বাঁধ নেই, তলিয়ে গেল ১১৩ হেক্টরের ফসল

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোনায় নদ-নদীর পানি বেড়েছে। ধনু নদঘেঁষা খালিয়াজুরী উপজেলার কয়েকটি হাওরের শতাধিক একর জমির আধাপাকা বোরো ধান তলিয়ে গেছে। সুনামগঞ্জে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ হুমকির মুখে। আতঙ্কিত কৃষকরা স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধে মাটি দিয়ে পানির চাপ আটকানোর চেষ্টা করেছেন।

পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বাঁধের ভেতরের প্রায় ২১ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন হাওরাঞ্চলের কৃষকরা। জানা গেছে, নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলার কীর্তনখোলা হাওর, বাদিয়ারচর, ডাকাতখালী, মনিজান, লেবরিয়া, হেমনগর, বাগানী, নয়াখালসহ কয়েকটি হাওরের kalerkanthoধনু নদঘেঁষা নিম্নাঞ্চলে কোনো বাঁধ ছিল না। এরই মধ্যে ১১৩ হেক্টর জমির আধাপাকা বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব জমি পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধের নকশার বাইরে ছিল। গতকাল সকালে কয়েকটি হাওরে গিয়ে দেখা গেছে, পানিতে নিমজ্জিত আধাপাকা বোরো ধান কাটতে ব্যস্ত স্থানীয় কৃষকরা।

খালিয়াজুরী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. জসিম উদ্দিন বলেন, গত কয়েক দিন ভারতের চেরাপুঞ্জিতে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে ঢলের পানি নেমে হাওরাঞ্চলের নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে খালিয়াজুরীর কয়েকটি হাওরে বেড়িবাঁধের বাইরে থাকা ১১৩ হেক্টর জমির বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। বাঁধের আওতায় এবার উপজেলায় ২১ হাজার ১২০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। ঢলের পানি বাড়তে থাকলে বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

খালিয়াজুরী সদরের কৃষক মনির হোসেন বলেন, ‘আমার ২০ একর জমির আধাপাকা বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। ’ উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামের কৃষক আনোয়ার হোসেন, আব্দুর রউফ মিয়া জানান, ঢলের পানিতে তলিয়ে তাঁদের ১৫ একর জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে।

নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী এম এল সৈকত বলেন, নদীর পারঘেঁষে বা বিলের মতো নিম্নাঞ্চলে বাঁধ দেওয়া হয় না। এ কারণে এসব অঞ্চলের ফসল তলিয়ে গেছে।

তলিয়ে যাওয়া জমি বাঁধের বাইরে কেন ছিল, এমন প্রশ্নের উত্তরে খালিয়াজুরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, প্রতিটি হাওরে দুই থেকে পাঁচ হেক্টর জমি বেরিবাঁধের আওতাবহির্ভূত রয়েছে। বাঁধের নকশা করে পাউবো। এসব এলাকা পাউবোর নকশার বাইরে থাকায় বাঁধ নির্মাণের সুযোগ হয়নি। তিনি আরো বলেন, ফসল রক্ষা বাঁধের অবস্থা এখনো ভালো আছে। কোনো ক্ষতি হয়নি। পানি বেড়ে গেলেও বাঁধ রক্ষায় বালুভর্তি বস্তা, বাঁশ মজুদ রাখা হয়েছে। এগুলো দিয়ে পানি ঠেকিয়ে ফসল রক্ষার চেষ্টা করা হবে। আর ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। তাঁদের সহায়তা করা হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, গত তিন দিনে চেরাপুঞ্জিতে ৩৫৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এই বৃষ্টি ১০০ মিলিমিটার হওয়ার কথা ছিল। গতকাল পর্যন্ত চেরাপুঞ্জিতে প্রায় ৫৪৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।

সুনামগঞ্জ জেলার ছোট-বড়ো শতাধিক হাওরে চলতি বছর দুই লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড ২১টি হাওরে ১২১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭২৩টি প্রকল্প কমিটির মাধ্যমে ৫৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ, সংস্কার ও মেরামত করেছে। তবে এসব প্রকল্প গ্রহণ, অনুমোদন, বাস্তবায়ন নিয়ে শুরু থেকেই দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ করে আসছিলেন কৃষক আন্দোলনের নেতারা। তাঁরা যথাসময়ে কাজ শুরু ও শেষ করতে না পারায় উদ্বেগ প্রকাশ করে পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করেছিলেন।

এদিকে বিভিন্ন হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধসহ বেড়িবাঁধের ক্লোজারে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছেন কৃষকরা। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড দাবি করেছে, তাদের পিআইসির লোকজনও ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধগুলোর কাজ শেষ করার পর এখন সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন। তাঁদের বাঁশ, বস্তা, উড়া, কোদাল নিয়ে প্রস্তুত থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

কৃষকরা তাহিরপুর উপজেলার বৌলাই নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গোপিনাথ, নোয়াগাঁও, নিশ্চিন্তপুর, লতিবপুরসহ বিভিন্ন এলাকার কৃষকরা স্বেচ্ছায় বাঁধে কাজ করছেন। পাহাড়ি নদী যাদুকাটা, পাটলাইয়ের পানি সুরমা ও অন্যান্য শাখা নদী হয়ে হাওরের সঙ্গে যুক্ত খাল হয়ে হাওরের বাঁধে এসে আছড়ে পড়ছে। শাল্লা উপজেলার দাড়াইন নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জোয়াইর হাওর, খৈয়ার হাওর, পুঁটিয়ার হাওরের বাঁধ ঝুঁকিতে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড এসব বাঁধে প্রাক্কলন অনুযায়ী কাজ করেনি বলে শুরু থেকেই অভিযোগ ছিল। এই ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধে গতকাল দিনভর বাহাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, কৃষক নেত, শতাধিক কৃষক ও গ্রামবাসী নিয়ে স্বেচ্ছায় কাজ করেন।

শাল্লা উপজেলার বাহাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ চৌধুরী নান্টু বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ড এবার শাল্লায় ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ নিয়ে চরম দুর্নীতি করেছে। কৃষকরা লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। যাচ্ছেতাই কাজ করেছে তারা নীতিমালা না মেনে। এখন পাহাড়ি ঢলের প্রথম ধাক্কাতেই সব বাঁধ ঝুঁকির মুখে। আমরা কৃষকদের নিয়ে এখন বাঁধে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছি। ’

হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেনরায় বলেন, গত ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হাওরের বাঁধের কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে প্রকল্প গ্রহণ, অনুমোদন ও বাস্তবায়নে বিলম্ব হয়েছে। ফলে বাঁধগুলো নড়বড়ে থেকে গেছে। এখন পাহাড়ি ঢলের প্রথম ধাক্কাতেই বাঁধগুলো ভেঙে যাচ্ছে। কৃষকের ঘুম হারাম হয়ে গেছে তাঁদের একমাত্র কাঁচা বোরো ধান ঝুঁকির মুখে থাকায়।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘গত চার বছরের মধ্যে এই সময় সবচেয়ে এত বেশি পাহাড়ি ঢল নামেনি। ৩১ মার্চ রাত থেকে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। গতকাল পর্যন্ত ৫৪৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এই পানি এসে নামছে সুনামগঞ্জে। যার ফলে নদনদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে এখন হাওরের ফসল ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। আমরা সতর্ক অবস্থানে থেকে কাজ করছি। ’