করোনা মহামারির দুই বছরে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যক্ষেত্রে নানা সংকট তৈরি হয়েছে। দামের লাগাম হারিয়েছে বিভিন্ন পণ্য। এর মধ্যে ভোগ্য পণ্যের বাজারে অস্থিরতা সাধারণ মানুষের বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। আর এই সংকট পুঁজি করে দেশের বাজারে চলছে অরাজক অবস্থা। গত এক বছরে ১০ থেকে ৬০ শতাংশ দাম বেড়েছে চিনি, ভোজ্য তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশির ভাগ আমদানি করা ভোগ্য পণ্যের। এ অবস্থায় স্থানীয় বাজার নজরদারির জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আইন ১৯৫৬ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে বিদ্যমান আইনেরই যথাযথ প্রয়োগ নেই। এ অবস্থায় আইন সংশোধন সমস্যার সমাধান দেবে না। এ জন্য দরকার আইনের যথাযথ প্রয়োগ। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, বাজার ব্যবস্থাপনা, তদারকির জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেল, বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের দ্রব্যমূল্য মনিটরিং সেল, খাদ্য অধিদপ্তর, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদসহ সরকারের একাধিক বিভাগ ও প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু মাঝেমধ্যে বাজার পরিদর্শন, শহরাঞ্চলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কিছু অভিযান-জরিমানার মধ্যেই তাদের কর্মতৎপরতা সীমাবদ্ধ।
বাজারে অতিরিক্ত মুনাফাকারী, অননুমোদিত পরিমাণে পণ্য গুদামজাতকারী, অবৈধ আড়তদার, সংগঠিত সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজ থেকে শুরু করে খুচরা ব্যবসায়ী পর্যন্ত যারা নানা উপায়ে পণ্যের দাম অস্থিতিশীল করে—তাদের প্রতিরোধে এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার জন্য নতুন-পুরনো আধা ডজনেরও বেশি আইন আছে। পুরনো আইনগুলোর মধ্যে দি এসেনশিয়াল আর্টিক্যালস (প্রাইস কন্ট্রোল অ্যান্ড অ্যান্টি-হোর্ডিং) অ্যাক্ট ১৯৫৩, দ্য কন্ট্রোল অব এসেনশিয়াল কমোডিটিস অ্যাক্ট ১৯৫৬, অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদি নিয়ন্ত্রণ আদেশ ১৯৮১, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ ২০১১ অন্যতম। কিন্তু এসব আইন এখন অনেকটাই ‘কাগুজে বাঘ’। নতুন আইনের মধ্যে ভোক্তা অধিকার আইন ২০০৯, নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩, প্রতিযোগিতা আইন ২০১২, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিধিমালা ২০২০ অন্যতম।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অস্থির বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিচ্ছে। এর অংশ হিসেবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের স্থানীয় বাজারে কারসাজি ঠেকাতে এবং ভোগ্য পণ্যের দাম ভোক্তাদের নাগালের মধ্যে রাখতে দ্য কন্ট্রোল অব এসেনশিয়াল কমোডিটিস অ্যাক্ট ১৯৫৬ সংশোধন করে দ্য কন্ট্রোল অব এসেনশিয়াল কমোডিটিস অ্যাক্টস ২০২১ করা হচ্ছে। সে লক্ষ্যে আজ ২৬ অক্টোবর অংশীজনদের নিয়ে বৈঠকে বসছে মন্ত্রণালয়।
রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের তথ্যে দেখা যায়, গত এক বছরে বিশ্ববাজারে পরিশোধিত চিনির দাম বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। আর অপরিশোধিত চিনির দাম বেড়েছে প্রায় ৫৫ শতাংশ। পরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ৭১ শতাংশ; অপরিশোধিত পাম অয়েলের দাম বেড়েছে প্রায় ৮০ শতাংশ।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, গত এক বছরে চালের দাম প্রায় ১১ শতাংশ, আটা-ময়দা ১৭ শতাংশ, সয়াবিন তেল ৫১ শতাংশ, পাম অয়েল ৫৮ শতাংশ ও চিনির দাম প্রায় ৬০ শতাংশ বেড়ে গেছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ায় দেশের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এমন অবস্থায় বাজার স্থিতিশীল রাখতে খুব বেশি কঠোর হওয়ারও সুযোগ নেই। কেননা তেল, চিনির মতো পণ্যগুলো পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। বিদেশে দাম না কমলে দেশের বাজারেও দাম কমিয়ে আনা কঠিন। তবে ব্যবসায়ীরা বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে কারসাজি করছে—এমন তথ্য পেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হবে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কিভাবে ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দাম সহনীয় রাখা যায় সে বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, স্থানীয় বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে কিছু ভোগ্য পণ্যে শুল্ক নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে এমন উদ্যোগ গ্রহণের উদাহরণ রয়েছে। দেশটি সম্প্রতি প্রজ্ঞাপন জারি করে পাম তেলের দাম কমিয়েছে। এর ফলে দেশটির আমদানিকারকরা বেশি বেশি পাম তেল আমদানি করছে। সে সুবাদে দেশটির স্থানীয় বাজারে পাম তেলের দাম স্থিতিশীল রয়েছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি জসিম উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, কভিডের ধাক্কা কাটিয়ে বৈশ্বিক পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসছে। ফলে দেশে দেশে চাহিদা বাড়ছে খাদ্যপণ্যের। এ ছাড়া রাশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ শস্য উৎপাদনকারী উল্লেখযোগ্য দেশগুলোতে ডাল ও গমের মতো শস্যের ফলন কম হয়েছে। একই সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ৮০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কনটেইনার সংকট। তেলের দাম ও কনটেইনার সংকটের ফলে বেড়েছে জাহাজ ভাড়া। সব মিলিয়ে ভোগ্য পণ্যের বিশ্ববাজার এখন নাগালের বাইরে।
জসিম উদ্দিন বলেন, এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য পরিস্থিতি সম্পর্কিত নির্ভরযোগ্য তথ্য আমদানিকারক ও ভোক্তাদের দ্রুত জানানোর উদ্যোগ নিতে হবে। পণ্যের এলসি খোলা এবং এর সেটেলমেন্ট নিয়মিত তদারকিতে রাখতে হবে। একই সঙ্গে খোলাবাজার জোরালো তদারকি ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার আওতায় নিতে হবে। এ ছাড়া তিনি স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্য সরবরাহের জন্য উৎপাদনকারীদের স্বল্প সুদে ঋণ, কৃষি খাতে ভর্তুকি বৃদ্ধি এবং নিয়মিত নজরদারির আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছেন।
এফবিসিসিআই সভাপতি সম্প্রতি বাজার পরিস্থিতির ওপর এক মতবিনিময়সভায় ব্যবসায়ীদের সুযোগের অপব্যবহার না করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা লাভ করবেন, এটা ঠিক। কিন্তু এত লাভ করতে হবে কেন? আমরা এমন কিছু করব না, যাতে পুরো ব্যবসায়ী সমাজের ওপর বদনাম চলে আসে।’ হঠাৎ পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধিকে ‘ব্যবসায়ীদের কারসাজি’ বলে আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘পেঁয়াজের আমদানি শুল্ক যেদিন প্রত্যাহার করা হলো, সেদিন বিকেলেই কেজিতে ১০-১৫ টাকা দাম কমে গেল। শুল্কমুক্ত সুবিধায় পেঁয়াজ আমদানির আগেই দাম কমানোর মানে হলো দামটা আগেও কমানোর সুযোগ ছিল।’
সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ১৯৬৪ সালের অ্যাগ্রিকালচারাল প্রডিউস মার্কেটস রেগুলেশন অ্যাক্ট ও ১৯৮৫ সালের সংশোধিত বাজার নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৬(১) ও ১৬(২) ধারা মতে কৃষিজাত ও ভোগ্য পণ্যের ক্রয়মূল্য, বিক্রয়মূল্য ও মজুদ পরিস্থিতি তদারকির ক্ষমতা রয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের বাজার কর্মকর্তাদের। তাঁরা সাধারণত আইনটির প্রয়োগ করেন না। তা ছাড়া ১৯৫৬ সালের মজুদবিরোধী ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইনে পরিষ্কার নির্দেশনা রয়েছে যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কতটুকু মজুদ করা যাবে। আইনটিতে উৎপাদক, ভোক্তা ও বিক্রেতা উভয়ের স্বার্থ সংরক্ষণেও ব্যবস্থা রয়েছে। তা ছাড়া অ্যান্টি-হোর্ডিং অ্যাক্ট ও এসেনশিয়াল কমোডিটিস অ্যাক্ট মডিফাই করে ২০১১ সালে ১১৩ নম্বর এসআরওতে, বিশেষ করে মজুদবিরোধী আইনটি আরো কঠোর করা হয়। সেটিও কার্যকর হয় না।
খাদ্য অধিদপ্তর, বাজার কর্মকর্তা ও মনিটরিং সেল সূত্র জানায়, দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য সরকার বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়েছে; কিন্তু মাঠে কার্যকর হচ্ছে না। বাজার কর্মকর্তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জেলা-উপজেলার বাজারে গিয়ে মূল্য তালিকা টাঙানো হয়েছে কি না, ক্রয়-বিক্রয় রসিদ ব্যবহার হচ্ছে কি না, কোন পণ্যের কত মূল্য—সাধারণত এসব দেখে থাকেন। মাঠ পর্যায়ের একজন বাজার কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে এর বাইরে সাধারণ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের সুযোগ বাজার কর্মকর্তাদের হাতে নেই।