এক নজরে শেখ হাসিনা

টানা দশমবারের মতো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সাল থেকেন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী এই দলটির নেতৃত্বে আছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কন্যা। বাবা-মা, ভাই, স্বজন-সব হারিয়েছেন, বিদেশে থাকায় প্রানে বেঁচে গেছেন ঘাতকের বুলেট থেকে। বিদেশে থাকা অবস্থায়ই হাল ধরেছেন দলের। দেশে ফিরে রাত-দিন চষে বেড়িয়েছেন দলকে সংগঠিত করতে। দিনে দিনে একজন পরিনত রাজনীতিক হয়ে ওঠেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামীলীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। দেশের সব সংকটে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। প্রাণনাশের চেষ্টা হয়েছে অন্তত বিশবার। তবুও দমে যাননি বঙ্গবন্ধু কন্যা। দক্ষতা, উৎকর্ষতায় নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন অনেক আগে। প্রশংসিত হয়েছেন বিশ্ব দরবারে।

শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে দায়িত্ব পালন করা প্রধানমন্ত্রী। জাতীয় পর্যায়ে তার রাজনৈতিক কর্মজীবন প্রায় চার দশকেরও বেশি সময়ব্যাপী বিস্তৃত। ১৯৮১ সাল থেকে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ১৯৮৬ থেকে ১৯৯০ ও ১৯৯১-১৯৯৫ পর্যন্ত বিরোধী দলের নেতা এবং ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালে জনগণের বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিরে আসেন। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে তৃতীয়বারের মতো এবং ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হন।

শেখ হাসিনা বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত। ফোর্বস সাময়িকীর দৃষ্টিতে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ১০০ নারীর তালিকায় ধারাবাহিকভাবে স্থান করে নিয়েছেন শেখ হাসিনা। সবশেষ ২০২২ সালে এ তালিকায় ৪২-তম অবস্থানে আছেন তিনি। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক ফরেইন পলিসি নামক সাময়িকীর করা বিশ্বব্যাপী শীর্ষ ১০০ বৈশ্বিক চিন্তাবিদদের তালিকায় শেখ হাসিনা জায়গা করে নিয়েছেন। তিনি বিশ্ব নারী নেত্রী পরিষদের একজন সদস্য, যা বর্তমান ও প্রাক্তন নারী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীদের একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক।

প্রারম্ভিক ও ব্যক্তিগত জীবন

শেখ হাসিনা গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯৪৭ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং মাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। তিনি পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়। টুঙ্গিপাড়াতে প্রাথমিক শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করেন। ১৯৫৪ সাল থেকে তিনি ঢাকায় পরিবারের সাথে মোগলটুলির রজনী বোস লেনের বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। পরে মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবনে স্থানান্তরিত হন। ১৯৫৬ সালে তিনি টিকাটুলির নারীশিক্ষা মন্দির বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে থাকা শুরু করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি আজিমপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী গ্রেফতার করার সময় তিনি ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাসায় পিতারপাশেই ছিলেন।

শেখ হাসিনা ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে থেক স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি ও তার বোন শেখ রেহানা বাদে পরিবারের সকল সদস্যকে হত্যা করা হয়। সেইসময় পড়াশোনার জন্য পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করায় তারা প্রাণে বেঁচে যান। এরপর তিনি ভারত, বেলজিয়াম সহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করেন ও দেশের মানুষকে সংগঠিত করতে থাকেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব প্রদানের লক্ষ্যে তিনি ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে প্রত্যাবর্তন করেন।

 

ব্যক্তিগত জীবন

বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় ১৯৬৭ সালে বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সাথে তার বিয়ে হয়। ওয়াজেদ মিয়া ২০০৯ সালের ৯ মে মৃত্যুবরণ করেন। তাদের সংসারে সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুল নামে দুই সন্তান রয়েছেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সজীব ওয়াজেদ জয় প্রধানমন্ত্রী তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সায়মা ওয়াজেদ পুতুল অটিজম বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন। পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন দেশিবিদেশি নানা প্রতিষ্ঠানে।

রাজনৈতিক জীবন

বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের (সাবেক ইন্টারমিডিয়েট গভর্নমেন্ট গার্লস কলেজে) ছাত্রী থাকা অবস্থায় ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় হন তিনি। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনে অংশ নেন এবং কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন শেখ হাসিনা।

আওয়ামী লীগ ১৯৮১ সালে সর্বসম্মতিক্রমে শেখ হাসিনাকে তার অনুপস্থিতিতে দলের সভাপতি নির্বাচিত করে। ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন শেষ করে অবশেষে তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন।

 

১৯৮৬ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিরোধীদলীয় নেত্রী নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। পরবর্তীকালে এরশাদ বিরোধী দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেন ও ১৯৯০ সালে অভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে এরশাদ সরকারকে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন।

১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৮৮টি সংসদীয় আসন লাভ করে এবং প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মোট প্রদত্ত ভোটের ৩০.১ % লাভ করে আওয়ামী লীগ, যা সরকার গঠনকারী দল থেকে মাত্র ০.৭% কম ।

১৯৯৬ সালে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা তুলে ধরেন। ১৯৯৬ সালে তার দল আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বামপন্থী দলগুলোর সাথে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমে খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে বাধ্য করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে তার দল আন্দোলনে জয়ী হওয়ায় পরবর্তীতে তার দল জাতীয় নির্বাচনেও জয়লাভ করে এবং ঐ বছর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

২০০১-২০০৮ সালে বিরোধী দলের যায় আওয়ামী লীগ। এ সময় শেখ হাসিনাকে একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়।২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় এক জনসভায় বক্তৃতাদানকালে গ্রেনেড হামলায় এই নেত্রী অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। উক্ত হামলায় তার ঘনিষ্ঠজন এবং আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ১৯ জন মৃত্যুবরণ করেন ও শতাধিক আহত হন। বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে এই হামলাকে বিদেশি ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করা হয়। এই গ্রেনেড হামলার তদন্তকে ভিন্ন খাতে করার জন্য ‘জজ মিয়া’ নাটক সহ বেশকিছু প্রহসন সৃষ্টি করেছিল তৎকালীন প্রশাসন।

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো গ্রেফতার হন ২০০৭ সালে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই সকাল ৭:৩১-এ যৌথ বাহিনী শেখ হাসিনাকে তার বাসভবন “সুধা সদন” থেকে গ্রেফতার করে। তাকে আদালতে সোপর্দ করা হয়। সেখানে আদালত তার জামিন আবেদন না-মঞ্জুর করে। শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকারের বাসভবনকে সাব-জেল হিসেবে ঘোষণা করে সেখানে অন্তরীণ রাখা হয়।

২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট প্রায় তিন-চতুর্থাংশ আসনে জয়লাভ করে। বিজয়ী দলের সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে তিনি জানুয়ারি ৬, ২০০৯-এ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তার দল আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে ২৬০টি আসন লাভ করে। অপরদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি পায় মাত্র ৩২টি আসন। এরপর থেকে টানা বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আছেন শেখ হাসিনা। তার আমলে নানা খাতে ও সূচকে নজরকাড়া উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। স্বপ্নের পদ্মাসেতু পরিণত হয়েছে বাস্তবতায়।