ঘাড়-কোমরের ব্যথা থেকে বাঁচতে করণীয়

ঘাড় ও কোমরের ব্যথায় ভোগেন অনেকেই। কম বয়সে এই ব্যথার উৎস মাসকিউলার স্ট্রেন হলেও বয়স বাড়লে ডিজেনারেটিভ ডিজিজ বা ক্ষয়ের কারণে বিভিন্ন রকমের আর্থ্রাইটিক পরিবর্তন হয়ে থাকে। ফলে শিরদাঁড়ার অস্থিসন্ধি, নার্ভ ও অন্যান্য অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ঘাড়ে-কোমরে ব্যথা বৃহত্তর আকার ধারণ করে।

এই ব্যথার উৎস নানান ধরনের। মানুষ এবং অন্যান্য স্তন্যপায়ী জীবের মধ্যে পার্থক্য, মানুষ দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে ও চলাফেরা করতে পারে। মেশিনের মতোই মানবদেহও বছরের পর বছর ভার বহন করতে করতে ক্ষয় হয়। স্পাইনাল কর্ড বা শিরদাঁড়ার মধ্যে আমাদের ঘাড়-কোমরের অংশ সহজেই নড়ানো যায়। পিঠের শিরদাঁড়ায় ডিজেনারেটিভ চেঞ্জ, যাকে আমরা স্পন্ডিলোসিস বলি, সেটা অনেক কম হয়।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিজেনারেটিভ পরিবর্তন হয়। জেনেটিক কম্পোজিশন অনুযায়ী এই ক্ষয় কারও ক্ষেত্রে খুব দ্রুত হয়, কারও ক্ষেত্রে ধীরে। পুরোপুরি প্রতিরোধ করতে না পারলেও এটি পিছিয়ে দেওয়া সম্ভব। অর্থাৎ ৪০ বছর বয়স থেকেই ঘাড়-কোমরের যন্ত্রণায় ভোগার পরিবর্তে তা গিয়ে ষাটের পরে দেখা দেবে। শরীরে ওজন কমানো একটি প্রধান উপায়। এতে শিরদাঁড়ার ওপরে ভার লাঘব হয় অনেকটাই। দ্বিতীয়ত, ভারটা ভাগ করে নিতে পারে যে মাংসপেশী, তাকে শক্তিশালী করে তোলা।

ভারতের নিউরোসার্জন (ব্রেন অ্যান্ড স্পাইন) ডা. অমিতাভ চন্দ জানান, শিরদাঁড়ার ডিজেনারেটিভ ডিজিজ এক ধরনের আর্থ্রাইটিস, সময় থাকতে সচেতন হলে অনেকটাই প্রতিরোধ করা সম্ভব। ‘নার্ভ বা স্পাইনাল কর্ডের ওপরে অতিরিক্ত চাপ পড়া থেকেই যাবতীয় সমস্যার সৃষ্টি।

ব্যথা যখন কোমর থেকে পায়ে আসে, তখন তাকে সায়াটিকা বলে। ঘাড়ে-কোমরে স্পন্ডিলোসিস, শিরদাঁড়ায় স্লিপড ডিস্কের সমস্যা ও তা থেকে নার্ভে চাপ পড়া— এসব তো আছেই। এ ছাড়া ব্যাক পেইনও থাকতে পারে। যেমন, স্পাইনাল কর্ডে টিউমর বা ইনফেকশন হতে পারে। টিবি-র জন্যও হতে পারে। অনেক সময়ে কিছু কিডনির অসুখ বা নারীদের পেলভিক ডিজিজে শিরদাঁড়ার অপারেশন করাতে হতে পারে।’

কারোর বসে থাকলে সমস্যা নেই, কিন্তু হাঁটলেই ব্যথা। কারোর কোমর থেকে ব্যথা ছড়াচ্ছে পায়ের দিকে। নিউরোলজিক্যাল ব্যথার কারণ জানা জরুরি। ডা. চন্দ বললেন, ‘শিরদাঁড়ার হাড়গুলো পরপর স্তরে-স্তরে সাজানো থাকে। এর ফাঁকে থাকে ডিস্ক। কম বয়সে তা জেলির মতো থাকে, ফ্লুয়িড বা জলীয় ভাগ অনেক বেশি। এগুলো শক অ্যাবজর্বার হিসেবে কাজ করে।

বয়স বাড়লে পানির ভাগ শুকোতে থাকে। ফলে হাড়গুলো কাছাকাছি এসে ঘষা খায়। এ ধরনের আর্থ্রাইটিস পরিবর্তন হাড়কে ইরিটেট করতে থাকে। দু’-একটা বোনি স্পিকিউল বেরিয়ে পড়ে ও সেগুলো নার্ভকে খোঁচা মারতে শুরু করে। ফলে শুটিং পেন হতে পারে।’

ডিস্কগুলো শুকিয়ে এলে হাড় একে অন্যের কাছে চলে আসে এবং দেহের উচ্চতা কমে যায়। আধ সেন্টিমিটার করে কমলেও, ২৬টি সেগমেন্টে মোট ১৩ সেন্টিমিটার উচ্চতা কমে যেতে পারে। শিরদাঁড়ার সামনে ডিস্কের জয়েন্ট ছাড়াও পিছনেও দু’টি জয়েন্ট থাকে। সেখানকার হাড়গুলো ঘষা খেতে শুরু করলে কার্টিলেজের ক্ষয় হয়। এই কারণে অস্বাভাবিক হাড়ের গ্রোথ হলেই ঘাড়ে, কোমরে ব্যথা শুরু হয়।

ঘাড়ে-কোমরে ব্যথার প্রধানত ৩টি উপসর্গ।

প্রথমত, লোকাল পেন। শুধুই ঘাড়ে-কোমরে ব্যথা হলে, অন্য কোনও উপসর্গ না থাকলে সে ক্ষেত্রে নন-অপারেটিভ ট্রিটমেন্ট করা হয়। ‘কিছু ক্ষেত্রে আলট্রাসনিক মাসাজ দেওয়া হয়। সেঁক যাতে বেশি গভীরে ঢুকতে পারে।’

দ্বিতীয়ত, নার্ভে চাপ পড়তে শুরু করলে তাকে বলা হয় ‘রেডিকিউলোপ্যাথি’। ঘাড় থেকে হাতে কিংবা কোমর থেকে পায়ে ব্যথা সরে যায়। নার্ভ যতটা অংশে ছড়িয়ে আছে, ততখানি জুড়েই ব্যথা হয়। ‘স্পাইনাল ক্যানালের মধ্য দিয়ে নার্ভগুলো পাস করে শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। শিরদাঁড়ার ক্ষয়ে নার্ভে প্রবল চাপ পড়ে, এতে মাংসপেশি দুর্বল হয়ে পড়ে। পেশি অসাড় হয়ে যাওয়া, অনুভূতি কমে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দেয়। এ সব ক্ষেত্রে অপারেশন করাতে হয়।’

তৃতীয়ত, চাপ যদি সরাসরি শিরদাঁড়াতেই পড়ে, তাহলে অস্ত্রোপচার ছাড়া আর উপায় থাকে না। চিকিৎসকদের মতে, শিরদাঁড়ার অপারেশন নিয়ে অনেকের ভয় কাজ করে। পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা করেন। তবে এই ভয় অমূলক। অপারেশনের ক্ষেত্রে বয়সটা কোনও বাধা নয়। ব্যক্তিবিশেষে ও জীবনযাত্রার উপরে নির্ভর করে। তবে ১০০ জনের মধ্যে ৯০ জনের অপারেশনের দরকার হয় না।

সময় থাকতেই নিয়মিত শারীরচর্চা ও খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রায় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে যত্ন নিন হাড় ও পেশির। তাহলে বয়স বাড়লে ক্ষয় প্রতিরোধ ও ব্যথা রোধ করা সম্ভব হবে অনেকাংশেই।

সূত্র : আনন্দবাজার।