নতুন আক্রান্তদের ৮০ শতাংশই ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট

দেশে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর পাশাপাশি ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ এবং রাজধানী ঢাকাতেও ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআর এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আইদেশি মিলে মধ্য মে থেকে যেসব করোনা ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স করেছে, তার ৮০ শতাংশেই মিলেছে এ ভাইরাসের ভারতে পাওয়া ধরনটি, যার নাম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দিয়েছে ‘ডেলটা’।

বাংলাদেশে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কমিউনিটি সংক্রমণ বিদ্যমান বলে দাবি করেছে আইডিসিআর। এটা দেশের জন্য অশনি সংকেত উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে ব্যাপকভিত্তিক টিকাদান কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন। কিন্তু দেশে টিকা নেই। চীনের টিকা আসবে কিনা সেটাও অনিশ্চিত। কারণ শ্রীলংকায় চীনা টিকার মূল্য রাখা হচ্ছে ১৫ ডলার। বাংলাদেশে দেওয়া হচ্ছে ১০ ডলারে। বিষয়টি জানাজানি হয়ে যাওয়ায় টিকা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। এই অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোন বিকল্প নেই। নইলে সামনে ভয়াবহ বিপদ।

ইতিমধ্যে রাজধানী ঢাকাতেও করোনা ভাইরাসের অতি সংক্রামক ওই ধরনটি পাওয়া গেছে। আক্রান্তদের ইতিহাস পর্যালোচনা করে আইইডিসিআর মনে করছে, ইতিমধ্যে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের ‘ডেলটা’ ধরনটির সামাজিক বিস্তার বা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ঘটেছে, যা উদ্বেগজনক। গত দেড় বছর ধরে বিশ্বজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে যাওয়া করোনা ভাইরাস রূপ বদলাচ্ছে ক্রমাগত। ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশে এর বেশ কয়েকটি ‘মিউট্যান্ট’ বা পরিবর্তিত ধরন পাওয়া গেছে, যেগুলো অনেক বেশি সংক্রামক। এর মধ্যে ভারতে গত বছরের শেষ দিকে একটি নতুন ধরন শনাক্ত হয়, যাকে এ বছর দেশটিতে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে রেকর্ড সংক্রমণ ও মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করা ভাইরাসের এ ধরনটির আনুষ্ঠানিক নাম বি.১.৬১৭। তবে আলোচনার সুবিধার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে বলছে ‘ডেলটা’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে এ ধরনটিকে ‘ভ্যারিয়েন্টস অব কনসার্ন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

ভারত থেকে আসা তিন বাংলাদেশির দেহে করোনা ভাইরাসের এই ভ্যারিয়েন্ট শনাক্তের কথা গত ৮ মে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছিল। এরপর গত ১৬ মে থেকে এ পর্যন্ত মোট ৫০টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স করেছে আইইডিসিআর এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আইদেশি। আইইডিসিআর জানিয়েছে, জিন বিন্যাস বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব নমুনার মধ্যে ৪০টি ছিল ভারতে পাওয়া ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট, যা মোট নমুনার ৮০ শতাংশ। এছাড়া আটটি বেটা ভ্যারিয়েন্ট (সাউথ আফ্রিকায় পাওয়া ধরন, বি.১.৩৫১), একটি সার্কুলেটিং স্ট্রেইন এবং একটি আনআইডেন্টিফাইড ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.১.৩১৮) পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর। এসব নমুনার মধ্যে চারটি সংগ্রহ করা হয়েছিল ঢাকায় আক্রান্ত রোগীদের নমুনা থেকে। জিনোম সিকোয়েন্সে তার মধ্যে দুটি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। এছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলায় আসা ৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ওই ভ্যারিয়েন্টটি পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ভিজিল্যান্স টিম গঠন করে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে। এসি রুমে বসে বিবৃতি না দিয়ে কিভাবে জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে বাধ্য করা যায় সেই কার্যক্রম চালাতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নামজুল ইসলাম বলেন, আগের মতো স্বাস্থ্যবিধি পালনে আর অবহেলা করার সুযোগ নেই। সবারই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এক্ষেত্রে সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। নইলে সামনে পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ। মুগদা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে ভ্যাকসিন প্রয়োজন। আমেরিকায় টিকা প্রয়োগ করে নিয়ন্ত্রণে এনেছে। ভারতও সফল হওয়ার পথে। বাংলাদেশ চিনা টিকা পাবে কিনা সন্দেহ আছে। তাই সবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

আইইডিসিআর বলেছে, এখন পর্যন্ত যাদের মধ্যে শরীরে করোনা ভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে, তাদের ৩৫ শতাংশেরই বাংলাদেশের বাইরে ভ্রমণ বা বিদেশ থেকে আসা কারও সংস্পর্শে যাওয়ার ইতিহাস মেলেনি। এ কারণে বাংলাদেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে বলে আইইডিসিআর মনে করছে। আইইডিসিআর বলছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে সংগ্রহ করা ১৬টি নমুনার মধ্যে ১৫টি এবং গোপালগঞ্জ থেকে সংগ্রহ করা সাতটি নমুনার সবকটিই ছিল ডেল্টা। ভারত থেকে আসা তিনজন বাংলাদেশি নাগরিক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে খুলনায় ও চুয়াডাঙ্গায় চিকিত্সা নিচ্ছেন। তারা দেশের অন্য জেলার বাসিন্দা, তাদের নমুনাতেও করোনা ভাইরাসের ওই ধরনটি মিলেছে। রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে ভারত সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ গত কিছুদিন ধরেই উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এ অবস্থায় এই ভ্যারিয়েন্টের বিস্তার রোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে সবাইকে অনুরোধ করেছে আইইডিসিআর।

দেশে শনাক্ত হওয়া করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট রোগীদের মধ্যে তিনজনের (৭ শতাংশের) বয়স অনূর্ধ্ব ১০ বছর, সাতজনের (১৮ শতাংশের) বয়স ১০-২০ বছর , ১০ জনের ( ২৫ শতাংশের ) বয়স ২১-৩০ বছর, আটজনের (২০ শতাংশের ) বয়স ৩১-৪০ বছর, আটজনের (২০ শতাংশের ) বয়স ৪১-৫০ বছর এবং চারজনের (১০ শতাংশের) বয়স ৫০ বছরের ঊর্ধ্বে। তাদের মধ্যে ২৪ জন (৬০ শতাংশ ) রোগী পুরুষ। সংক্রমণের হার রোধ করার লক্ষ্যে দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টসহ অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের বিস্তার রোধে আইইডিসিআর সবাইকে সঠিকভাবে মাস্ক ব্যবহারের পাশাপাশি অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি (যেমন- বিনা প্রয়োাজনে ভ্রমণ থেকে বিরত থাকা, জনসমাগম এলাকা এড়িয়ে চলা, অন্যদের থেকে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করা ও নিয়মিত সাবান পানি দিয়ে হাত ধৌত করা ইত্যাদি) মেনে চলার জন্য অনুরোধ করেছে।

এদিকে দেশে গত এক দিনে আরও ১ হাজার ৮৮৭ জনের মধ্যে করোনা ভাইরাসে সংক্রমণ ধরা পড়েছে, আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে আরও ৩৪ জনের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় নতুন আক্রান্তদের নিয়ে দেশে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে ৮ লাখ ৭ হাজার ৮৬৭ জন হয়েছে। আর করোনাভাইরাসে মৃতের মোট সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১২ হাজার ৭৫৮ জন। সরকারি হিসাবে, আক্রান্তদের মধ্যে একদিনে আরও ১ হাজার ৭২৩ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তাদের নিয়ে মোট সুস্থ হয়েছেন ৭ লাখ ৪৭ হাজার ৭৫৮ জন।