অবশেষে ১৬৩ ঘণ্টা পর অনশন ভেঙেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল গতকাল বুধবার সকালে তাঁদের অনশন ভাঙান। এ সময় তিনি জানান, শিক্ষার্থীদের সব দাবি পূরণ করা হবে—সরকারের উচ্চ মহল থেকে তাঁকে এমন আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে এক দফা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
এর আগে ভোররাত ৩টা ৫৫ মিনিটের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পৌঁছেন জাফর ইকবাল ও ইয়াসমিন হক দম্পতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে নেমে হেঁটে সরাসরি উপাচার্য ভবনের সামনে অনশনরত শিক্ষার্থীদের কাছে যান তাঁরা। এ সময় পুলিশ জটলা সরাতে তৎপর হলে জাফর ইকবাল পুলিশের উদ্দেশে বলেন, ‘এখানে আমার নিরাপত্তার দরকার নেই। আমার নিরাপত্তা আমার শিক্ষার্থীরাই দেবে। আপনারা সরেন। ’ এরপর প্রায় দুই ঘণ্টা ১০ মিনিট অবস্থান করে শিক্ষার্থীদের কথা শোনার পাশাপাশি জাফর ইকবাল তাঁদের অনশন ভাঙার অনুরোধ জানান। তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘তোমরা তো এরই মধ্যে বিজয়ী হয়েছ। সারা দেশের মানুষ তোমাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের ঘুম হারাম করে দিয়েছ। ’ দীর্ঘ আলোচনার পর শিক্ষার্থীরা অনশন ভাঙতে সম্মত হন। সকাল ১০টা ২০ মিনিটে পানি পান করিয়ে অনশন ভাঙানো হয়।
শিক্ষার্থীদের দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাস শিক্ষামন্ত্রীর : শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীদের দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি বলেছেন, ‘অনশনের অষ্টম দিনে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙিয়েছেন। এরপর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে। তারা আমাকে জানিয়েছে, তারা আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়াবে। অবরোধ তুলে নেবে। আমরাও আশা করছি, তারা এখানেই তাদের আন্দোলনের ইতি টানবে। তারা যে কারণে আন্দোলন করেছে, তা সমাধানে আমরা একযোগে কাজ করব। ’
গতকাল বুধবার সন্ধ্যা ৭টায় রাজধানীর হেয়ার রোডে মন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী এসব কথা বলেন। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘যে জন্য আন্দোলন শুরু হলো বা কয়েক দফার আন্দোলন কিভাবে এক দফার আন্দোলনে পরিণত হলো, তা খতিয়ে দেখা হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কারো যদি কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে, অবহেলা থাকে—তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি যিনিই হোন না কেন। ’
উপাচার্যের পদত্যাগের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ভিসির পদত্যাগ অন্য বিষয়। তাঁকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন। তিনি পদত্যাগ করলেই তো সমস্যার সমাধান হবে না। এক ভিসি যাবেন, আরেক ভিসি আসবেন। সমস্যার জায়গায় সমস্যা থেকে যাবে।
হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন অনশনকারীরা : অনশন ভাঙার পর হাসপাতাল থেকে ক্যাম্পাসে ফিরে যান অনশনকারীরা। অবশ্য যাঁদের শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ রয়েছে, তাঁদের হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।
হাসপাতাল থেকে হলে ফিরে জান্নাতুল নাঈম নিশাত কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্যার আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন। স্যারের কথায় আমরা অনশন ভেঙেছি। ’ জাহিদুল ইসলাম অপূর্ব বলেন, ‘যাঁর কাছে আমরা নিরাপদ নই, আমাদের অনশনকারী ২৮ শিক্ষার্থীর প্রাণ মূল্যহীন, তাঁর মতো নির্লজ্জ উপাচার্যকে আমাদের প্রাণের ক্যাম্পাসে আমরা আর চাই না। ’
ক্যাম্পাসে অস্থায়ী টং স্থাপন : বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের খাবারের টং দোকান, ফুড কোর্ট, ক্যান্টিন ও ক্যাফেটেরিয়া বন্ধ করে দেওয়ায় খোদ শিক্ষার্থীরাই চালু করেছেন খাবারের দোকান। গতকাল সারা দিন এই টং দোকান শিক্ষার্থীদের পদচারণে মুখর ছিল।
‘আন্দোলন দমানোর উপায় অমানবিক’ : সকাল সোয়া ১১টার দিকে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন জাফর ইকবাল। তিনি বলেন, ‘যে উপায়ে এই আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করা হয়েছে, তা অমানবিক, নিষ্ঠুর ও দানবীয়। ’ সরকারের উচ্চ মহলের অনুরোধে তিনি এখানে এসে শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাকে দেওয়া কথা রাখা হবে, সেই আশা করছি। ’
‘ভিসিকে চিঠি দিয়ে গিয়েছিলাম’ : বিশ্ববিদ্যালয়ে টং দোকান বন্ধ, রোড পেইন্টিং নিষিদ্ধের বিষয়ে জাফর ইকবাল বলেন, ‘এটা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে এগুলো থাকতে হবে। যখন থেকে এগুলো বন্ধ হয়ে গেছে, ঠিক তখন থেকেই বুঝতে হবে আর যা-ই হোক, এই উপাচার্য একাডেমিক বিষয় বোঝে না, শিক্ষা বোঝে না, ছাত্র বোঝে না। ’
‘ফান্ডে টাকা দিচ্ছি, অ্যারেস্ট করুন’ : আন্দোলনে আর্থিক সহায়তা দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক পাঁচ শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করার ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন জাফর ইকবাল। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর একটা স্মারকগ্রন্থের লেখা লিখে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ১০ হাজার টাকা সম্মানী পেয়েছেন। সেই টাকা আন্দোলনের ফান্ডে দিচ্ছেন। পারলে তাঁকেও গ্রেপ্তার করা হোক। তিনি বলেন, ‘এর চেয়ে নিন্দনীয় ব্যাপার আর কিছু হতে পারে কি না। আমি আশা করব, এই বিষয়গুলো অবশ্যই যেন বন্ধ হয় এবং আমাদের ছেলে-মেয়েদের মুক্ত করে দেওয়া হয়। তাদের যেন জেলখানায় হাজির হতে না হয়। ২০০ থেকে ৩০০ জনকে আসামি করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, নামছাড়া। যখন প্রয়োজন হবে, সেখানে একজনের নাম ঢোকানো হবে। এই জিনিসগুলো যেন অবিলম্বে বন্ধ করা হয়। ’
অবশ্য গতকালই শাবিপ্রবির সাবেক পাঁচ শিক্ষার্থীকে জামিন দেন সিলেট মহনগর হাকিম আদালত।
শাবিপ্রবি শিক্ষক সমিতির নিন্দা : সাবেক পাঁচ শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। সমিতির সভাপতি তুলসী কুমার দাস ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মহিবুল আলম স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এই নিন্দা জানানো হয়।
শাহবাগে গণ-অবস্থান কর্মসূচি : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, শাবিপ্রবি উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে গণ-অবস্থান কর্মসূচি পালন করছে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে এই কর্মসূচি পালিত হয়। কর্মসূচিতে বাম ছাত্রসংগঠনের পাশাপাশি শিক্ষক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, অভিভাবকসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ সংহতি জানায়। কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘অবিলম্বে এই উপাচার্যের অপসারণ চাই। ’
এদিকে রাত পৌনে ১১টায় এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী রোমিও নিকোলাস রোজারিও বলেন, ‘উপাচার্যের পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। তবে আমরা আন্দোলনের ধরন পরিবর্তন করেছি। আজ বৃহস্পতিবার থেকে উপাচার্যের বাসভবন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনের অবরোধ তুলে দেওয়া হবে। প্রশাসনিক ভবন, একাডেমিক ভবন ও হলগুলোর তালা খুলে দেওয়া হবে। ক্যাম্পাসে অবস্থান কর্মসূচি, রোড পেইন্টিং, মিছিল-মিটিং ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়ে আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। ’
সর্বশেষ গতকাল রাত সাড়ে ১১টায় শিক্ষার্থীদের এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, উপাচার্য ভবনের সামনে থেকে অবরোধ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।