকার প্রার্থী শামীম হকের হয়ে ভয়ের রাজত্ব তৈরি করেছেন। অস্ত্র নিয়ে প্রতিপক্ষের কর্মী-সমর্থকদের কুপিয়ে জখম করছেন। অভিযোগ আছে, ফরিদপুরের বাইরে থেকেও দাগি সন্ত্রাসীদের ভাড়াটে হিসেবে এনে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির নকশা করছে একটি চক্র।
মঙ্গলবার মামুদপুরে সাত-আটটি মাইক্রোবাস ও ১০-১২টি মোটরসাইকেলে মহড়া দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী এ. কে. আজাদের পাঁচ সমর্থককে কুপিয়ে ও পিটিয়ে জখম করা হয়। মোবারক খলিফার নেতৃত্বে হামলাকারীদের হাতে ছিল রামদা, রড, জিআই পাইপ, হকিস্টিকসহ নানা দেশীয় অস্ত্র। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রেপ্তার এড়াতে গা-ঢাকা দিয়েছেন কাউন্সিলর খলিফা। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ। তাকে আইনের আওতায় আনতে দু’দিন ধরে একাধিক জায়গায় অভিযান চালানো হয়। তবে চতুর খলিফা অধরা। হামলায় আহতদের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, কাউন্সিলরকে দ্রুত গ্রেপ্তার করা না হলে ফের বড় ধরনের সহিংসতা ঘটাবেন তিনি। শুধু মোবারক খলিফা নন, ফরিদপুর সদর আসনে আরও অন্তত ১৩ জন ভোটের মাঠে আতঙ্ক সৃষ্টি করছেন। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য তাদের অনেকেই আগে থেকে এলাকার ত্রাস।
স্বতন্ত্র প্রার্থী এ. কে. আজাদের পক্ষ থেকেও অভিযোগ করা হয়, তাঁর নির্বাচনী এলাকার ভোটের পরিবেশ নষ্ট করছে চিহ্নিত কয়েক সন্ত্রাসী। ঈগল প্রতীকের ক্যাম্প ভাঙচুর করা হচ্ছে। একের পর এক হামলাও চালানো হচ্ছে। দ্রুত এই সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
এলাকা ঘুরে অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মোবারক খলিফা। তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান মনির বলেন, ‘মোবারক দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। তার রয়েছে নিজস্ব হিটার বাহিনী। এলাকায় তার কথা কেউ অমান্য করলেই মোটরসাইকেলে ছুটে যায় তারা। চালানো হয় হামলা। পৌরসভার কাউন্সিলর হওয়ার পর থেকে তিন বছরে এলাকার সালিশ-দরবার ও চাঁদাবাজি করে প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। তার সালিশ না মানলে নেমে আসে নির্যাতন। মাদক ও অবৈধ অস্ত্র কারবারিদের সঙ্গে গভীর নেটওয়ার্ক রয়েছে মোবারকের।’
মোবারকের মতো ভোটের মাঠে আরেক ত্রাস শহর যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক তরিকুল ইসলাম নাসিম। কমলাপুর ডিআইবি বটতলায় তার রাজত্ব। নাসিমের ক্ষমতার দাপট এতটাই, নিজ সংগঠনের শীর্ষ নেতারা তার হাত থেকে রক্ষা পাননি। ২০২০ সালের ১৬ মে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট সুবল সাহার বাড়িতে হামলা চালানো হয়। ওই ঘটনার অগ্রভাগে ছিলেন নাসিম। সেই ঘটনার পরপরই ফরিদপুরের রাজনীতি নাটকীয় মোড় নেয়। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশে চালানো হয় বিশেষ অভিযান। সেই অভিযানে জেলে যেতে হয় নাসিমকে। পরবর্তী সময়ে নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভাগ্যের চাকা খোলে তার। জামিনে বেরিয়ে আবার সেই আগের রূপে আবির্ভূত হন। ভিড়ে যান জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান শীর্ষ নেতৃত্বের ‘সিপাহসালার’ হিসেবে। ফরিদপুরের অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী হাতকাটা শাহীনের ছোট ভাই নাসিম। ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছিলেন শাহীন। ওই সময় নিজেকে বাঁচাতে ভাইয়ের বিরুদ্ধে করা মামলার বাদী হন তিনি। পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ শুরু করেন। দরপত্র নিয়ে বিরোধের জেরে ২০১৮ সালে হামলা চালান সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের সাবেক ভিপি তৌফিক হোসেন পুচ্চির ওপর। এ ছাড়া শহর আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট বদিউজ্জামান বাবুলকে কুপিয়ে আহত করে নাসিমের ‘হেলমেট বাহিনী’। এই বাহিনীর ভয়ে তটস্থ ফরিদপুর। টার্গেট করা ব্যক্তিদের ওপর হামলার নিশানা করা হলে তা বাস্তবায়ন করে হেলমেট বাহিনীর সদস্যরা। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নাসিমের হামলার শিকার তৌফিক হোসেন পুচ্চি বলেন, ‘ওই ঘটনায় মামলা হলেও আজও বিচার পাইনি। নাসিম এখন বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।’
ফরিদপুরের আরেক আতঙ্ক জহুরুল ইসলাম জনি। নৌকার প্রার্থীর পক্ষ হয়ে এলাকায় ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করছেন। ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের ম্যানেজ করে ছাত্রলীগ থেকে এক ধাপে বড় রাজনৈতিক পদ বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। এখন জনি জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি। এলাকাবাসীর ভাষ্য, কথায় কথায় লাইসেন্স করা অস্ত্র উঁচিয়ে ভয়ভীতি দেখানো তার ‘নেশা’। বছরখানেক আগে ফরিদপুর সদর উপজেলার শিবরামপুরে রেলের ইয়ার্ডে পাথর ব্যবসা দখলে নিতে অস্ত্র নিয়ে সাঙ্গোপাঙ্গসহ হামলা চালায় জনি। ওই এলাকার বাসিন্দা ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বিপুল ঘোষ বলেন, শিবরামপুরের ঘটনার পর বাদী হয়ে আমি মামলা করেছি। এর পর অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয় জনি। ওই মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি সে। চিহ্নিত সন্ত্রাসী জনির পেশা চাঁদাবাজি। রাজনীতি ওর তকমা। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড জায়েজ করতে তার রাজনৈতিক গডফাদাররা তাকে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি পদ উপহার দিয়েছে।
ভোটের মাঠে রাজত্ব কায়েম করেছেন পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের শোভারামপুরের ফাহাদ বিন ওয়াজেদ ফাইন। তপশিল ঘোষণার পরপরই ফাইন তার ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। এতে লেখেন– ‘কে কে জননেতা শামীম হকের বিজয়ে রক্ত দিতে, রক্ত নিতে সদা প্রস্তুত।’ ভোটের মাঠে ‘রক্ত’ নিয়ে এমন হুমকির পর স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষ থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসকের কাছে ফাইনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে।
এর আগে ফাইন কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম চৌধুরীকে কুপিয়ে আহত করেছেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের দীপক মজুমদারকে কুপিয়ে জখম করেন। এ ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি শওকত আলী জাহিদ বলেন, ‘ফাইনের মতো ব্যক্তিরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে আগেও স্বেচ্ছাসেবক লীগকে কলঙ্কিত করেছে। এখনও ধারা অব্যাহত রেখে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে চলেছে।’
স্থানীয়রা বলছেন, এর বাইরেও যারা সুষ্ঠু ভোটের মাঠে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, তাদের মধ্যে রয়েছেন গোলাম মো. নাছির। তিনি ১২ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে একাধিকবার পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। শহরের ওয়্যারলেসপাড়া তাঁর মূল ঘাঁটি। প্রায় এক দশক ধরে ফরিদপুর জেলা মোটর ওয়ার্কার্স ইউনিয়নকে জিম্মি করে রেখেছেন। বিনা ভোটে বহাল রেখেছেন নিজের সাধারণ সম্পাদকের পদ। এলাকাবাসীর ভাষ্য, ক্ষমতার বাঁকবদলের সঙ্গে নিজের রাজনৈতিক আদর্শ বদলে ফেলতে পটু নাছির। একসময় ছিলেন জাতীয় পার্টির ক্যাডার। এর পর ভিড়ে যান বিএনপিতে। পরে দল ত্যাগ করে আওয়ামী লীগের ওপর ভর করে নিজের প্রভাব বলয়কে বিস্তৃত করেন। ২০২০ সালে স্থানীয় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরও নাছির ফের রূপ বদলে ভেড়েন নতুন বলয়ে। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা বিপুল ঘোষ বলেন, ‘নাছির মাদক কারবারি ও সন্ত্রাসী। ফরিদপুরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে এই জনপদকে অশান্ত করে আসছে। এখন ভোটের মাঠেও নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে তার বাহিনী।’
এদিকে ঈশান গোপালপুরের ত্রাস ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম মজনু ভোটের মাঠে নৈরাজ্য তৈরি করে গা-ঢাকা দিয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর ধারাবাহিক হামলা চালিয়েছিল তার বাহিনী। এসব ঘটনায় মামলা-জিডি হলেও তাকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।
স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার সন্ত্রাসী তোফাজ্জল হোসেন সম্রাটকে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেছে পুলিশ। শুনানির জন্য আগামী ২ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেছেন আদালত। সম্রাট এখন কারাগারে।
ফরিদপুরের তিন থানার ওসিকে বদলি
ফরিদপুরের তিন থানার ওসিকে বদলির নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। গতকাল রাতে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের নির্বাচন প্রশাসন শাখার উপসচিব মিজানুর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠি থেকে এ তথ্য জানা গেছে। তারা হলেন– ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার ওসি শহিদুল ইসলাম, সদরপুর থানার ওসি মামুন আল রশিদ ও ভাঙ্গার ওসি এমএ জলিল। কোতোয়ালি থানা ফরিদপুর-৩ (সদর) সংসদীয় আসনভুক্ত। ভাঙ্গা ও সদরপুর সংসদীয় আসন ফরিদপুর-৪ এর অন্তর্গত।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিবের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নিম্নবর্ণিত ওসিদের অন্যত্র বদলিপূর্বক তদস্থলে অন্য জেলা থেকে পদায়ন করার জন্য নির্বাচন কমিশন সচিব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’