মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট এসব যতোটা না তার চেয়ে অনেক বেশি বাড়িয়ে বলা হয়; খেলাপি ঋণেও তাই-বাংলাদেশে খেলাপির হারও খুব অস্বাভাবিক নয়। সম্প্রতি একাত্তরকে এসব কথা বলেছেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। জুলিয়া আলমকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, একসময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বলা হতো যে ঋণ বোঝা- আসলে তা নয়। তার দাবী সংকটে পড়ে বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে ঋণ নেয়নি, ঋণ নেয়া হয়েছে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য। দীর্ঘ আলাপে মন্ত্রী আরো বলেন, এদেশে থিংক-ট্যাংক এবং অর্থনীতিবিদরা সব সময় আশংকাবাদী তাই বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে আশাবাদী সব কথা শুনতে হয় বিদেশিদের থেকে।
জুলিয়া: সরকার থেকেও আসলে এমন একটা শংকা প্রকাশ করা হয়েছিলো যে ২০২৩ সালে অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক হবে। বছরে দুই মাস চলে গেলো-অর্থনৈতিক অবস্থা আপনি কেমন দেখতে পাচ্ছেন?
ড. শামসুল আলম: প্রথমে বলবো অর্থনীতি নাজুক অবস্থায় আছে এটা বোধহয় কেউ বলেনি, নীতি নির্ধারক বা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পর্যায় থেকেও না। যেটা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন সেটা হল, যেহেতু বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে এবং এফএও সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বলেছে যে আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্য সংকট হবে। কেননা সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিলো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে। সেই প্রেক্ষাপটেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পরিস্থিতি মোকাবেলায় দেশকে প্রস্তুত করেছেন। খাদ্য সংকটে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যেতে পারে। তাই তিনি বলেছেন যে আমাদের পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে তাই আমরা কৃষিতে কোথাও যেনো এক ইঞ্চি জমি ফেলে না রাখি, সর্বোচ্চ প্রয়াস দেই। আমাদের প্রচেষ্টার যেনো ঘাটতি না থাকে, উৎপাদন যাতে অক্ষুন্ন থাকে। আমরা চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছি তবে প্রতিকূলতা মোকাবেলা করছি এবং সফল হচ্ছি। আমাদের সম্মানিত অর্থনীতিবিদগণ থিংক ট্যাঙ্ক যেভাবে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার বা পাকিস্তানের মত বিপর্যয়ে পড়তে যাচ্ছে-অনেকে এটাও বলেছেন বাংলাদেশের ২০২৩-২৪ সালে ঋণের কিস্তিও দিতে অসুবিধা হবে। সমালোচনা ও আশঙ্কা অহরহ প্রকাশ হয়েছে অর্থনীতিবিদদের কাছ থেকে। কিন্তু আমরা সরকারের ভেতর থেকে যা দেখেছি অর্থনীতি-আমরা কখনোই বলিনি অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে। আমরা যেটা বলেছি সেটা হলো যতো প্রবৃদ্ধির আশা করছি যেটা বাজেটে লিখেছিলাম সেটা অর্জিত নাও হতে পারে। আমরা জানি আমাদের অর্থনীতি, আমাদের উৎপাদন ব্যবস্থা, আমাদের বাজার ব্যবস্থা, আমাদের বিদেশি সহায়তার পরিস্থিতি। সব মিলিয়ে আমরা ভালোভাবেই সামাল দিয়েছি এবং এগিয়েছি। শুধু কোভিড সময়ের কথা যদি বিবেচনা করি বিশ্বের ২০০ দেশের মধ্যে কোভিড ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ পঞ্চম স্থানে আছে। এটা আমাদের কথা না, এটা মূল্যায়ন জাপানের নিক্কেই ইনস্টিটিউটের। তারা সবকিছু দেখে বস্তুনিষ্ঠভাবে, তাদের এখানে রাজনৈতিক স্বার্থ নেই। তাদের হিসাবে বাংলাদেশ কোভিড মোকাবেলায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। আমাদের থিংক ট্যাংক কিন্তু সেভাবে বলেনি বা আমাদের ইতিবাচক বা আশার বাণী থাকলে সেটা আমাদের বিদেশি গবেষণা সংস্থা, বিদেশী নেতৃত্ব স্থানীয় মিডিয়া, বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদদের কাছ থেকে শুনতে হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ এক নম্বর যারা ভালোভাবে কোভিড সমস্যা মোকাবেলা করেছে। আপনি যেটা বললেন, আমিও বলেছি এই ২০২৩ সাল চ্যালেঞ্জিং সময়। এটাও সত্য যে আমাদের ডলারের যে বিপুল মজুদ ছিল তা যথেষ্ট কাজে লেগেছে। আমরা তিন বিলিয়ন ডলার মজুদ পেয়েছি ২০০৯ সালে, সেটা গত জুলাইতে উঠেছিল ৪৮ বিলিয়নে। তারপর কমেছে সেটাও বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির জন্য না। আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক-ফেডারেল রিজার্ভ বিশ্ব পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে, নিজেদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা রক্ষার চেষ্টায় সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে। তারা সুদের হার বাড়ায় কাজেই অনেক ডলার আমেরিকার দিকে ধাবিত হয়েছে কারণ সেখানে লাভ বেশি। সে কারণে অনেক দেশের টাকার মান কমে যায়। যেহেতু ফেড অস্বাভাবিক হারে ২২ শতাংশ সুদের হার বাড়িয়েছে । আমাদের এখানে ২২ থেকে ২৫ শতাংশ হারে ডলারের দাম বেড়েছে। তাই সেই হারে বাংলাদেশী টাকার মান কমে যায়। এটা কিন্তু আমেরিকার ফেডের কারণে। আমাদের মূল্যস্ফীতি ঘটেছে কারণ যেখানে আগে এক ডলার কিনতে ৮৫ টাকা লাগতো সেটা এখন ১০৬ টাকা ( এটা ১১২ টাকাতেও উঠেছিল)। এতে কিছু অস্থিতিশীলতাও তৈরি হয় কারণ আমাদের দেশে বিনিয়োগকারীরা যারা ধনী শ্রেণী বা যারা এক্সর্পোট-ইমর্পোট করেন, তারা শংকিত হয়ে ডলার সংগ্রহ করতে থাকে। কারণ ডলার বাইরে রাখলে তারা মুনাফা বেশি পাবে। এই প্রবণতা অবশ্য সব দেশেই কাজ করেছে। ডলারের বাড়তি চাহিদার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংককেও বাজারে বেশি ডলার বিক্রি করতে হয়েছে। তবে আমাদের আশংকার কিছু নেই কারণ ৩ থেকে সাড়ে ৩ মাসের আমদানির ডলার মজুদ থাকলেই আমরা সচল- আএমএফও তাই বলে।
জুলিয়া: তাহলে আমাদের আইএমএফ এর দারস্থ বা ঋণ নিতে হল কেনো? এখন যদিও সরকার বলছে যে পরিস্থিতি অনেকটা উন্নতি হয়েছে কিন্তু ব্যাংকগুলোতে দেখা যাচ্ছে ডলার সংকট, এলসি খোলা যাচ্ছে না।
ড. শামসুল আলম: শুধু আইএমএফ কেন, আমরা এডিবি থেকেও ঋণ নিচ্ছি বিশ্বব্যাংক থেকেও নিচ্ছি। আর দ্বি-পাক্ষিক ক্ষেত্রে জাপান থেকে ঋণ নিয়েছি, এআইআইবি থেকে নিয়েছি। যেখান থেকে নেওয়ার সুযোগ আছে নিচ্ছি এবং নিতেই হবে। সংকটের সাথে ঋণের সর্ম্পক নেই। আপনাকে বোঝানোর জন্য বলি, সিঙ্গাপুর বা জাপানতো সংকটে নেই তবু সিঙ্গাপুর এখন ঋণ নেয়, জাপানও নেয়-তারাতো সংকটে নেই। পাকিস্তানও দেশজ আয়ের প্রায় ৮৯ ভাগ ঋণ নিয়েছে, শ্রীলংকা দেশজ আয়ের ১১৯ শতাংশ ঋণ নিয়ে বসে আছে। বাংলাদেশের ঋণ দেশজ আয়ের ৪০ ভাগ। আমরা পাকিস্তান থেকে অনেক কমে আছি, ভারত থেকেও। কাজেই ঋণ নেওয়ার সঙ্গে সংকটের ডাইরেক্ট লিংক নেই- যে সময় সংকট থাকে না তখনও কিন্তু ঋণ নেয়া হয়। আমেরিকার মতো দেশও কিন্তু ঋণ নেয় কারণ ঋণ ব্যবসায়ীক কার্যক্রম ও অর্থনীতিকে সচল রাখে, অর্থপ্রবাহ বাড়ায় দেশে, প্রবৃদ্ধি বাড়ায়।
ড. শামসুল আলম: কোনো সংকট নাই এটা বলবো কেন। আমরা কিছুটা ডলারের চাপে আছি, মূল্যস্ফীতির চাপও ব্যাপক। তবে মূল্যস্ফীতিটাও আমাদের উৎপাদন ঘাটতির জন্য নয়, আমাদের ফসল এবার কম হয়নি, আমাদের শিল্পোৎপাদনও বেড়েছে। তাহলে কেনো হল মূল্যস্ফীতি? বিশ্বে বিভিন্ন পণ্যের দাম অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেছে। ৬৪ ডলার ছিলো ব্যারেল পার ব্রেন্টক্রুড সেটা ১৪০ ডলারে উঠেছে বিশ্বে আমদানিকৃত জিনিসপত্রের দাম প্রায় দ্বিগুন, পরিবহন ব্যয় কয়েকগুণ বেড়েছে। বাংলাদেশ যেহেতু প্রচুর আমদানি করে তাই বিশ্বে পণ্যের দাম বেড়ে মূল্যস্ফীতি চলে আসে-এটা বাইরে থেকে আসা, কাজেই আমাদের মূল্যস্ফীতি সবটাই বহিরাগত। তবে আমরা পরিস্থিতি ভালভাবে সামাল দিচ্ছি।
জুলিয়া: আচ্ছা ডলার সংকট নিয়ে সরকার এখন কি বলছে? দেশে কি ডলার সংকট নাই? ব্যাংকেতো দেখা যাচ্ছে ডলারের অভাবে এলসি খোলা যাচ্ছে না।
ড. শামসুল আলম: আপনার কথা একেবারেই ঠিক নয়। এটা প্রচারণা, এটা অনেকে না জেনে, গভীরে না যেয়ে বলে। তাই যদি হবে, গত বছরের শেষ ৬ মাস জুলাই থেকে ডিসেম্বর আমদানি বেড়েছে প্রায় ২ মিলিয়ন ডলার তো কোথায় ডলার সংকট হলো আর কোথায় আমদানি কম হলো? আমদানি আরো হতো আমরা কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করছি, বিলাস পণ্য, খুব প্রয়োজন না হলে সেগুলো আমরা ট্যাক্স বসিয়েছি বা আমদানি এলসি দিচ্ছি না। এলসি যে সমস্যা বলা হচ্ছে এটা অতিরঞ্জিত। তাই যদি হতো তাহলে আমাকে বলেন, এই ২ বিলিয়ন ডলার আমদানি বেশি হলো কোথা থেকে? মোটেও সংকট নেই। সাময়িক সংকট যেটা আমি বুঝিয়ে বলি আপনাকে, জনগণেরও বোঝা দরকার। আমরা কিছু আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকদের একাউন্ট চেক করেছি তারা কতো দিয়ে এলসি খুললেন, কতো পণ্য দেশে আসলো, এটা মেলাতে একটু সময় লাগে। প্রায় ১’শর উপরে ব্যবসায় দেখা গেল তাদের ইম্পোর্ট হয়েছে এলসি অর্ডারের তুলনায় কম। তার মানে টাকা বাহিরে নেওয়ার প্রবণতা ছিলো। ঠিক তেমনি এক্সর্পোটাররাও যে পরিমাণ এক্সর্পোট করবে তার চেয়ে লিখেছে কম। সে তদারকি করতে গিয়ে ২-৩ মাস সময় লেগেছে। এটা একটা প্রক্রিয়া এখানে তথ্যভিত্তিক হস্তক্ষেপ না করলেতো ভালোর চেয়ে খারাপ হবে। আমরা চেকিং এ রেখেছি, দেখি ৬ মাসে কত ইমপোর্ট আনার কথা কত এনেছে। আর এতে যদি সমস্যাই হতো তবে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি আমদানি হতো না। তবে দু’একটা ঘটনা যে ঘটে না এমন নয়, সেটি সরলীকরন করা ঠিক নয়-একটা দুইটা ক্ষেত্রে হতেই পারে। আমদানীকৃত পণ্য নিয়ে প্রচুর জাহাজ আসছে আমাদের র্পোটে খালাসে সমস্যা হতেই পারে এর মানে এই নয় যে সব জিনিস আটকে গেলো। ছোট ঘটনা দিয়ে সরলীকরণ করা তো ঠিক না। আমরা আসলে খুব দ্রুত মন্তব্য করে ফেলি। এক মাসের ঘটনা দিয়ে চট করে অনেক কিছু বলে ফেলা ঠিক না।
জুলিয়া: বাংলাদেশকে আবার আইএমএফ এর দারস্থ হতে হলো- অর্থনীতিবিদরা এভাবেই বলছেন। আবার অনেকে বলছেন আসলে দেশ থেকে যদি অর্থ পাচার ঠেকানো যেত, তাহলে হয়তো আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের কাছে যেতে হতো না।
ড. শামসুল আলম: এই কথাটার মধ্যে একটা মিথ্যাচার আছে। তাই যদি হতো তবে সিঙ্গাপুর কেনো ঋণ নিয়েছে। তাদের কি দেশ থেকে টাকা চলে গেছে? এই কথা বুঝতে হবে আমাদের আর্ন্তজাতিক লেনদেন, টাকা আসা-যাওয়া এসব দারস্থ হওয়া না। তাহলে অতীতে আমরা ঋণ নিলাম কেনো? আমরা দারস্থ এখনো হবো কারণ প্রচুর ঋণ নেয়ার সুযোগ আছে আমাদের। আমরা চাই দেশে টাকা আসুক, বিনিয়োগ হোক, কর্ম সংস্থান হোক।
জুলিয়া: আমরা অনেক ঋণ নিতে পারবো, হয়তো আপনি বলতে চাচ্ছেন আমরা এখনো ঝুঁকিসীমা অতিক্রম করি নাই। সুযোগ আছে বলেই কি আমরা ঋণ নিতেই থাকবো, এগুলোতো একটা সময় দেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ড. শামসুল আলম: ৫১ বছরে যদি বোঝা না হয়ে থাকে, ১ বছরে হয়ে যাবে এটা আমি বলবো কেনো? ৫১ বছরে ঋণ পরিশোধে আমরা একবারও ব্যর্থ হইনি তাহলে আমি কিসের ভিত্তিতে বলছি যে বোঝা হবে? আমরা টাকা নিচ্ছি আবার টাকা জেনারেট করছি, এই মেট্রোরেল কয়েক কোটি টাকা এর মধ্যে আয় হয়ে গেছে, পদ্মা সেতু কতো আয় হয়েছে একটু খোঁজ নিয়ে দেখেন। আমরা যেগুলো নিয়েছি প্রত্যেক বিনিয়োগ থেকে অর্থ আসবে। কাজেই বোঝা হওয়ার প্রশ্নই উঠে না বরং টাকা নিয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা হচ্ছে। অনেকেই বলে যে মাথাপিছু ঋণ এতো বেড়ে গেলো ৯২ হাজার কোটি টাকা ইত্যাদি। ব্যক্তি নেয়ও না বিদেশী ঋণ ব্যক্তি ফেরতও দেয় না কাজেই এটা বলারও কোনো অর্থ হয় না। ঋণ নেয় সরকার আবার সরকার ফিরিয়ে দেয়।
জুলিয়া: সরকার ঋণ নেয় আবার ফিরিয়ে দেয় ঠিক তবে সরকারতো জনগণ থেকেই রাজস্ব আদায় করে। জনগণই কি তাহলে এই ঋণ নেয়ার স্বক্ষমতা করে দিচ্ছে না?
ড. শামসুল আলম: জনগণের পেছনেইতো সরকার ব্যয় করেছে। সরকার কি এটা খেয়ে ফেলেছে! সরকারতো খায় না! এই যে পদ্মা সেতু এর জন্যতো বাইরে থেকে টাকা নেই নাই আমরা তবে মেট্রোরেলের জন্য জাপান থেকে টাকা নিয়েছি। এর উপকারতো হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন পাচ্ছে। জনগণ উপকার পাচ্ছে, উপকার পেলে ফেরৎ দিতে হবে না, আপনি নদী পার হবেন নৌকা ভাড়া দিবেন না? এভাবে চিন্তা করেন বিষয়টা।
জুলিয়া: এভাবে যে ঋণ নিচ্ছি তাহলে কি আমরা সবাই কমফোর্ট জোনে আছি?
ড. শামসুল আলম: সবাই আছি কমফোর্ট জোনে-থাকবো না কেন? সবারই মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বিয়ে-শাদী কি কমেছে ঢাকা শহরে? গ্রামের বাজারে যান আপনি ঢুকতে পারবেন না। সেখানে দরদাম একটু বেশি কারণ চাহিদা বেশি তাই শহর থেকে গ্রামে মূল্যস্ফীতি একটু বেশি। চাহিদার তুলনায় সরবরাহও সামাল দিতে পারে না। আপনি মিনা বাজার, আগোরা বা স্বপ্নতে যান, ভিড় ঠেলে ঢুকতে হবে, বের হতে হবে। তাহলে এই ক্রেতা কারা? ঢাকায় রেষ্টুরেন্ট যান আগে বুকিং না দিলে ১০ জন নিয়ে খেতে পারবেন না। কোন কমিউনিটি সেন্টার খালি আছে যেখানে বিয়ে হচ্ছে না? দরদাম বেশি কারণ মানুষের আয় বেড়েছে তাই ব্যয় করে। শ্রমিক শ্রেণীর হয়তো কষ্ট হয়। এটাও মনে রাখতে হবে শ্রমিকের মজুরিও কিন্তু বেড়েছে। গ্রামে বেকারত্ব নাই তার মানে কর্ম আছে সবার। কৃষিতে শ্রমিক পায় না কারণ অকৃষিতে বহু কাজ বেড়েছে। বহু ছেলে ইন্টারনেট নিয়ে বসে আছে কম্পিউটারের দোকান বা ফ্লেক্সিলোডের দোকান দিয়ে বসেছে, গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করছে, কাঠের মিল বসিয়েছে, কত রকমের কাজ হচ্ছে গ্রামে গ্রামে কারণ প্রত্যেক গ্রামে রাস্তা আছে, বিদ্যুৎ আছে। গ্রামের কুঁড়ে ঘরগুলো কই চলে গেলো। এখন টিনের ঘরও খুব কম দেখা যায়। আসলে সব গেলো গেলো আমাদের বলার একটা ধারা চলে এসেছে। কষ্ট হচ্ছে বাজারে আমি অস্বীকার করবো না কিন্তু যতো বলা হয় সেটা ততো না-বাড়িয়ে বলা হয়। গত এক দেড় বছর ধরে, মুরগীর দাম বেড়েছে, ডিমের দাম বেড়েছে এটা সত্য। বাড়বে না কেনো পোল্ট্রিফিডের দাম বেড়েছে সেটাতো দামে প্রতিফলিত হবেই। বড় কথা হলো মানুষের প্রকৃত মুজুরি বা আয়ও কিন্তু বেড়েছে।
জুলিয়া: কিন্তু মূল্যস্ফীতির তুলনায় সব মানুষের প্রকৃত মুজুরি কি বেড়েছে?
ড. শামসুল আলম: হ্যা, অবশ্যই বেড়েছে। গত জানুয়ারি থেকে এই জানুয়ারিতে মুজুরি হার বেড়েছে। সাধারণ মজুরি হার জানুয়ারি ২০২২-এ ছিলো ৫.৯২ এবার হচ্ছে ৭.০৬ এটাকে বলি পয়েন্ট টু পয়েন্ট মুজুরি হার। গ্রামে দেখেন কৃষি মজুর পাওয়া যায় না। হাজার টাকার নিচে দিনমজুর পাওয়া যায় না। তারা টাকা রুজি করছে এবং খরচও করছে। প্রত্যেকের কাছে এখন মোবাইল আছে-খরচ করে-কথা বলতে শুরু করলে বলতেই থাকে- এরা কোথা থেকে খরচ করে?
জুলিয়া: সরকারের এমন দাবী বা মতের সাথে অর্থনীতিবিদরা কিন্তু দ্বিমত পোষণ করেন।
ড. শামসুল আলম: অর্থনীতিবিদরা দ্বিমত পোষণ করলেও আপত্তি নেই এজন্যে যে, তাদের কথা যদি সত্যি হতো তাহলে বাংলাদেশে পদ্মা সেতু হতো? তারা বলছে পদ্মা সেতু করলে সব প্রজেক্ট বন্ধ করে দিতে হবে। কোন প্রজেক্ট বন্ধ হয়েছে? বরং সময় মতো কয়েকটা চালু হয়েছে। বহু অর্থনীতিবিদ বলেছে এটা বাংলাদেশে করা ঠিক হচ্ছে না, পারবে না। আমাদের শ্রদ্ধেয় অর্থনীতিবিদরা অনেকেই আশংকাবাদী, দেশের ভালো কিছু শোনা যায় না তাদের বক্তব্যে- এটা আমাকে মাফ করতে পারেন কিন্তু এটা আমি বলবোই কারণ আমার যত উদ্ধৃতি দিতে হয় বাহিরের অর্থনীতিবিদদের- কৌশিক বশু,অমর্ত্য সেন, সুব্রানিয়াম, স্টিফান ডার্কন বা জো বাইডেনেরও উদ্ধৃতি দিতে হয় আমাদের ভালো বোঝানোর জন্য।
জুলিয়া: আপনি নিজেও কিন্তু একজন অর্থনীতিবিদ আমরা জানি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ।
ড. শামসুল আলম: সেজন্যইতো আস্থার সাথে কথা বলতে পারি। আমার কোনো কথাই কিন্তু সাধারণ স্টেটমেন্ট না। আমি যা বলি প্রত্যেকটার পিছনে আর্ন্তজাতিক তথ্য, আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাংক ও জাতিসংঘের তথ্য বেশি ব্যবহার করি।
জুলিয়া: এবার আমি আপনার কাছে একটু শুনতে চাইবো, আর্থিক খাত সংস্কারে সরকার কেন কঠোর হতে পারছে না? অনেকেই বলে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব আছে- কি বলবেন?
ড. শামসুল আলম: সরকারতো বহুজনের-অনেক স্বার্থের সমন্বয় করতে হয় সরকারকে। সরকার একটা গোষ্ঠির হলে, অনেক কিছু করে ফেলতে পারে, একটা কিছু করার আগে পিছনে সামনে চিন্তা করতে হয়- যেই সরকারই থাকুক। বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ খুব অস্বাভাবিক বলা যাবে না কারণ ভারতের প্রায় কাছাকাছি।
জুলিয়া: তাদের সাথে কি আমরা তুলনা করতে পারি, সেটি অনেক বড় দেশ!
ড. শামসুল আলম: হাতি যেমন বড়, তার পেটও বড়। ভারত বিশাল দেশ তবে আর্থ সামাজিকভাবে কাছাকাছি যদিও তাদের থেকে মাথাপিছু আয় আমাদের বেশি। আমাদের ঋণ অনেকটাই ফাঁপিয়ে ফুলিয়ে বলা হয়। তবে এর মানে এই নয় যে খেলাপী ঋণ নেই। ঋণ আছে তবে এটাও মনে রাখতে হবে সরকার কখনো কাবুলিওয়ালা হতে পারে না। সরকার তো সহায়তার জন্য ঋণ দিয়েছে। কোভিডকালে অনেক অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যবসা-বাণিজ্য খারাপ হয়েছে, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বন্ধ ছিল, সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল, ব্যবসা যেভাবে করার কথা অনেকে করতে পারে নাই। সেগুলোকে রি-শিডিউলিং করতে হয়েছে। সব গেল গেল বলছি কিন্তু সরকার বললেই একজনকে ধরে বেঁধে নিয়ে আসতে পারে না। কারণ সরকারকে অনেক কিছু ভাবতে হয় এবং ভাবা উচিত। তবে আমাদের রেভিনিউ বাড়াতে হবে ট্যাক্স বাড়াতে হবে। এটাতো আইএমএফের বলা লাগে না। আমরা নিজেরাই সচেষ্ট। এবার আমাদের রাজস্ব ১৪% বেড়েছে ছয় মাসে। গতবছর বেড়েছিল ১৬% এবার ২% কম। ব্যবসা-বাণিজ্যের গতির সাথে এটা জড়িত। ব্যবসা-বাণিজ্যে যুদ্ধের কারণে যেহেতু মাঝে একটু ঝামেলা হল, পণ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেল তাই ২% হয়তো কম। তবে এটাতে আমি সন্তুষ্ট না, আমাদের অন্তত বছরে ২০-২২% রেভিনিউ বাড়ানো দরকার। সেটার চেষ্টা হচ্ছে এবং আশা করি বাড়বে। আমরা ট্যাক্স রেট বাড়ানোর চেষ্টা করছি। কর অবকাশ কমিয়ে আনা দরকার-সেটা এখন সরকার ভাবছে কিভাবে কমানো যায়। প্রথম দিকে কর অবকাশ দিয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা করার জন্য-সব দেশেই এটা দেয় উন্নতির প্রথম দিকে।
জুলিয়া: আচ্ছা এত ঋণ খেলাপি যে বেড়ে গেছে সরকারি হিসাবেই? এনিয়ে আপনি কি বলবেন?
ড. শামসুল আলম: ঋণ খেলাপির সংখ্যা বেড়েছে, ব্যবসায়ীর সংখ্যাও বেড়েছে। কয়েকদিন আগেও আমি নাম বলবো না আপনি ডেফিনিটলি জানেন পত্র-পত্রিকায় খবর এসেছে, যে কারা কারা ঋণ দিয়েছে বা ঋণ নিয়ে দিচ্ছে না বা অর্থ পাচারে অভিযুক্ত। বেশ কয়েকজন ধরাও পড়েছে, বিচারের আওতায়ও আছে-এটা আপনি জানেন। এখন পদক্ষেপ কিন্তু দৃশ্যমান। একটা নামকরা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির উদ্যোক্তা ট্রাস্টি বোর্ডে আছেন এমন দুইজনও জেলে আছে দুদকের মামলায়। ব্যাংকের এমডি এবং ম্যানেজাররাও জেলে আছে। পিকে হালদার সহ বহুজনকে কিন্তু ধরা হয়েছে। হয়তো আরো প্রয়োজন কিন্তু যেটুকু হয়েছে সেটা কিন্তু দৃশ্যমান। এতোটা অতীতে দেখিনি এটা আপনাকে স্বীকার করতে হবে।
জুলিয়া: তার মানে সরকার ইনিশিয়েটিভ নিচ্ছে?
ড. শামসুল আলম: নিয়েছে, না হলে ওরাও তো ধনী ও শিল্পপতি, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির উদ্যোক্তা কেমন করে ধরা পড়লো। এরকম আমি বহু উদাহরণ দিতে পারবো। ব্যাংক জালিয়াতি হয় নাই কোন দেশে? কম বেশি জালিয়াতি বহু দেশেই হয়।
জুলিয়া: অন্য দেশে হচ্ছে বলে আমরা হতে দিব?
ড. শামসুল আলম: ওটা আমি বলি নাই। তবে এটা একবারে অদৃশ্যপূর্ব বিষয় না। সেগুলো হয়েছে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। হতাশা ছড়ানো সহজ, বাস্তবে যখন আপনি চালাবেন তখন সেটা কঠিন। যে গাড়ি চালায়, সে যেভাবে চালায়, আপনি পাশে বসে বলতে পারেন ডান দিকে যা, বামে যা, এটা ঠিক হলো না। যে চালায় সে কিন্তু আপনার কথা মতো চালাতে পারবে না। যে দায়িত্বে থাকে সে কিন্তু দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। আমি এটাই বলতে চাচ্ছি অনেক ভাবতে হয় তাকে। অনেক সময় দ্রুত গতিতে যাওয়ার উপায় থাকেনা। সরকারকে করতে হয় সংস্কার বিপ্লব না। আর সংস্কার কিন্তু রাতারাতি হয় না, সংস্কার সব সময় সময় সাপেক্ষ এবং বেদনাদায়ক কষ্টকর।
জুলিয়া: অনেক অর্থনীতিবিদ বলেন যে, সরকারতো নিজে চলে না সরকারকে চালানো হয়।
ড. শামসুল আলম: কে চালায়?
জুলিয়া: প্রভাবশালী গোষ্ঠি। সরকার চাইলেও অনেক কিছু করতে পারছে না কারণ সরকার একপ্রকার জিম্মি। তাই কি?
ড. শামসুল আলম: কি জানি এটা কি ভিত্তিতে বলছেন, আমিতো বুঝি না। বললামতো আমাদের শ্রদ্ধেয় অর্থনীতিবিদরা অনেকেই আশঙ্কাবাদী। আমাদের সাফল্যের দিক এরা বলে না কখনো। বাংলাদেশ ইজ এ ডেভেলপমেন্ট সারপ্রাইজ। এই শব্দটাও অনেকের জানা তবে বাংলাদেশে কোন পত্রপত্রিকায় নেই। আমাদের দেশের সাফল্যের কথা শুনতে হয় পরের কাছে। আপনি বললেন সরকারকে চালায় বাহিরে থেকে। এটাতো আপনার একটা সাধারণ স্টেটমেন্ট। আমি বলব সরকার সরকারই চালায় এজন্যে পার্লামেন্টে বসে ৩৫০ সদস্য, এরা জনগণের প্রতিনিধি হয়ে আসছে। সেখানে দৈনিক আলাপ হচ্ছে, বিতর্ক হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী সব থেকে বেশি পার্লামেন্টে থাকে এবং বঙ্গবন্ধুর পরে এমন প্রধানমন্ত্রী কম দেখা গেছে যে সারাক্ষণ পার্লামেন্টে বসে থাকেন নোট নেন। তিনি পরামর্শ পাচ্ছেন নিচ্ছেন। দুই হলো এত বড় পার্লামেন্ট সক্রিয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, জেলা পরিষদ আছে নির্বাচিত, উপজেলা পরিষদ আছে- যা বিএনপি’র আমলে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল-সেখানে জনপ্রতিনিধি ইউনিয়ন চেয়ারম্যান। রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতো চলমান আছে। এখন বাহিরে থেকে কে চালায় কিভাবে চালাবে আমি বুঝি না।
জুলিয়া: সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছে হয়তো কোন গোষ্ঠীকে লাভবান করার জন্য।
ড. শামসুল আলম: এটা খুবই সাধারণ কথা। কিভাবে চালাচ্ছে আমাকে বলেন। কিভাবে সরকারকে প্রভাবিত করে, সরকারকে প্রভাবিত করতে পারে পার্লামেন্ট। সরকার কেবিনেটে আলাপ করে। বিভিন্ন সমস্যা আলাপ হয় সিদ্ধান্ত নেয়। একনেকে প্রজেক্ট পাস হয়। সেখানে আমলারা বসেন মন্ত্রী সাহেবরা বসেন সেখানে আলাপ-আলোচনা হয়। সেখানে কিভাবে প্রভাব বিস্তার করবে। অদৃশ্যভাবে কাকে প্রভাবিত করবে। বাহির থেকে কিভাবে প্রভাবিত করবে। আমাকে প্রকল্প পাস করতে বিভিন্ন স্তরে আসতে হচ্ছে আলাপ আলোচনায়। একনেকে মিনিস্টার সাহেবরা বসছেন আমলাতন্ত্র আছে। কাজেই বাহির থেকে কেউ চাইলেই শুনে ফেলবে তারা? পররাষ্ট্র নীতি তাতে বাহিরের একজন কিভাবে প্রভাব বিস্তার করবে? সরকার চিন্তা ভাবনা করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কাজ করে-প্রজেক্ট পাসের প্রক্রিয়া আছে, জনপ্রতিনিধিরা প্রজেক্ট নিয়ে আসে আমরা বিচার বিশ্লেষণ করি। হ্যা বলতে পারেন ট্যাক্স বাড়াও কমাও দাবি করতে পারে। তো দাবি তো আসবেই দাবী না হলে সিদ্ধান্ত আসবে কিভাবে।
জুলিয়া: মাননীয় মন্ত্রী, তেল গ্যাস নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে, কেন আমাদের এগুলো বাইরে থেকে আমদানি করতে হচ্ছে, এমন খারাপ অবস্থায় কেন আমাদের পড়তে হলো?
ড. শামসুল আলম: আমাদের দেশে পর্যাপ্ত আছে! কোন সময়টায় আমাদের আমদানি করতে হয়নি সব সময় আমাদের আনতে হয়েছে। ফার্টিলাইজার ঘাটতি তাও সব সময় আনতে হয়েছে। গত ২০-৩০ বছর ধরেই আমরা ইমপোর্ট করছি।
জুলিয়া: এখানেই তো স্বার্থের বিষয়ে অনেক অনেক কথা বলে থাকেন, যাই হোক সেই প্রসঙ্গে না যাই।
ড. শামসুল আলম: না বলেন না, আপনি স্পেসিফিক বলেন। ইমপোর্ট করতে হবে না কোন সরকার ইমপোর্ট করে না? বাংলাদেশ আমদানি নির্ভর কান্ট্রি। আমাদের তেল, ডাল, চিনি আমদানি করতে হয়। এমনকি মাংস এবং গুড়া দুধও আমদানি করতে হয়, মসলা আমদানি করতে হয়। এটা একটা আমদানি নির্ভর দেশ।
জুলিয়া: আমরা সেটা থেকে একটু একটু করে বের হয়ে আসতে পারি না? নাকি আমাদের সারাজীবন আমদানি নির্ভর থাকতে হবে?
ড. শামসুল আলম: সারা জীবন হবে কেন আপনি তো এক জায়গায় স্থির হয়ে কথা বলছেন। আমাদের পেঁয়াজ কোন কোন বছর আমদানি করতে হয় কোনো কোনো বছর হয় না। উৎপাদন অনেক বাড়িয়েছি আমরা। আপনি স্ট্রবেরি ঢাকায় বসে খাচ্ছেন- আগে স্ট্রবেরি আমদানি হতো এখন দেশে হয়। বহু খাতে আমদানি কমেছে। তবে জনসংখ্যা বেড়েছে সাত কোটি থেকে সতেরো কোটি। এত বড় জনগোষ্ঠীর খাদ্য আমদানি করা ছাড়া উপায় কি। এটাতে দোষের কি হলো আমদানি করবেন, সম্পদ বাড়াবেন, টাকা বাড়বে রপ্তানি করবেন। আমদানি করায় দোষের কিছু নাই।
জুলিয়া: আইএমএফ এর শর্ত মেনে ভর্তুকি কমানোর জন্য সরকার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ালো, সেটা বেশ দ্রুততার সাথেই দেখলাম হলো যখন মূল্যস্ফীতিতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে।
ড. শামসুল আলম: না একদমই না নাভিঃশ্বাস ওঠে নাই। এখন সবকিছুই চলছে, কষ্ট হচ্ছে দাম বেড়েছে। নাভিঃশ্বাস উঠলে আপনার ড্রেসে কি কোনো কম পড়ছে, কারো খাদ্যে কোন কম পড়ছে! হাট বাজারে মানুষের ক্রয় কমেছে?
জুলিয়া: মাননীয় প্রতিমন্ত্রী মানুষ দিশেহারা হয়তো হয় নাই এখনো তবে তারা এখন অনেক কষ্টে আছে।
ড. শামসুল আলম: সবাই না, কষ্ট একটু হবেই, দরদাম বাড়ছে। এটা শুধু বাংলাদেশ না সারা দুনিয়াতেই চলছে এই কষ্টের সময় সেটা আপনাকে বুঝতে হবে। এটা কি আমার একার সমস্যা, সমস্যাতো বহিরাগত। বাংলাদেশে ক্রিয়েটেড না এটা। এটাই আপনাকে বুঝতে হবে, সান্ত্বনা দিতে হবে। সরকারের অগোচরে হতো তাহলে আমি মেনে নিতাম। মানুষের কষ্ট হচ্ছে দাম বেড়েছে, দাম বাড়লো এটা সরকারের কি করার ছিলো। কেন ৬৫ ডলারের জ্বালানি তেল ১৪০ ডলারে উঠলো। এখানে সরকারের কি দোষ? কেন আপনার চিনির দাম ৪৭% বেড়ে গেলো। এটা বাহির থেকে আমদানি হয় এখানে সরকার কি করলো।
জুলিয়া: এমনিতেই কষ্টে আছে মানুষ এরপরও আইএমএফ এর চাপে বিদ্যুতের দাম স্বল্প সময়ে তিন বার বাড়ানো হলো। এতে সরকারের রাজনৈতিক দায় কি প্রশ্নবিদ্ধ হয় না?
ড. শামসুল আলম: রাজনৈতিক দায়? সরকারতো কোনো কিছু ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। কারণ এটা বাহিরের থেকে আসা। দাম বাড়ালেই অপরাধ হবে? অনেক জিনিসের দাম কমেছেও। দাম উঠানামা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আমাদের গ্যাসে কি আমাদের চলে? এলএনজি দাম বহুগুণে বেড়েছে। এমন কোন সরকার আছে দাম না বাড়িয়ে পারতো? আমাকে বলেন- কি করে পারতো? এখন কল্পনা করলে তো অনেক কল্পনাই করা যায়।
জুলিয়া: আইএমএফ ঋণের প্রথম কিস্তি ইতিমধ্যে বাংলাদেশ পেয়ে গেছে। কিস্তি পাওয়ার পরদিনই বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট একাত্তরকে বলেছেন যে, এই ঋণ ব্যবহারের জন্য সরকারের কার্যকর পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি দেখতে পাননি তিনি।
ড. শামসুল আলম: উনি না দেখতে পারেন কারণ উনিতো আর সরকার চালাচ্ছেন না। বাইরে থেকে কেউ নাই দেখতে পারেন। আমরা ভেতর থেকে দেখতে পাই সরকার যা নিচ্ছে এলোপাথাড়ি না। প্রত্যেকটা ব্যয়ের খাত আছে কোথায় কোনটা লাগাবেন। বিশ্ব ব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট যাই বলেন আইএমএফ কিন্তু দক্ষ এদের চেয়ে কম নয়। আপনাদের বুঝতে হবে আইএমএফ ওয়ার্ল্ড ব্যাংক অর্থের বিষয়ে দক্ষ, অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে তারা দক্ষ। সেই আইএমএফ বোকার মতো দিয়ে দিয়েছে আর আমি কিছু দেখতে পারছি না, দেখার দরকার তো নাই। কারণ উনি দেখতে পাবেনও না। দেখবেন যিনি দায়িত্বে আছেন- প্লেন যে চলে পাইলটকে কি সবাই দেখতে পায়! পাইলটের কাজ পাইলট করে যায়। আমি যেটা বলবো সুনির্দিষ্ট ভাবে আইএমএফ কে বোঝানো গেছে যে এই টাকাটা দরকার। তারা বিচার বিশ্লেষণ করে টাকাটা দিয়েছে এবং দ্রুত দিয়েছে। যা চেয়েছি এর থেকে বেশি দিয়েছে। এত সহজ না যে আপনি চাইলেন আর দিলেন। গত আড়াই বছর বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং কমে নাই। তার মানে বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা দক্ষতা মানসম্মত এবং কাঙ্খিত। না হলে আইএমএফ এর কি ঠ্যাকা পড়লো আমাদের টাকাটা দিয়ে দিবে।
জুলিয়া: আমরা একটু জানতে চাই এই ঋণটা কোথায় কোন খাতে কিভাবে ব্যয় হবে-ব্যবহারটা কিভাবে হতে পারে।
ড. শামসুল আলম: বাজেটের বিভিন্ন খাতে ব্যয় হবে। আমাদের শিক্ষা খাতে ব্যয় করা হবে প্রজেক্ট স্পেসিফিক টাকা আসে, থোক বরাদ্দ দেওয়া হয় না-এইটুকু আপনি বুঝলেই হবে। প্রত্যেকটা কাজে ডিফাইন করা আছে। আমরা যে উন্নয়ন প্রকল্প এডিপি বাস্তবায়ন করি তার ৪০ ভাগই বাহিরের সহায়তা। এখন বাজেট সহায়তা হিসেবে দিচ্ছে, বাজেটের কোন কোন খাতে ব্যয় করবে জেনেছে ওরা। কারণ টাকাটা ফেরত দিতে পারবো কিনা এটা এসেস না করে টাকা দিবে না। এমন টাকা দেয় না কোথাও তারা।
জুলিয়া: একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বলেছেন যে আইএমএফ ঋণ নিয়ে কোন দেশ সংকট কাটিয়েছে এমন উদাহরণ নেই বরং দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ আরো বেড়েছে। তাহলে এই ঋণ কি আমাদের বোঝা হয়ে যাবে না?
ড. শামসুল আলম: এমন যদি হতো তাহলেতো আইএমএফ এর দোকানপাট উঠিয়ে ফেলতে হতো অনেক আগেই। ১৯৪৫ এর পরের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে এই প্রতিষ্ঠান বসে পড়তো, লাভজনক না হলে প্রতিষ্ঠান টিকে থাকলো কি করে! এটা একেবারেই সাধারণ সরলীকরণ। কোনো দেশই যদি সংকট কাটাতে নাই পেরে থাকে, তাহলে আইএমএফ এর ঋণ দেওয়া বন্ধ হয়ে যেতো। আইএমএফ এর একটা মূল্যায়ন হয়। আইএমএফ এর পুঁজি যারা দিয়েছে তারা কড়া নজরে রাখে ঠিক মতো যাচ্ছে কিনা। বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে যারা ব্যর্থ হয়েছে। আইএমএফ ব্যার্থ হয় নাই তার মানে কি। কোথাও সংকট কাটাতে পারে নাই তাহলে আইএমএফ এর চলতে পারার কথা না, সেই অর্থনীতিবিদের মন্তব্য অনুসারে। আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংক চালু আছে এজন্যে যে এগুলো যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে।
আর ঋণ বোঝা হয়ে যাবে কেনো? বোঝা হত যদি আমরা সীমা ছাড়িয়ে যেতাম। বোঝা কখনোই হয় না যদি আপনি ঋণ এনে ঠিকমতো ব্যবহার করেন এবং তার আয় ব্যয় হিসাব করে আনেন, মূল্যায়ন করে আনেন। বাংলাদেশ বিচার বিশ্লেষণ করে ঋণ নিয়ে থাকে যে কারণে বাংলাদেশকে কখনো ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হতে হয়নি। সেই অর্থনীতিবিদকে আপনি জিজ্ঞাসা করুন যে ঋণ বোঝা হলে ৫১ বছরে একবারও বোঝা ঝেঁকে বসলো না কেন? একবারও তো রিশিডিউলিং করতে হয়নি কি কারণে? তার মানে আমাদের দক্ষতা আছে ঋণ ব্যবহারের- এই কথাটা বিশ্বাস করতে হবে। এটা আপনার বুঝতে হবে বাস্তবতা। কিছু মনে করবেন না অনেকে ভাবে মাইক্রোফোন কাছে পেয়েছি, মিডিয়া কাছে পেয়েছি একটা জনপ্রিয়তা আসুক, আমার নামটা উল্লেখিত হোক, ছবিটা উঠুক এই লোভটা সামলাতে পারি না অনেকেই তাই পপুলিস্ট কথা বলি।
জুলিয়া: সরকারের বিদেশি ঋণ ফিন্যান্সিয়াল ক্রেডিট কিন্তু পলিটিকাল ডিসক্রেডিট। একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে আমি আপনাকে এ প্রশ্নটি করছি-এই ডিসক্রেডিটের বিষয়টি কিভাবে দেখেন?
ড. শামসুল আলম: না, ঋণ নেওয়া ডিসক্রেডিট না। এটা একটা রক্ষণশীল দৃষ্টিকোণ থেকে বলছেন। ঋণ নেওয়া যদি ডিসক্রেডিট হয় আবার আপনাকে বলি, জাপান তার দেশজ আয়ের দ্বিগুন ঋণ নেয় কিভাবে? সিংগাপুর নেয় কিভাবে। এই ধারণাগুলো গতানুগতিক, প্রথাগত এবং সঠিক নয়। এগুলো একসময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বলা হতো যে ঋণ বোঝা-অর্থনীতি চালাতে হলে ঋণ নিতেই হবে।
জুলিয়া: সরকারি হিসেবে মূল্যস্ফীতি কমেছে। এ নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ?
ড. শামসুল আলম: শুধু আমাদের হিসাবে না। ওয়ার্ল্ড কমডিটি প্রাইস দেখেন বিশ্বেও কমছে। আমাদের এখানেও কমছে। সরকারি হিসাবতো অনুসরণ করবেন না তাইলে নিজেরা হিসাব করে বের করেন।
জুলিয়া: আমরা প্র্যাকটিক্যালি কি বুঝতে পারি যখন কেনাকাটা করতে যাই?
ড. শামসুল আলম: নিজেরা কেনাকাটা করতে গিয়ে যদি বুঝে ফেলেন তাহলেতো অর্থনীতি শাস্ত্রের দরকার হতো না। হিসাবটা আমাদের না, এটা জাতিসংঘের প্রণীত পদ্ধতি অনুসরণে হিসাবটা কষা হয়। এই হিসাব করার জন্য বাইরের অনেক ইকোনোমিস্টও আমাদের কমিটিতে আছে- এই বিশেষজ্ঞ কমিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও ৪-৫ জন ইকোনোমিস্ট আছেন। তারা কিন্তু এই পদ্ধতিটা দেখেন। ইনফ্লেশনে কি কি ধরা হলো, কি প্রক্রিয়ায় তথ্য নেওয়া হলো তা আমরা একটা আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করে বের করি।
জুলিয়া: উৎপাদক যারা আছেন তারা কিন্তু বলছেন যে মানুষ কিনতে পারছে না বলে পণ্যের চাহিদা কমে যাচ্ছে।
ড. শামসুল আলম: কিনতে পারছে না এটা কি দিয়ে প্রমাণ করবেন? এটাতো আবার সাধারণ স্টেটমেন্ট। কিভাবে আমি বুঝবো, কোনটা ঘাটতি পড়ছে। স্কুলে ছেলেমেয়ে কি কমে যাচ্ছে? ইউনিফর্ম পড়ে আসা এটা কি কমে গেছে? মোবাইল ফোন কি কমে গেছে? এক বেলা খাবার কমেছে কোথাও? কষ্ট হচ্ছে দাম বাড়ায় কিন্তু আপনারা যেভাবে বলেন অতোটা হওয়ার কথা না। অতোটা হলেতো এটা বাহিরে প্রকাশ পেতো।
জুলিয়া: হ্যাঁ হয়তো এখনো কিনছে কিন্তু ধরুন নিম্ন মধ্যবিত্ত ভোক্তার খাবারের তালিকা যদি বলি- প্রতিদিন তারা এখন যে খাবার কিনতে পারছে সেটিতে আগের মতো পর্যাপ্ত পুষ্টি হচ্ছে না। আর পণ্যের দাম বেশি হওয়ায় অনেকেরতো সঞ্চয় ভেঙে ভেঙে খেতে হচ্ছে। তাই নয় কি?
ড. শামসুল আলম: মূল্যস্ফীতি বাড়ছে এটা আমি স্বীকার করছি তবে এটা কমে যাবে আমরা আশা করছি, আমরা একটা স্থিতিশীল অবস্থায় চলে যাবো। এখন মূল্যস্ফীতি ৪ মাস ধরে কমছে তাও ভালো লাগে না আপনাদের, মজুরি হার বাড়ছে এটাও ভালো লাগে না। আমরা কেমনে আপনাদের বোঝাবো। মূল্যস্ফীতি কমছে এবং কমবে ক্রমান্বয়ে। স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির পথে ফিরে যাব আমরা যত দ্রুত সম্ভব। এই সংকটতো বিশ্ব সংকট। সরকারের অব্যবস্থাপনার কারণেতো সংকট হয়নি। সংকট যদি হতো তাহলে আমাদের এই যে মাথাপিছু আয় কতো বেড়েছে? মাথাপিছু আয় এখন ১৭৯৩ হলো কিভাবে? বলতে পারেন মাথাপিছু আয় কি সবার বেড়েছে? হ্যা বেড়েছে- কারো বেশি বেড়েছে, কারো কম বেড়েছে কিন্তু বেড়েছে। এই হিসাবতো শুধু সরকারের হিসাব না আইএমএফ বা ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের হিসাব। তারপরও আমরা হায়হুতাশ করছি। কিনতে পারে না, কিনতে পারে না। আয়তো কিছু কমবেই, যেহেতু মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। তা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসবে।
জুলিয়া: আমরা সেই ব্যাখ্যাটাই জানতে চাচ্ছি।
ড. শামসুল আলম: আমি তথ্য উপাত্ত ভিত্তিক কথা বলছি। কোনো কথা আমার নিজস্ব সৃষ্টি না। মন্তব্য করছি হাতে তথ্য উপাত্ত নিয়ে এবং সেইগুলো কিন্তু আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের। আমাদের দেশে ১৫ বছরের উপরে মহিলারা ৩৬ জন কাজ করে ১০০ জনের মধ্যে, ভারতে করে ২০ জন, পাকিস্তানেও ২০ জন। এটা আমাদের শক্তির জায়গা যে সব মানুষ কাজ করছে। গ্রামে বেকারত্ব নাই আপনি যান চেক করেন। কৃষিতে শ্রমিক পাওয়া যায় না। ৮০০/৯০০/১০০০ টাকা করে আয় দিনে। অনলাইনে সারা বাংলাদেশে সাড়ে ৬ লক্ষ লোক আয় করছে। অনলাইনে বিজনেস প্রসেস ও সফটওয়্যার তৈরি করে দিচ্ছে যারা এইট পাশ থেকে গ্র্যাজুয়েট। ৬৫ হাজার কোটি টাকা বছরে আয় করছে। পৃথিবীর ১৫ তম আউটসোর্সিং দেশ এখন বাংলাদেশ। এই ভেতরের শক্তিগুলো প্রকাশ পায় না। হা হুতাশ শুনবেন, আশংকা শুনবেন। আমাদের অনেক শ্রদ্ধেয় অর্থনীতিবিদের কাছে এই শক্তির খবর পাবেন না। বহু ছেলেমেয়ে ব্যাংকিং এজেন্ট হয়ে আছে দোকানপাট চালাচ্ছে, ব্যবসা বাণিজ্য করছে। চাকরি করতে চাইলে মাস্টার্স পড়ে এখন আর চাকরি হবে না। আপনি আর্টস পড়লেন কেনো? আপনি ইসলামি ইতিহাস পড়লে এখন চাকরি পাওয়ার কথা না। এখন বাজার উপযোগী বা প্রযুক্তি জানতে হবে। আর চাকরি যদি অভাব হতো ৬ লক্ষ লোক বাহির থেকে এসে চাকরি করতো কিভাবে। শ্রীলঙ্কা, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান থেকে। আমরা যোগ্য লোক পাচ্ছি না। লেখাপড়ার সাথে চাকরি চাহিদা মিল পাচ্ছি না। এ ক্ষেত্রে সরকারের অবশ্যই দায় আছে তবে ব্যক্তি নিজে সিদ্ধান্ত নিবে আমি কি পড়বো। সাবজেক্ট কোনোটাই খারাপ না-বাজার উপযোগী কিনা দেখতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় অবশ্যই ত্রুটি ছিলো। আমি এটা অস্বীকার করবো না। আমরা ২০০৯ তে যখন শেখ হাসিনা সরকারে তখন ৩% ছিলো কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত এখন ১৯%। আমরা ফ্যাশন, টেক্সটাইল, মেরিন ইউনিভার্সিটি খুলেছি, প্রচুর মেডিকেল কলেজ চালু করেছি, নার্সিং ইন্সটিটিউট করেছি, যুগোপযোগী শিক্ষা বাজার চাহিদা যেনো মেটে। গ্রামেও কেউ বসে নেই যারা এই শিক্ষা নিয়েছে তাদের চাকরির কোনো অভাব নেই। বিবিএ পড়ে গিয়ে ডেইরি ফার্ম চালাচ্ছে বসিলায় গিয়ে। প্রচুর ছেলেপেলে অফিস সাপ্লাই দিচ্ছে ছাত্র অবস্থায়ই তারা ব্যবসা করছে। মানুষ এখন শহর থেকে গ্রামে মানুষ চলে যাচ্ছে অভাবে না, কর্মের সুযোগ গ্রামে বেশি।
জুলিয়া: শেষ প্রশ্ন-অনেক বিষয়ে কথা হলো কিন্তু একটি বিষয় কি আপনি মানবেন যে দেশে ধনীরা আরো বেশি ধনী হচ্ছে?
ড. শামসুল আলম: এটা কথা কিন্তু খুবই সত্য। ধনী হয়ে যাচ্ছে। ধনী কিভাবে হয়, এই যে ২০% আমাদের দরিদ্র তারা কিন্তু কোন বিনিয়োগ করছে না, তাদের পুঁজি নাই-এদের কোনো আয় বাড়ছে না। বাকী যে ৮০% তার মধ্যে ৪০% বিনিয়োগ করছে। বিনিয়োগ করলে মুনাফা কারা পাবে? যে বিনিয়োগ করলো সেই টাকা পাবে। অর্থনৈতিক তত্ত্ব এটা আমার কথা না, বিনিয়োগের মধ্যেইতো আয় বাড়ে কর্মসংস্থান হয়। ধনীরা বিনিয়োগ করলে তাদের আয় বেশি হবে না, আপনার আমার থেকে। সেই জন্য একটা আয় বৈষম্য বেড়ে যায়। সেটা মোকাবেলা করতে আমরা সচেতন। আয় বৈষম্য বাড়লেইতো হবে না। গরীবদের রক্ষা করতে হবে। সুযোগ দিতে হবে এবং সবাইকে সমান সুযোগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা শিক্ষাকে যত সম্ভব প্রসারিত করছি। এই সরকার ৪৩টি পাবলিক ইউনিভার্সিটি চালাচ্ছে। টেকনিক্যাল এডুকেশনের ব্যবস্থা করছি। স্কুলে এই যে প্রাইমারি, সেকেন্ডারিতে মায়ের কাছে বৃত্তি চলে যায়, বিনা পয়সায় বই যায় এটা কি জন্য? গরীবেরা যেন উঠে আসতে পারে। এই প্রচেষ্টা আমাদের আরও বাড়াতে হবে। তবে আপনি ঘাবড়ে যাবেন না, আমাদের থেকে আয় বৈষম্য অনেক বেশি এখন আমেরিকাতে, ইন্ডিয়াতে আয় বৈষম্য আমাদের থেকে বেশি, আয় বৈষম্য জাপানেও আছে এমনকি রাশিয়ায় আমাদের থেকে অনেক বেশি। যারা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র করলো সেসব দেশেওতো আয় বৈষম্য আছে। শুনেন, মেধার বৈষম্য, উদ্যোগের বৈষম্য, বুদ্ধিমত্তা বৈষম্য থাকলে এই বৈষম্য থাকবেই। যেটা থাকা উচিত তা হলো সমান সুযোগ যা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। বৈষম্যহীন সমাজ কি আছে, দুনিয়াতে আছে? তাহলেতো সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়তো না, তারা চেয়েছিলো বৈষম্যহীন সমাজ। কোনো বৈষম্য থাকবে না এটা করতে গিয়ে আদর্শিক রাষ্ট্র ভেঙে গেল। সমাজে মানুষের প্রত্যেকের মধ্যে পার্থক্য আছে উদ্যোগে, বুদ্ধিমত্তায় ও প্রতিভায়। যার প্রতিভা আছে সে বেনিফিট আগে পাবে। প্রচেষ্টা আছে আরো জোরদার করতে হবে। তবে সুযোগের যেন বৈষম্য না থাকে।
জুলিয়া: আপনাকে ধন্যবাদ।