বিচারকের বিচারেও ভুল! তাও আবার হত্যা মামলায়। যে মামলায় আইন অনুযায়ী আসামিকে ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ৩৪২ ধারায় যথাযথভাবে পরীক্ষা না করেই দিয়েছেন ফাঁসির রায়; সেই রায়ের দণ্ড সংশোধন (মডিফিকেশন) করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আসামিকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ বুধবার আসামির আপিল খারিজ করে এ রায় দেয়।
প্রধান বিচারপতি বলেন, অধস্তন আদালতে বিচারের সময় আসামিকে সঠিকভাবে পরীক্ষা না করা ছিল জজের বড় ধরনের ভুল। মামলাটি ২০০৫ সালের। এই ভুলের কারণে এখন যদি মামলাটি রিমান্ডে (পুনর্বিচার) পাঠানো হয়, তাহলে বিচার শেষ হতেই আরো ১৫ বছর লেগে যাবে, যেখানে এই আসামি ১৬ বছর ধরে আছেন কারাগারে। এর পরই আপিল বিভাগের সব বিচারপতির সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে মামলাটি ঐ ট্রাইব্যুনালে পুনর্বিচারে না পাঠিয়ে দণ্ড পরিবর্তন করে দেন। প্রধান বিচারপতি ছাড়াও বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি মো. ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান, বিচারপতি আবু বকর সিদ্দিকী ও বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
এ প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এ এম আমিন উদ্দিন ইত্তেফাককে বলেন, ট্রাইব্যুনালের বিচারক ৩৪২ ধারায় আসামিকে সঠিকভাবে পরীক্ষা করেননি। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন আসামি। কিন্তু উক্ত ধারায় পরীক্ষা করার সময় সেটাও আসামির নজরে আনা হয়নি। দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রত্যাহারের বিষয়েও সেখানে কিছু বলা হয়নি। এ কারণে আপিল বিভাগ মনে করেছে, মামলার বিচারে ভুল হয়েছে। এই কারণে মামলাটি পুনর্বিচারে না পাঠিয়ে সবকিছু বিচারবিবেচনা করে আপিল বিভাগ আসামির দণ্ড সংশোধন করে দিয়েছে।
মামলার বৃত্তান্ত
যৌতুকের কারণে ফরিদপুরের বোয়লমারীর কালিমাঝিতে ২০০৫ সালের ১৮ আগস্ট রাতে স্ত্রী আকলিমাকে হত্যা করেন তার স্বামী মহসিন মোল্লা। এ ঘটনায় পরদিন নিহতের দাদা হাবিবুর রহমান থানায় মামলা দায়ের করেন। আসামিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে স্ত্রী হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। পরে সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ২০০৬ সালের ১৮ এপ্রিল মোহসীনকে মৃত্যুদণ্ড দেন ফরিদপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. আফজাল হোসেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(ক) ধারায় এই দণ্ড দেওয়া হয়। ৩৪২ ধারায় পরীক্ষা করার সময় বিচারক আসামিকে বলেন, ‘আপনি রাষ্ট্রপক্ষে আনীত সাক্ষীদের জেরা ও জবানবন্দি শ্রবণ করেছেন। এ বিষয়ে আপনার জবাব কী? নির্দোষ বলে জানান আসামি। কোনো সাফাই সাক্ষী বা কোনো কিছু বলবেন কি না? জবাবে আসামি না সূচক উত্তর দেন। কিন্তু বিস্তারিত কিছুই এখানে উল্লেখ করেননি বিচারক। পরে রায়ে আসামিকে ফাঁসি দেওয়া হয়। এই রায় ২০১২ সালে বহাল রাখে হাইকোর্ট। মৃত্যুদণ্ডের এই রায়ের বিরুদ্ধে জেল আপিল করেন আসামি।এই জেল আপিলের শুনানিতে আসামিকে যথাযথভাবে পরীক্ষা না করার ট্রাইব্যুনালের বিচারকের ভুলের বিষয়টি উঠে আসে। বিচারকের এ ধরনের ভুলে মামলা পুনর্বিচারে পাঠানো উচ্চ আদালতের বিভিন্ন নজির আপিল বিভাগের সামনে তুলে ধরেন আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত কৌঁসুলি হেলালউদ্দিন মোল্লা।
তবে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন শুনানিতে বলেন, এই আসামি দরিদ্র। বিচারের প্রতিটি ধাপে তাকে লিগ্যাল এইড দিতে হয়েছে। আসামির আইনজীবী নিয়োগের কোনো সামর্থ্য ছিল না। এখন মামলাটি পুনর্বিচারে পাঠালে ১০-১৫ বছর লেগে যাবে বিচার শেষ হতে।
ই পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, রেকর্ডে দেখা যাচ্ছে, আসামি ১৬ বছর ধরে কারাগারেই আছেন। এর মধ্যে কনডেম সেলে ১৫ বছর। আমাদের এখানে যাবজ্জীবন ৩০ বছর। কিন্তু সাজা ভোগ করতে হয় সাড়ে ২২ বছরের মতো। কিন্তু ভারতে ১৫ বছরের মতো। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, পুনর্বিচারে পাঠালে ওর (আসামি) জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে।
হেলালউদ্দিন মোল্লা বলেন, মাই লর্ড, আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়ার জন্য আর্জি জানাচ্ছি। শুনানি শেষে দেশের সর্বোচ্চ আদালত দণ্ড সংশোধন করে ফাঁসির সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেয়। একই সঙ্গে ৫ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে ১৫ দিনের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়। আসামি সিআরপিসির ৩৫(ক) ধারার সব সুবিধা পাবেন বলে আদেশে বলা হয়। এ ছাড়া কনডেম সেল থেকে দ্রুত স্বাভাবিক সেলে স্থানান্তরের জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয় আপিল বিভাগ।