বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতিকে মানুষ পুড়িয়ে মারার রাজনীতি উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপি-জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল। ওদের রাজনীতি করার অধিকার এ দেশে নেই। ২০০১-০৫ সাল বিএনপি-জামায়াতের শাসন ছিল দেশের অন্ধকার যুগ। আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের শাসনে বাংলাদেশ এক বদলে যাওয়া বাংলাদেশ। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে নৌকায় ভোট দিয়ে বাংলাদেশকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবেন। এবার আমরা গড়ব স্মার্ট বাংলাদেশ।
গতকাল শুক্রবার বরিশাল নগরীর বঙ্গবন্ধু উদ্যানে বরিশাল জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিভাগের নির্বাচনী জনসভায় এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষায় নৌকায় ভোট দেওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করে শেখ হাসিনা বলেছেন, গত ১৫ বছরে দেশে যে উন্নয়নের ধারা সূচিত হয়েছে, তার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার জন্যই নৌকায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে হবে। কারণ, একমাত্র আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই দেশের উন্নয়ন হয়, দেশ এগিয়ে যায়। আওয়ামী লীগ মানে দেশের উন্নয়ন, মানুষের কল্যাণ ও দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী জনসভায় উপস্থিত লাখো মানুষের কাছে নৌকায় ভোট দেওয়ার অঙ্গীকার চাইলে জনতা দুই হাত তুলে তাঁর প্রতি সমর্থন জানান। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ দেশ ও জনগণের উন্নয়ন ও কল্যাণে বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই দেশের মানুষ শান্তিতে থাকে। এই নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েই মানুষ স্বাধীনতা পেয়েছে। এই নৌকায় ভোট দিয়েই আজকে দারিদ্র্য বিমোচন হয়েছে। এই নৌকায় ভোট দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ হয়েছে। এই নৌকায় ভোট দিলে স্মার্ট বাংলাদেশ হবে।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে দক্ষিণাঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, সেটা মাথায় রেখে ‘ডেলটা প্ল্যান-২১০০’ অর্থাৎ, ২১০০ সাল পর্যন্ত উন্নয়নের পরিকল্পনা আমরা করে দিয়েছি। এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে।
বিএনপি-জামায়াত জোটের বিষয়ে দেশবাসীকে সতর্ক করে আওয়ামী লীগ সভাপতি আরও বলেন, তারা ক্ষমতায় থাকলে দেশকে ধ্বংস করে। ক্ষমতায় থাকতে তারা জনগণের সম্পদ লুটপাট করেছে। দুর্নীতি, সন্ত্রাস, হত্যা, ধর্ষণ ও মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করা– এসব ছাড়া আর কিছুই তারা পারে না। তবে এ দেশে দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ সৃষ্টিকারী আর মানুষ পুড়িয়ে হত্যাকারীদের আর স্থান হবে না। বিএনপি-জামায়াত জোট বেঁধেছে। একটা দলের নেতৃত্বদানকারী চোরাকারবারি, অস্ত্র পাচারকারী, আরেকটা দল যুদ্ধাপরাধী।
দীর্ঘ প্রায় ছয় বছর পর প্রধানমন্ত্রীর বরিশাল আগমন ও জনসভাকে ঘিরে গোটা বিভাগে উৎসবমুখর পরিবেশের সূচনা হয়। দীর্ঘদিন পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানাকে কাছে পেয়ে মানুষের মধ্যে বিপুল উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনা দেখা গেছে। বরিশাল ছাড়াও পিরোজপুর, পটুয়াখালী, ভোলা, ঝালকাঠি, বরগুনা, মাদারীপুরসহ আশপাশের জেলাগুলো থেকে বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহন ও হেঁটে জনসভায় যোগ দেন দলীয় নেতাকর্মীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। বঙ্গবন্ধু উদ্যানকে জাতীয় পতাকা দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়। নৌকা প্রার্থীর সমর্থকরা ‘নৌকা নৌকা’ স্লোগান দিয়ে নেচে-গেয়ে জনসভাস্থলকে আনন্দমুখর করে তোলেন।
তবে সমর্থকদের নিয়ে জনসভার মাঠে আসেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও। বরিশাল-৪ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী পঙ্কজ নাথ বিশাল মিছিল নিয়ে মাঠে পৌঁছে মঞ্চে ওঠেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। বরিশাল নগরে বিভক্ত আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহিদ ফারুক শামীম এমপির সমর্থকরা কমলা রঙের এবং হলুদ রঙের টি-শার্ট ও ক্যাপ পরেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারীরা শক্তির জানান দেয়।
এর আগে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে প্রধানমন্ত্রী সড়কপথে ঢাকা থেকে বরিশালে পৌঁছান। বগুড়া সড়কে অক্সফোর্ড মিশনে ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত বাংলাদেশি নারী বীর মুক্তিযোদ্ধা লুসি হল্টকে দেখতে যান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা। পরে তারা সার্কিট হাউসে মধ্যাহ্নভোজ করেন। বিকেল ৩টা ৫ মিনিটে জনসভা মাঠে পৌঁছান আওয়ামী লীগ সভাপতি।
সমাবেশে ছোটবেলায় বরিশালে আসার স্মৃতি রোমন্থন করে প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতায় বলেন, বরিশালে আসতাম ছোটবেলা; তখন ঘোড়ার গাড়ি চলত। ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে ফুপুর বাড়িতে যেতাম। বলতে হতো কালীবাড়ি রোড সুধীর বাবুর বৈঠকখানায় যাব। এ সময় তিনি জনতার কাছে জানতে চান, বরিশালে কি উন্নতি হয়েছে? তখন উপস্থিত জনতা হাত তুলে সাড়া দেন।
বরিশালে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভোলার গ্যাস সিএনজি করে ঢাকায় নিচ্ছি। আবার ক্ষমতায় এলে ভবিষ্যতে বরিশালে এনে শিল্পকারখানা করার ব্যবস্থা করে দেব। বরিশালে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় করা হবে। আবার আমরা বরিশালকে শস্যভান্ডারে রূপান্তর করতে চাই, সুনাম ফেরাতে চাই। তার জন্য এ অঞ্চলে খাদ্য মজুত রাখার জন্য আমরা সাইলো নির্মাণ করে দিচ্ছি।
আপনাদের জন্য সুখবর আছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতু পেরিয়ে ভাঙ্গা থেকে পায়রা দিয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত ৬ লেনের সড়ক করে দেব। এরই মধ্যে জমি অধিগ্রহণ হয়ে গেছে। তৃতীয় সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে পুরো দক্ষিণাঞ্চলে ব্রডব্যান্ড এবং ওয়াইফাই কানেকশন যাতে হয়, সে ব্যবস্থা আগামীতে করে দেব। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। বরিশাল বিভাগ ছিল অন্ধকারে। আওয়ামী লীগ সরকার এসে আলো জ্বালিয়েছে।
বরিশাল বিভাগের ২১টি আসনের ১৮টি আসনে নৌকার প্রার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেন। বরিশাল-৫ (মহানগর-সদর) আসনের প্রার্থী জাহিদ ফারুককে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁকে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছিল। অত্যন্ত দক্ষতা ও সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সময় মাঠে উল্লাসে ফেটে পড়েন ফারুকের সমর্থকরা। সাবেক বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি সন্ত্রাসী দল ছেড়ে নৌকায় উঠেছেন, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছেন।
‘তারুণ্যের শক্তি বাংলাদেশের অগ্রগতি’ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, নতুন ভোটাররা নিশ্চয়ই চাইবেন না তাঁর জীবনের প্রথম ভোটটি বিফলে যাবে। আপনারা নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করবেন।
দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বক্তৃতার শুরুতেই বলেন, ‘খেলা হবে।’ এ সময় মাঠে উপস্থিত লাখো জনতাও উচ্চারণ করেন ‘খেলা হবে।’ তিনি বলেন, বিএনপি কোথায়? তারা ফাউল করে লাল কার্ড খেয়ে পালিয়ে গেছে। পল্টনের খাদে পড়ে গেছে। বিএনপির আন্দোলন ভুয়া। বিএনপির আগুন সন্ত্রাস শক্ত হাতে দমানো হবে।
সাবেক বিএনপি নেতা ঝালকাঠি-১ (রাজাপুর-কাঁঠালিয়া) আসনের প্রার্থী মোহাম্মদ শাহজাহান ওমর বক্তব্যে বলেন, আমি স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি। তাই আমি আওয়ামী লীগে যোগদান করেছি। আমি আওয়ামী লীগের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। আমাকে আপনারা গ্রহণ করুন।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। বক্তৃতা করেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু, অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন ও মেজর জেনারেল (অব.) হাফিজ মল্লিক, জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান ও জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক, বরিশাল সিটি মেয়র আবুল খায়ের আবদুল্লাহ, আওয়ামী লীগের দপ্তর সস্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ, যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ, আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের সদস্য বলরাম পোদ্দার, বরিশাল মহানগর সভাপতি এ কে এম জাহাঙ্গীর ও সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ প্রমুখ। সমাবেশ পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন ও বরিশাল জেলা সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস।