নির্বাচন কমিশন গঠনে সুবিধাভোগীদের বিবেচনার বাইরে রেখে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, সৎ-নিষ্ঠাবানদের নাম প্রস্তাব করতে অনুসন্ধান কমিটিকে পরামর্শ দিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। নতুন ইসিতে নারী, সংখ্যালঘু ও গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের রাখারও পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা। দাবি জানিয়েছেন কমিটির মনোনীত ১০ জনের নাম গণমাধ্যমে প্রকাশ করার।
গতকাল শনিবার সুপ্রিম কোর্টের কনফারেন্স কক্ষে বিশিষ্টজনদের নিয়ে বৈঠক করে অনুসন্ধান কমিটি।
সেখানেই আমন্ত্রিত শিক্ষক, আইনজীবী, সাংবাদিক, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী ও অধিকারকর্মীরা এ পরামর্শ দেন।
দুই দফা বৈঠকের পর গতকাল বিকেলে মন্ত্রিপরিষদসচিব আনোয়ারুল ইসলাম অনুসন্ধান কমিটির পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরেন সাংবাদিকদের কাছে। তিনি বলেন, ‘প্রায় তিন ঘণ্টায় দুটি বৈঠক হয়েছে। বিশিষ্টজনরা বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। সবারই বক্তব্য এমন একটা নির্বাচন কমিশন গঠন করা, যা সবার আস্থাভাজন হয়, ভালো একটা নির্বাচনের ব্যবস্থার জন্য তারা (নির্বাচন কমিশন) যেন পদক্ষেপ নিতে পারে। এটাই ছিল তাঁদের মূল বক্তব্য। ’
প্রথম বৈঠকে অংশ নেন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ হাসান আরিফ, ফিদা এম কামাল, সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব আলী ইমাম মজুমদার, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, মনসুরুল হক চৌধুরী, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, এম কে রহমান, শাহদীন মালিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান, একই বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) মাকসুদ কামাল, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক মাহফুজা খানম, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমিন মুরশিদ ও ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্সের প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান।
সকাল সোয়া ১১টায় শুরু হয়ে প্রথম বৈঠক চলে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত। দুপুর পৌনে ১টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকে যোগ দেন আজকের পত্রিকার সম্পাদক গোলাম রহমান, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান জাফরুল্লাহ চৌধুরী, জাগরণের সম্পাদক আবেদ খান, যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম, ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত, চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন, একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু, ইত্তেফাকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক তাসমিমা হোসেন, এনটিভির বার্তাপ্রধান জহিরুল আলম ও সাংবাদিক স্বদেশ রায়।
অনুসন্ধান কমিটির সভাপতি বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিটির সদস্য বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান, মহাহিসাব নিয়ন্ত্রক ও নিরীক্ষক (সিএজি) মুসলিম চৌধুরী, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হক উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক মাহফুজা খানম সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই অনুসন্ধান কমিটি যে ১০ জনের নাম প্রস্তাব করবে, তাঁদের চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হতে হবে—তাঁরা যেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ হন। যে পেশা থেকেই আসেন না কেন, তাঁদের স্বচ্ছ ব্যক্তি চরিত্র ও সততা থাকতে হবে। অর্থের মোহ যেন তাঁদের না থাকে। ’
এই অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে যে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে, তাতে দেশের গণতন্ত্র সুদৃঢ় হবে বলে মনে করেন তিনি।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘যদিও বিএনপি এবং আরো কিছু দলের কাছ থেকে নাম আসেনি, তাদের কাছ থেকে নাম পেতে আবার চেষ্টা করা উচিত। নির্বাচন কমিশনে যদি ভালো লোক না যায়, সাহসী লোক না যায়, তাহলে সরকার পরিবর্তন হবে না। এ জন্য কমিটিকে আবার চেষ্টা করে দেখতে বলেছি। লোকজন যদি ভোট দিতে না আসে, যদি নিরপেক্ষ নির্বাচন না হয়, তাহলে তো জাতির জন্য কঠিন সমস্যা সৃষ্টি হবে। সে কারণে এটা বলা আমাদের সবার দায়িত্ব। ’
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, ‘অনুসন্ধান কমিটি যাঁদের মনোনয়ন করবে তাঁরা যেন স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি হন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করেন। বৈঠকে যাঁরা ছিলেন তাঁরা সবাই আমার বক্তব্যকে সমর্থন করে অনুসন্ধান কমিটিকে অনুরোধ করেছেন, যাঁদের নাম প্রস্তাব করা হবে তাঁরা যেন সৎ, নিষ্ঠাবান ও যোগ্য হন। আর্থিক মোহ বা যেকোনো মোহের বাইরে থেকে যেন নির্বাচন কমিশন পরিচালনা করতে পারেন। ’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক আসিফ নজরুল বলেন, ‘যাঁরা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পাবেন, তাঁরা যেন আগের কোনো সরকারের আমলে বিশেষ সুবিধাভোগী না হন। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে, চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়ার মাধ্যমে, জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের মাধ্যমে কোনো কোনো সরকার তার বিশ্বস্ত লোকদের সুবিধা দিয়ে থাকে। এ ধরনের লোক যেন নির্বাচন কমিশনে না আসেন। অনেকে অবসরে যাওয়ার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তাঁরা যেন না আসেন। যাঁদের সঙ্গে সরকারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্ক আছে তাঁরা যেন না আসেন। ’
তিনি আরো বলেন, অনুসন্ধান কমিটির একটি বিরাট দায়িত্ব হচ্ছে এই নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা। জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা, যাতে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিত্বের সরকার কায়েম হয়।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘কোনো দলীয় সরকারের সময় সুবিধাভোগী কোনো ব্যক্তি যাতে নির্বাচন কমিশনে স্থান না পান, এ দাবি আমি জানিয়েছি এবং অনেকেই এ দাবি সমর্থন করেছেন। ’
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন। ব্যক্তি বাছাইয়ে অনুসন্ধান কমিটিকে বিষয়টি মাথায় রাখতে পরামর্শ দিয়েছি।
মনোনীত নাম প্রকাশ করতে হবে
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো যে নাম দিয়েছে সেগুলো প্রকাশ করার কথা বলেছি। বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো যদি বামপন্থী লোকদেরই নাম প্রস্তাব করে থাকে, জাতীয় পার্টি যদি দলের প্রতি সহানুভূতিশীল কারো নাম দিয়ে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে রাজনৈতিক দলগুলো সুষ্ঠু নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশন চায় না। কাজেই নাম প্রকাশ করলে আমরা বুঝতে পারব রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশ্য কী। একই সঙ্গে অনুসন্ধান কমিটি যে ১০ জনকে মনোনীত করবে, সেই নামও প্রকাশ করতে হবে। ’
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, সাংবাদিক প্রতিনিধিদের কমিশনে রাখতে হবে
একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবুও কমিটিকে গ্রহণযোগ্য একটি তালিকা প্রকাশের সুপারিশ করেছেন বলে সাংবাদিকদের জানান। এ ছাড়া সুধীসমাজ, সাংবাদিক, ধর্মীয়, জাতিগত সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের কমিশনে রাখার সুপারিশ করেছেন বলেও জানান তিনি।
তিন শতাধিক নামের প্রস্তাব
বিকেলে মন্ত্রিপরিষদসচিব আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, অনুসন্ধান কমিটি আজ রবিবার বিকেলে বিশিষ্টজনদের সঙ্গে আরো একটি বৈঠক করবে। এর পরে সুপারিশগুলো নিয়ে বসে কমিটি পরবর্তী কর্মপদ্ধতি ঠিক করবে। তিনি বলেন, আপনারা এরই মধ্যে জেনেছেন, অনুসন্ধান কমিটির কাছে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে ১৩৬ জনের, পেশাজীবীদের কাছ থেকে ৪০ জনের, ব্যক্তিগতভাবে ৩৪ জনের এবং ই-মেইলসহ বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আরো ৯৯ জনের নামের প্রস্তাব পাওয়া গেছে। এই নামগুলো নিয়ে কমিটি বসবে। কিভাবে বাছাই করা যায় সেই চিন্তা-ভাবনা করবে। ’