১৪ হাজার কোটি টাকা অর্থায়নে চীনের ‘না’

বাংলাদেশে ১৪ হাজার ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ের একটি প্রকল্পে অর্থায়ন করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে চীন। এ প্রকল্পের অধীনে জয়দেবপুর থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত ডুয়েলগেজ রেললাইন স্থাপনের কথা ছিল। বাংলাদেশের তরফে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য চীনের কাছে অনুরোধ জানানো হবে। তবে চীন শেষ পর্যন্ত অর্থায়ন করতে রাজি না হলে প্রয়োজনে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ এ প্রকল্পকে কেন্দ্র করে যমুনা নদীর উপর বঙ্গবন্ধু সেতুতে ডুয়েলগেজ রেলসেতুর কাজ শুরু হয়েছে। এ সেতুর দুদিকে ডুয়েলগেজ রেললাইন না থাকলে রেলসেতুটির কার্যকারিতা হারাবে। ফলে যমুনা নদীর দুই পারের বিনিয়োগ সম্ভাবনাও হোঁচট খেতে পারে- এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সফরকালে প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। ওই সময়ে চীনের আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগ। তখন জয়দেবপুর থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত ডুয়েলগেজ রেল প্রকল্পে অর্থায়ন করবে বলে চীন আগ্রহ প্রকাশ করে। এরপর সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ করে প্রকল্প প্রস্তাব জমা দেওয়ার পর এখন চীন বলছে তারা অর্থায়ন করবে না। চীনের ভাষ্য- প্রকল্পটিতে তারা এত বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করলেও তা উঠে আসবে না। তবে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন, এটি একটি সরকারি পর্যায়ের (জি-টু-জি) প্রকল্প। বাংলাদেশ সরকার জনস্বার্থে এ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রকল্পটির গ্যারান্টি সরকারই দিচ্ছে। ফলে চীনের বিনিয়োগের অর্থ উঠে না এলে বাংলাদেশ সরকার তা পরিশোধ করবে। এমন পরিস্থিতিতে চীনের প্রকল্পে অর্থায়ন না করার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। তাছাড়া, প্রকল্পটি জমা দেওয়ার আগে চীনের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেছে বাংলাদেশ। তখন চীন প্রকল্পের ব্যাপারে খুবই আগ্রহ দেখিয়েছে। ২০১৮ সালে সেসব আলোচনা শেষ করে প্রকল্প প্রস্তাব জমা দেওয়া হয়। বিশেষ করে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই), যার অধীনে বিশ্বব্যাপী বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ করছে চীন; হঠাৎ করে বাংলাদেশের এতবড় প্রকল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় ঢাকায় বেশ বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে।

জানতে চাইলে ঈশ্বরদী-জয়দেবপুর ডুয়েলগেজ রেল প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক গোলাম মোস্তাফা শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘চীন আমাদের জানিয়েছে যে, তাদের মূল্যায়নে প্রকল্পটি পাশ হয়নি। এটার অর্থ হলো, তারা এ প্রকল্পে অর্থায়ন করবে না। আমরা আবার চীনকে অনুরোধ করে চিঠি দেব। তারা যেন তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে। চীন একেবারেই অর্থায়ন করতে না চাইলে আমাদের বিকল্প অর্থায়ন খুঁজতে হবে। প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করতে অস্বীকার করার পর বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্পও নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন হতে পারে।’

চীন তাদের সরকারি ভাষ্যে উল্লেখ করেছে, প্রকল্পের আয় দিয়ে বাংলাদেশ ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না। তবে প্রকল্প পরিচালকের যুক্তি হলো, ‘গণসেবা খাতে ১০০ শতাংশ টাকা উঠে আসবে- এমন কোনো কথা নেই। এটা সরকার দেখবে। পাশাপাশি, চীন প্রকল্পে অর্থায়ন না করার জন্য আরও কিছু কারণ উল্লেখ করেছে। এগুলো সাধারণত ঠিকাদার কাজ শুরু করলে দেখা হয়। তারা এসব বিষয়ে আগাম সুরাহা চাইছে। আমরা অর্থায়ন করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে যে চিঠি লিখব সেখানে এসব বিষয় অবশ্যই উল্লেখ করব।’ তবে কী বিষয়ে আগাম নিশ্চয়তা চাইছে চীন তা প্রকল্প পরিচালক বিস্তারিতভাবে জানাননি।

জানতে চাইলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের যুগ্ম সচিব (এশিয়া) শাহরিয়ার কাদের চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘দর কষাকষির ক্ষেত্রে, অর্থায়ন যারা করেন কারিগরি কারণে তাদের অনেক প্রশ্ন থাকে। এখন রেল মন্ত্রণালয় এসব প্রশ্নের উত্তর সংবলিত চিঠি দেবে।’

চীন সরকারিভাবে যেসব কারিগরি দিক উল্লেখ করেছে; তার বাইরেও অন্য কারণ থাকতে পারে। কী কারণে দেশটি প্রকল্পটিতে অর্থায়ন করতে চাইছে না তা স্পষ্ট নয়। কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে কোনো জিটুজি প্রকল্পেই চীন নতুন করে অর্থায়ন করছে না। জিটুজি প্রকল্পে ঋণের সুদহার খুব কম। শর্ত খুব সহজ। তাই জিটুজি প্রকল্পের প্রতি এমন উদাসীনতা। কেউ কেউ মনে করেন, ভূ-রাজনৈতিক কারণে চীন প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহ হারিয়ে থাকতে পারে। কারণ যমুনায় রেলসেতুর কাজ করছে জাপানি সংস্থা জাইকা। চীনের সঙ্গে তাদের ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা রয়েছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে খুলনা ও রাজশাহী অঞ্চলে ব্রডগেজ এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে মিটারগেজ ট্রেন চলাচল করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডুয়েলগেজ লাইন রয়েছে; যেসব লাইন মূলত ব্রডগেজ হলেও মাঝখানে মিটারগেজ লাইন আছে। ডুয়েলগেজে দুই ধরনের ট্রেনই চলাচল করতে পারবে। যমুনা সেতুর উপর দিয়ে সিঙ্গেল লাইনে যেখানে দিনে ২২টি ট্রেন চলতে পারবে; সেখানে ডবল লাইন হলে সেখানে ট্রেন চলবে ৪০টি।

যমুনা নদীর উপর ডুয়েলগেজ রেললাইনের প্রকল্পের ওপর ভিত্তি করে সিরাজগঞ্জে ইকোনমিক জোন, বিসিক শিল্প নগরী এবং যমুনা নদীর তীরে স্পোর্টস সিটি গড়ে তোলার পরিকল্পনায় অনেকে বিনিয়োগ করতে চাইছেন। টাঙ্গাইলে আইটি সিটিতেও বিনিয়োগে রেল সংযোগ গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোনের পরিচালক শেখ মনোয়ার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ডুয়েলগেজ সংযোগ রেল সংযোগ না থাকলে যমুনা সেতুতে রেল কার্যকর হবে না। উত্তরাঞ্চলে বিনিয়োগে আগ্রহী অনেকে হতাশ হয়ে পড়বেন। কারণ জয়দেবপুর থেকে ট্রেনে এক ঘণ্টায় যমুনার তীরে পৌঁছা সম্ভব। ফলে চীনের বিনিয়োগে কিংবা বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে জয়দেবপুর ঈশ্বরদী ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণ করা জরুরি।