বিশ্ব ইতিহাসে মুসলমানদের অবদান অপরিসীম। ঐতিহাসিক গিবন তাঁর ‘ডিকলাইন অ্যান্ড ফল অব দ্য রোমান এমপায়ার’ গ্রন্থে যথার্থই বলেছেন, ‘লন্ডনের রাস্তা যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকত তখন কর্ডোভার রাজপথ আলোয় উদ্ভাসিত থাকত। টুরসের যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয় না ঘটলে সম্ভবত অক্সফোর্ডে আরবি ভাষার চর্চা হতো।’
শুধু গিবনই নন, ড্রেপার, গির্জা, ডেভেনপোর্ট, লেনপুল, মার্টন, হিট্টি প্রমুখ পশ্চিমা খ্রিস্টান ঐতিহাসিকরা একবাক্যে বিশ্ব সভ্যতায় মুসলমানদের অপরিসীম অবদানের কথা স্বীকার করেছেন। ঐতিহাসিক হিট্টি সত্যিকার অর্থেই বলেছেন, ‘অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত আরব ভাষাভাষী লোকেরা সমগ্র বিশ্বের বুদ্ধি এবং সভ্যতার আলোর বর্তিকাধারী ছিল। তাদের মাধ্যমে প্রাচীন বিজ্ঞান এবং দর্শন পুনর্জীবিত ও সম্প্রসারিত হয়, যার ফলে পশ্চিম ইউরোপে রেনেসাঁর উন্মেষ ঘটে।’
প্রকৃতপক্ষে, চিকিৎসাশাস্ত্র, জোতিষশাস্ত্র, গণিতশাস্ত্র, রসায়নশাস্ত্র, ভূগোলশাস্ত্র এবং ইতিহাস লিখনে মুসলমানরা পথ-প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। তাদের হাত ধরেই আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনা এবং অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বিজ্ঞানের অপরাপর শাখার মতো গণিতশাস্ত্রেও মুসলমানদের অবদান অতুলনীয়। প্রখ্যাত মুসলিম জোতির্বিজ্ঞানী এবং পদার্থবিদদের একনিষ্ঠ গবেষণার ফলে গণিতশাস্ত্রের বিশেষ উৎকর্ষ সাধিত হয়। ফলে মুসলমানরা গ্রিক জ্যামিতির জটিল সমস্যাগুলোর সমাধান, ভারতীয় শূন্যের ইউরোপে বহুল প্রচার, দশমিক প্রথা, বীজগণিত, গোলাকার এবং ত্রিকোণমিতির প্রবর্তন করে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। মুসলমানরা যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় উৎকর্ষ সাধনে ব্যাপৃত, তখন প্রাচ্য ও প্রতীচ্যে তাদের সমকক্ষ কেউ ছিল না।
গণিতশাস্ত্রে একচ্ছত্র দিকপাল ছিলেন শ্রেষ্ঠবিজ্ঞানী ইবনে মুসা আল-খাওয়ারিজমি (৭৮০-৮৫০ সাল)।
মধ্য এশিয়ার খোরাসানের অন্তর্গত খাওয়ারিজমে তাঁর জন্ম। তিনি একাধারে জোতির্বিজ্ঞানী এবং অন্যদিকে অঙ্ক ও বীজগণিতের আবিষ্কারক। তাঁর ‘আল-জাবর-আল-মুকাবেলা’ ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্কশাস্ত্রের শ্রেষ্ঠ পাঠ্যপুস্তক হিসেবে প্রচলিত ছিল। এই গ্রন্থে তিনি আট শ উদাহরণের মাধ্যমে সমীকরণের জটিল সমস্যার সামাধান করেন। তিনিই সর্বপ্রথম আরব সংখ্যারীতি বীজগণিতে প্রবর্তন করেন। হিট্টির মতে, ‘ত্রিকোণমিতির বিজ্ঞান, যেমন বীজগণিত এবং জ্যামিতি প্রধানত আরবদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।’ মুসলিম গবেষক ও বিজ্ঞানী আবু আবদুল্লাহ ইবনে জাবির ইবনে সিনান আল-বত্তানি (৮৫৮-৯২৯ সাল) সর্বপ্রথম ত্রিকোণমিতির অনুপাত প্রকাশ করেন। অন্য আরেক লব্ধপ্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী ছিলেন আল-ফারাবি। তিনিও জ্যামিতি ও জোতির্বিজ্ঞানের ওপর তথ্যমূলক গ্রন্থ রচনা করেন। দশম শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুসলিম বৈজ্ঞানিক আবুল ওয়াফা (৮৪০-৯১৮ সাল) ত্রিকোণমিতির তালিকা প্রণয়ন করেন। তিনি সর্বপ্রথম সাইন উপপাদ্যের সঙ্গে গোলাকার ত্রিভুজের সাধারণত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ত্রিকোণমিতির ওপর একটি জ্ঞানগর্ভ পরিচ্ছদ সংযোজন করেন মুসলিম পণ্ডিত ও বিজ্ঞানী জাবির ইবনে আফলাহ।
মুসলিম বিজ্ঞানীদের মধ্যে আরেক দিকপাল আল-বেরুনি (৯৭৩-১০৪৮ সাল)। খাওয়ারিজমে জন্মগ্রহণকারী এই সেরা বিজ্ঞানীর গণিতশাস্ত্রে অবদান সর্বজনস্বীকৃত। তিনি গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের সেরা বিজ্ঞানী ছিলেন। এ ছাড়াও জোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসা ও রসায়নশাস্ত্র, জীবতত্ত্ব, দর্শন, ন্যায়শাস্ত্র এবং ইতিহাসে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। তাঁর সমসাময়িক বিজ্ঞানীদের মধ্যে আবু আলী আল হুসেন ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সীনা (৯৮০-১০৩৭ সাল), কবি ওমর খৈয়াম (১০২১-১১২৩ সাল) অনেক উঁচুদরের বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ ছিলেন। ইবনে সিনা বুখারার অন্তর্গত আফসানায় জন্মগ্রহণ করেন। আর ওমর খৈয়াম জন্মগ্রহণ করেন খোরাসানে। তিনি পাটিগণিত, বীজগণিত ও জোতির্বিজ্ঞানের ওপর বহু গ্রন্থ রচনা করেন। ওমর খৈয়ামই প্রথম কণিকের ছেদ দ্বারা এর দ্বিঘাত, ত্রিঘাত ও ঘন সমীকরণগুলোর সমাধান করেন।
উল্লেখ্য, আল-খাওয়ারিজমীর পর এলজেবরার ওপর সর্বাধিক অবদান রাখেন মিসরের বিখ্যাত গণিতবিদ আবু কামিল (৮৫০-৯৩০ সাল)। এ ছাড়াও আল-কারখি (মৃত্যু-১০২০ সাল), আল-হাইসাম (৯৬৫-১০৩৯ সাল), ইবনুল মাজিদি (জন্ম ৩৬৯ সাল) গণিতশাস্ত্রে বহু মৌলিক অবদানের স্বাক্ষর রেখে স্মরণীয় হয়ে আছেন। খোরাসানের মুসলিম গণিতবিদ নাসিরউদ্দিন আল-তুসি (১২০১-১২৭৪ সাল) অঙ্ক, বীজগণিত, জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি প্রভৃতি সব বিষয়ে মৌলিক অবদান রেখে গেছেন। তারপর মুসলিম জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ ছিলেন তাঁরই শিষ্য কুতুবউদ্দিন সিরাজি (১২৩৬-১৩১২ সাল)। গণিত ছাড়াও বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। তিনি সিরাজনগরে জন্মগ্রহণ করেন। পঞ্চদশ শতাব্দীর সর্বশেষ মুসলিম বিজ্ঞানী ছিলেন আবুল হাসান আলী ইবনে মোহাম্মাদ ইবনে আলী আল-কোরেয়শি আল-বস্তি (জন্ম-১৪৪৬ সাল)। তিনি স্পেনের গ্রানাডার নিকটবর্তী বাজায় জন্মগ্রহণ করেন। গণিতশাস্ত্রে মৌলিক অবদানের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের মধ্যে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। গণিতশাস্ত্রে আরো অনেক মুসলিম বিজ্ঞানীর নাম স্মরণ করা যায়। তার মধ্যে আহমদ বিন তাইয়েব আল-সারাকশি, আহম্মদ বিন ঈসা আল-মাহানি, বিখ্যাত পারিসিয়ান গণিতবিদ আবদে আল-হামিদ ইবনে তুর্ক (জন্ম ৮৩০ সাল), সিরিয়ান আরব গণিতবিদ, পদার্থবিজ্ঞানী আল-সাবি তাবিত ইবনে কোরাহ আল-হারানি (৮২৬-৯০১ সাল), ইরাকি গণিতবিদ আবু আল-তাইয়েব সানাদ ইবনে আলী আল-ইয়াহুদি (মৃত্যু-৮৬৪ সাল), আবু সাহি ওয়াজাল ইবনে রুস্তম আল-কুহি (৯৪০-১০০০ সাল) এবং আবুল হাসান আহম্মাদ ইবনে ইবরাহিম আল-ওয়াকিদিম (জন্ম ৯৫২ সাল) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
সব শেষে বলা যায়, মুসলিম বিজ্ঞানীদের হাত ধরেই আধুনিক গণিতের উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় মুসলমানদের বিচরণ ছিল অসামান্য। অবদান ছিল সীমাহীন। বিখ্যাত পশ্চিমা গণিতবিদ লিওনার্দো ফিবোনাক্কির (১১৮০-১২৫০ সাল) তাই বলেছেন, ‘মুসলিম বিজ্ঞানীদের বীজগণিত গ্রিক বা ভারতীয় বিজ্ঞানীদের বীজগণিত অপেক্ষা অনেক উন্নত, সুশৃঙ্খল এবং বিশদভাবে আলোচিত।’
প্রকৃতপক্ষে, ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, অষ্টম শতক থেকে শুরু করে পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত পাঁচ শরও বেশি মুসলিম বিজ্ঞানী তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান দ্বারা বিশ্বকে ঋণী করে গেছেন। গণিতশাস্ত্রের পণ্ডিত প্রফেসর জর্জ সার্টন তাঁর ‘ইনট্টোডাকশন টু দ্য হিস্ট্রি অব সায়েন্স’ নামক গ্রন্থে যথার্থই বলেছেন, ‘মুসলিম প্রাধান্যের যুগে যেসব বিজ্ঞানী জ্ঞান-বিজ্ঞানে তাঁদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন, তাঁদের সংখ্যা সম্ভবত বর্তমান যুগের মনীষীর সংখ্যার চেয়ে খুব কম নয়।’
সত্যিকথা বলতে কী, আধুনিক বিজ্ঞানময় বিশ্ব রচনার পেছনে যেই মুসলমানদের স্মরণীয় অবদান সগৌরবে উচ্চারিত হয়, সেই ইতিহাস এখন প্রায় বিলীনের পথে। মুসলমানরা এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। হয়ে পড়েছে নির্জীব। তারা দৈন্যতার রাহুর গ্রাসে আটকে পড়েছে। কবে জাগবে মুসলিমরা, কবে ফিরিয়ে আনবে তাদের হারানো গৌরব! ও আল্লাহ, তুমি মুসলমানদের চেতনা ফিরিয়ে দাও। তাদের ঘুম থেকে জাগার তৌফিক দান করো। আমিন।