দক্ষিণ তুরস্কের একটি ভবনের ধ্বংসস্তূপে ভাঙা জানালার প্রজাপতি আঁকা পর্দায় খেলা করছে শীতের বাতাস। এটিই সেঈদার ঘর। ভূমিকম্পের আগে ১৯ বছরের সেঈদা ওসান পর্দা সরিয়ে এই জানালা দিয়েই ইসকেন্দেরুন শহরের রাস্তায় তাকাতেন। এখন সেই রাস্তায় পরিবার নিয়ে অবস্থান করছেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী দালমা। তাঁর প্রার্থনা, সেঈদাকে যেন জীবিত উদ্ধার করা হয়! উদ্ধারকর্মীরা ভবনের ইট-সুড়কি সরাচ্ছেন; জীবিতদের সন্ধানে ঘ্রাণ নিচ্ছে কুকুর।
দালমার বয়স যখন ছয়, তখন প্রতিবেশী আট বছরের সেঈদার সঙ্গে তাঁর পরিচয়। তখন থেকে তাঁরা ঘনিষ্ঠ। একে অন্যকে ছাড়া তাঁদের চলে না। কত আড্ডা কত গল্প! সম্প্রতি দু’জন মিলে দোকান থেকে জানালার ওই প্রজাপতি আঁকা পর্দা কিনেছেন। দালমা ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমরা দু’জনেই প্রজাপতি খুব পছন্দ করি।’ মোবাইলে ছবি দেখিয়ে দালমা বিবিসিকে জানান কীভাবে সেঈদার সঙ্গে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আনন্দ করেছিলেন। আবারও তাঁর জন্মদিন আসবে, কিন্তু সেখানে সেঈদা থাকবেন না!
গত সোমবারের ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে সেঈদার অ্যাপার্টমেন্ট ভবনটি ধুলোয় মিশে গেছে। ভবনে আরও ১৪টি ফ্ল্যাটে পরিবারের বাস ছিল। তাদের মধ্যে থেকে সব মিলিয়ে তিনজনকে উদ্ধার করা গেছে।
এ চিত্র তুরস্ক ও সিরিয়ার হাজার হাজার আবাসিক ভবনের। সরকারের তথ্য অনুযায়ী, কেবল তুরস্কেই ১২ হাজার ১৪১টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ছয় হাজার ভবন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। এসব ভবনের ভেতরে প্রাণের স্পন্দনের আশা একেবারেই ক্ষীণ। উদ্ধারকারীরা মৃতদেহের গন্ধ পাচ্ছেন। তুরস্কের কাহরামানমারাস শহর থেকে আলজাজিরার প্রতিবেদক রেসুল সরদার জানান, সেখানে বাতাসে লাশের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, তাঁরা সর্বত্র লাশের গন্ধ পাচ্ছেন। কয়েকজনের মৃতদেহ বের করতে দেখেছেন। এখনও বহু মানুষ নিখোঁজ। এরইমধ্যে মৃত্যু ২৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। কেবল তুরস্কেই মারা গেছেন ২১ হাজার ৪৪৮ জন। সিরিয়ায় মৃত্যু সাড়ে তিন হাজারের বেশি।
ভূমিকম্পে বিপুল সংখ্যক ভবন ধসে পড়ায় এগুলোর নির্মাণে ত্রুটি রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দুর্গত এলাকার কোথাও একটি ভবন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলেও আরেকটি পুরোপুরি ধসে পড়তে দেখা গেছে। স্থানীয় গণমাধ্যম জানায়, এ প্রেক্ষাপটে শনিবার তুরস্কের পুলিশ ভবন নির্মাণসংশ্নিষ্ট ১২ জনকে আটক করেছে। গাজিয়ান্তেপ ও স্যানলিউফা শহর থেকে তাঁদের আটক করা হয়।
এসবের মধ্যেও আছে বিস্ময়। গতকাল শনিবার ষষ্ঠ দিনে ধ্বংসস্তূপ থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছেন অন্তত ৬৫ জন। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল গাজিয়ান্তেপ প্রদেশের নুরদাগ শহরে একটি পরিবারের পাঁচ সদস্যকে উদ্ধার করা হয়। এএফপি জানায়, ভূমিকম্পের ১২৩ ঘণ্টা পর হাতায় শহরে দুই বছরের একটি মেয়েকে উদ্ধার করা হয়েছে। কাহরামানমারাসে উদ্ধার হয়েছেন ৭০ বছরের মেনেকসে তাবেক।
তুরস্কে উদ্ধার ও সহায়তায় অংশ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানিসহ বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশ। তবে সে তুলনায় অনেকটাই উপেক্ষিত সিরিয়া। বিশেষ করে দেশটির বিদ্রোহী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে উদ্ধারকাজ সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। উদ্ধার হওয়া লোকজনও যথাযথভাবে ত্রাণ পাচ্ছেন না। এরই মধ্যে জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ত্রাণ পাঠিয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, ভূমিকম্পের কারণে সিরিয়ায় ৫০ লাখের বেশি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়তে পারে। সিরিয়ায় সংস্থাটির শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) প্রতিনিধি বলেন, গৃহহীন হয়ে পড়া লোকের সংখ্যা ৫৩ লাখের মতো।
সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সানা জানিয়েছে, ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি ও মানবিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে শনিবার সিরিয়ার আলেপ্পোয় পৌঁছান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রস আদানম গ্যাব্রিয়াসুস। সিরিয়ার বাশার আল আসাদ সরকারের অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে ত্রাণ পৌঁছে যাচ্ছে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোতেও।
ভূমিকম্পে ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি চাপের মুখে ফেলেছে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে। এরই মধ্যে তিনি ভূমিকম্পের পর দ্রুততম সময়ে সাড়া দিতে না পারার কথা স্বীকার করেছেন। অভিযোগ উঠেছে, ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড অনুসরণ করা হয়নি। তুরস্কের অন্যতম প্রধান ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী মুস্তাফা এরদিক বলেন, নির্মাণে অদক্ষতার কারণে এত ভবন ভেঙে পড়েছে। আলজাজিরা জানায়, গতকাল এরদোয়ান ক্ষতিগ্রস্ত শহরগুলো দ্রুত পুনরায় সংস্কার করার দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা ব্যক্ত করেছেন।
ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে যখন নানা প্রশ্ন উঠছে, তখন তুরস্কের দুর্যোগ মোকাবিলা কর্তৃপক্ষ এএফএডি গতকাল জানায়, ভূকম্পন প্রায় দুই মিনিট ধরে চলে। মূলত দীর্ঘক্ষণ ধরে এ ভূকম্পনের ফলে এত বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে হওয়া প্রথম ভূকম্পনটি (কেন্দ্র গাজিয়ান্তেপ) স্থায়ী হয়েছিল ৬৫ সেকেন্ড। এর কয়েক ঘণ্টা পর আরেকটি ভূমিকম্প হয়। ৭ দশমিক ৬ মাত্রার ওই ভূমিকম্প স্থায়ী হয় ৪৫ সেকেন্ড। পাশাপাশি সময়ে দুটি শক্তিশালী ভূমিকম্পের কারণে ক্ষয়ক্ষতি হয় ব্যাপক। এএফএডি জানায়, ভূমিকম্প ১১০ স্কয়ার কিলোমিটার এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। সরাসরি আক্রান্ত হয়েছেন ১ কোটি ৩৫ লাখ মানুষ। বর্তমানে ১ হাজার ৩০০টি উদ্ধারকারী দল কাজ করছে।