সহানুভূতি ও আশ্বাস মিললেও কোনো আর্থিক সহযোগিতা পাননি সেই একুশে আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে গ্রেনেড হামলায় আহত সম্রাট আকবর সবুজ। শরীরে তিনটি স্প্লিন্টার নিয়ে স্ক্রাচে ভর দিয়ে এখন ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিত্তবান মানুষের দ্বারে দ্বারে। বছর চারেক আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে একটি চাকরির আবেদন করেন।
চাকরির জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সেই সুপারিশ নিয়ে অনেক মন্ত্রণালয়ে একটি পিয়ন পদের চাকরির জন্য ঘুরেছেন। কিন্তু ক্র্যাচে ভর দিয়ে চলাফেরা করেন দেখে কেউ তাকে চাকরি দেন না। অষ্টম শ্রেণি পাশ সম্রাট আকুতি জানান, ‘প্রতিবন্ধী কোটায় হলেও আমাকে একটি চাকরি দিন।’
গ্রেনেড হামলায় সম্রাট আকবরের মা মাহমুদা মনোয়ারা বেগমও আহত হয়েছিলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সম্রাটের মা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা অনুদান পান। এরপর সংসার চালানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ২০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র মাহমুদা মনোয়ারা বেগমের নামে করে দেওয়া হয়। এই সঞ্চয়পত্র থেকে মাসে ১৫ হাজার টাকা পান। সম্রাটের মা বর্তমানে কেরানীগঞ্জের চররুহিতপুরের একটি ভাড়া বাসায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। শরীরের অসংখ্য স্প্লিন্টারের যন্ত্রণায় কাতর। চিকিত্সায় মাসে অন্তত ৫ হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়। বাসা ভাড়া দেওয়ার পর সঞ্চয়পত্রের ১৫ হাজার টাকার কিছুই থাকে না। এ অবস্থায় সম্রাট আকবরের একটাই আকুতি, ‘দুইটা বিবাহযোগ্য বোনকে আমি ক্যামনে বিয়া দিমু। বিয়ার খরচ কই পামু।’
গতকাল সম্রাট আকবরের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার মা ছোটবেলায় বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে কাজ করতেন। মায়ের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুর অনেক গুণের কথা শুনেছি। মায়ের কাছ থেকে এসব শুনেই ছোটবেলা থেকেই আওয়ামী লীগের যে কোনো মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিতাম।’
তিনি বলেন, ‘ঘটনার দিন কেরানীগঞ্জের বাসা থেকে তার মায়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আসেন। সমাবেশ চলাকালে তিনি মায়ের সঙ্গে ট্রাকের (সমাবেশ মঞ্চ) সামনে বসেছিলেন। গ্রেনেড বিস্ফোরণের সময় মনে হলো চারদিক কেঁপে উঠছে। প্রধানমন্ত্রী (তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা) শেখ হাসিনার চোখ থেকে চশমা ছিটকে পড়ে। তিনি সেই চশমা হাত দিয়ে তুলতেই আরো একটি গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটে। তার শরীরের ওপর দিয়ে অনেক মানুষ পদদলিত করে চলে যায়। এ ঘটনার পর তিনি দেখতে পান তার মা রক্তাক্ত অবস্থায় পাশেই পড়ে আছে। ’
এক সময় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ফল বিক্রি করে সংসার চালাতেন। পঙ্গু হয়ে যাওয়ার পর তার চিকিত্সা চালাতে গিয়ে তাদের কেরানীগঞ্জের ১০ শতাংশ জমি মাত্র সাড়ে ৫ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন। এই টাকা ভেঙে সংসার চালাতেন।
শুধু সম্রাট আকবর সবুজই নন; দীর্ঘ ১৪ বছর পরও আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মীকে তাড়া করে ফেরে একুশে আগস্টের মৃত্যুদূত। নৃশংস সেই গ্রেনেড হামলায় আহত হয়ে পঙ্গুত্বের বোঝা নিয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা লিটন মোল্লা, নাসিমা ফেরদৌস, সাবিহা, রুমা, দীপ্তি, নাজিম, ফাহমিদা, সাজেদুল, দৌলতুন্নাহারসহ শত শত আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী। কেউ চলত্শক্তিহীন। কেউ হারিয়েছেন দৃষ্টিশক্তি। অনেকের শরীরে রয়ে গেছে
এদের কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের বর্তমান এই দুঃসহ জীবনের কথা। স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা লিটন মোল্লার শরীরে এখন ৫০টি স্প্লিন্টার। দুই কানে সমস্যা। উন্নত চিকিত্সার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিত্সকরা। অর্থ সংকটে তা হচ্ছে না। সবুজবাগ থানা মহিলা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ফাহমিদা খানম মনির সারা দেহে এখনো শত শত স্প্লিন্টার। গ্রেনেডের আঘাতে কোমরের অনেকখানি মাংস উড়ে গিয়েছিল। স্বেচ্ছাসেবক লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা অ্যাডভোকেট উম্মে রাজিয়া কাজলের শরীরে এখনো সোয়া তিন শ স্প্লিন্টার রয়েছে। পল্লবী থানা মহিলা আওয়ামী লীগের সহসভানেত্রী দৌলতুন নাহারের পেটের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে গিয়েছিল, দুই পা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। মুমূর্ষু অবস্থায় কলকাতায় কয়েক দফা অপারেশন হয় তার। ডান চোখ নষ্ট হয়ে যায়। স্প্লিন্টারের আঘাতে দুই পাসহ শরীরের পুরো নিম্নাংশ ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল ঢাকা জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদিকা নীলা চৌধুরীর। বাঁ পা আকারে কিছুটা ছোট হয়ে যায়। শরীরে অসংখ্য স্প্লিন্টার। বর্তমানে সুইডেনে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন তিনি।ঢাকা জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা মাহবুবা পারভীন শরীরে অসহ্য জ্বালা-যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছেন। মাদারীপুরের কালকিনি পৌরসভার বিভাগদী গ্রামের মোহাম্মদ আলী হাওলাদারের ছেলে হান্নান হাওলাদারের একটি পা গ্রেনেড হামলায় নষ্ট হয়ে গেছে। স্বেচ্ছাসেবক লীগের ঢাকা মহানগর নেতা মিজি মনির হোসেনের দুই পা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। এখন স্ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটতে হয় তাকে। কোতোয়ালি থানার নেতা বাহার মিয়ার শরীরের বাঁ অংশ অবশ। স্ক্র্যাচে ভর করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন তিনি।
আহতদের মধ্যে আরেকজন নাসিমা ফেরদৌস। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা এই নারী এখনো বয়ে চলেছেন শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। জনসমাবেশে গিয়ে গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে ডান হাত নষ্ট হয়ে যায় ফরিদপুরের আবদুল করিম মঞ্জুর। পরে স্ট্রোকও করেন। সেদিনের কথা মনে হলে দুঃস্বপ্নে এখনো আঁতকে ওঠেন তারা।