সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে খেলেছে নেইমারের ব্রাজিল আর লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। আর সেটি নিয়ে মারামারি, ম্যাচ শেষের আনন্দ-হতাশা একই মাত্রায় হলো কি না এই বদ্বীপে! ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনায় এমনই পাগলপারা বাংলাদেশের ফুটবল সমর্থকেরা। এবার বাংলাদেশের আর্জেন্টিনা ভক্তরা সেটির একটা স্বীকৃতিও পেলেন।
গত শনিবার ব্রাজিলকে তাদেরই মাটিতে ১-০ গোলে হারিয়ে কোপা আমেরিকার শিরোপা জিতেছে আর্জেন্টিনা। ২৮ বছর পর দলটার কোনো আন্তর্জাতিক শিরোপা জয় এটি। লিওনেল মেসির ১৬ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের আক্ষেপও ঘুচেছে এতে।
আর্জেন্টিনা সে আনন্দে মাতোয়ারা, বাংলাদেশও কি কম! এই করোনাকালীন বিধিনিষেধের মধ্যেও সব স্বাস্থ্যবিধিকে উপেক্ষা করে আর্জেন্টিনার পতাকা নিয়ে, স্লোগানে-নাচে উদ্যাপন করেছেন বাংলাদেশি আর্জেন্টিনা–ভক্তরা। সেটি চোখে পড়েছে হুয়ান পাবলো সোরিনের।
২০০৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা দলের লেফটব্যাক ও অধিনায়ক সোরিন ইনস্টাগ্রামে বিশাল এক পোস্টে বাংলাদেশের সমর্থকদের নিয়ে তাঁর পুরোনো স্মৃতি জানানোর পাশাপাশি এবারের উদ্যাপনের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশিদের। তিনটি ভিডিওতে বাংলাদেশের আর্জেন্টিনা ভক্তদের উদ্যাপনের দৃশ্যও তুলে ধরেছেন সোরিন।
একদিকে ব্রাজিল, অন্যদিকে আর্জেন্টিনা। একদিকে নেইমার, অন্যদিকে মেসি। ম্যাচ আবার হচ্ছে ব্রাজিলের ফুটবলতীর্থ মারাকানায়, যে ম্যাচটা আবার একটা শিরোপা নির্ধারণী। ব্রাজিল নয়তো আর্জেন্টিনায়—চিরদিনই দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের ফুটবল সমর্থকদের আর কী লাগে! উত্তেজনা-রোমাঞ্চ ছুঁয়েছে, কিছু জায়গায় মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে সেটি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এ নিয়ে সংঘর্ষের খবর তো বিদেশি সংবাদমাধ্যমেই এসেছে!
শনিবার ফাইনালে অবশেষে আর্জেন্টিনার জয়ের পর আর্জেন্টিনার সমর্থকদের উদ্যাপনও কোনো বাধা মানেনি। করোনায় দেশ জবুথবু, লকডাউন চলছে, কিন্তু সেসব পাত্তা না দিয়ে মিছিল বেরিয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন কোনায়। সেদিনই টুইটার-ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে সেসব দৃশ্য। বিদেশি অনেক সাংবাদিক অবিশ্বাসমাখা মুগ্ধতায় এ নিয়ে টুইটও করেছেন। এবার এ নিয়ে উচ্ছ্বাস ঝরল সোরিনের ইনস্টাগ্রাম পোস্টেও।
বাংলাদেশের ভক্তদের এই আবেগের সঙ্গে সোরিনের পরিচয় অবশ্য নতুন নয়। ১৯৯৫ ফিফা যুব বিশ্বকাপেও ব্রাজিলকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল আর্জেন্টিনা, সে দলে ছিলেন সোরিন। কাতারে অনুষ্ঠিত সে যুব বিশ্বকাপের ফাইনালে কাতারপ্রবাসী অনেক বাংলাদেশি সমর্থক মাঠে গিয়েছিলেন। আর্জেন্টিনার পতাকা নিয়ে, আর্জেন্টিনার নামে উল্লাস করেছিলেন বাংলাদেশিদের অনেকে।
শনিবার বাংলাদেশিদের এই উল্লাস দেখে ১৯৯৫ সালের স্মৃতি ফিরে এসেছে সোরিনের, ‘২৬ বছর আগে আমরা কাতারে ব্রাজিলের বিপক্ষে বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেছিলাম। দেশ থেকে কত দূরে ছিলাম! পরিবার, বন্ধুবান্ধব কিংবা সমর্থকদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য এত প্রযুক্তি ছিল না। কিন্তু সেই অবিশ্বাস্য স্টেডিয়ামেও আর্জেন্টিনার একটা পতাকা ছিল, কয়েকজন ভক্ত পতাকাটি এত আবেগ নিয়ে নাড়াচ্ছিলেন। আমাদের মুখে হাসি ফুটিয়েছিল সে দৃশ্য, মনে রোমাঞ্চ তৈরি করেছিল। পতাকাটার গায়ে লেখা ছিল ‘বাংলাদেশ’। কয়েকজনের একটা গ্রুপ আমাদের সমর্থনে লাফাচ্ছিল, চিৎকার করছিল।’
সেই স্মৃতির সঙ্গে এবারের দৃশ্য মিলিয়ে বাংলাদেশকে মন থেকে ধন্যবাদ দিলেন সোরিন, ‘সে কারণে বাংলাদেশের সবাইকে আমি ধন্যবাদ দিতে চাই, সম্মান জানাতে চাই, যাঁরা কিনা বিশ্বের অন্য একটা প্রান্তে রাস্তায় নেমে আমাদের কোপা আমেরিকা জয়ের উদ্যাপন করেছেন!’
বাংলাদেশিদের কাছে আর্জেন্টিনা দল ঘিরে এই যে আবেগ, এর মূলে মূলত দুটি নাম—ডিয়েগো ম্যারাডোনা ও লিওনেল মেসি। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার জাদুতে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশসহ এই উপমহাদেশ। আর গত দুই দশকে মেসি আর্জেন্টিনার নামটা পৌঁছে দিয়েছেন মানুষের মনের আরও গভীরে।
দুবারের বিশ্বকাপজয়ী দেশটির সব তারকাকেই তাই স্মরণ করলেন সোরিন, ‘ডিয়েগোকে ধন্যবাদ, মেসিকে ধন্যবাদ, আমাদের ১৯৭৮ ও ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জেতানো দল দুটির সবাইকে ধন্যবাদ। তাঁদের কারণেই আমাদের দলটার ভক্ত বিশ্বের সব প্রান্তেই আছে। ২৮ বছর পর ফুটবল ন্যায়বিচার করায়, আর্জেন্টিনা শিরোপা জেতায় পুরো বিশ্বই তাই যেন আরেকটু খুশি হয়েছে।
শেষে এসে বাংলাদেশিদের আরেকবার ধন্যবাদ আর শ্রদ্ধা জানালেন সোরিন, ‘আকাশি-সাদা পতাকাটা গায়ে জড়িয়ে শনিবার যেভাবে এঁরা (বাংলাদেশি ভক্ত) উদ্যাপন করেছেন, ঠিক একইভাবে করেছিলেন কাতারে সে রাতেও।