প্রকৃত বন্ধু

প্রকৃত বন্ধুফাহিম ও রাহীম দুই বন্ধু। ওরা দুজনেই ১০ম শ্রেণীরতে পড়ে। ফাহিম ক্লাসের ফাস্ট বয়। আর রাহীম কোনো মতে পাসটা করে। গত পরীক্ষায় ও সে দুই বিষয়ে ফেল ও করেছিল। রাহীমের বাবা ভ্যানচালক। তিনি কোনোমতে তাদের ছয় সদস্যের সংসারটাকে ক্লান্ত খোড়ার মতো টেনে হিঁচড়ে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

শত কষ্টের মাঝেও সৃষ্টিকর্তার নিকট তার একটাই চাওয়া, ছেলেটা যেন তার মানুষের মতো মানুষ হয়। বড় হয়ে যেন তার মতো ভ্যানচালক না হয়। তিনি তার ছেলেকে নিয়ে হাজারো স্বপ্নের জাল বুনেন। তার স্বপ্ন ছেলেটা বড় হয়ে টাকা পয়সা রোজগার করবে। ঝিমিয়ে পড়া সংসারটার হাল ধরবে। রাহীমের জন্য তিনি তার সব কষ্ট সহ্য করে নিতে রাজি।

অথচ রাহীমের পড়ার প্রতি এমন উদাসীনতায় তিনি খুবই মর্মাহত। আজ মডেল টেস্ট পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এবার রাহীম দুইটি নয় তিন, তিনটি বিষয়ে ফেল করেছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন যে, রাহীমকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ গ্রহন করতে দেওয়া হবেনা। কারন তিনি চাননা রাহীম বরাবরের মতো এসএসসি পরীক্ষাতে ও ফেল করে বিদ্যালয়ের সুনাম নষ্ট করুক ।

রাহীমের বাবা প্রধান শিক্ষকের নিকট কত অনুনয় করলেন রাহীমকে পরীক্ষায় অংগ্রহন করার সুযোগ দেওয়ার জন্য। কিন্তু প্রধান শিক্ষক তার সিদ্ধান্তে অটল। অবশেষে ফাহিম প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা বলে অনেক কষ্টে রাহীমের পরীক্ষায় পাশের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাহীমের পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি নিতে সক্ষম হলো। ফাহিম স্যারকে আশ্বস্ত করে বললো, ‘স্যার আমি আপনাকে কথা দিচ্ছে। ইনশাআল্লাহ রাহীম এবার সব বিষয়ে পাস করবে। আমি ওকে সবরকম সহযোগীতা করবো’।

রাহীমের বাবা আনন্দ আত্নহারা হয়ে ফাহিমকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে বলতে লাগলেন, ‘বাবা তুমি আমার এতদিনের লালিত স্বপ্নগুলোকে অপমৃত্যু হাত থেকে রক্ষা করলে। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি তুমি অনেক বড় হও। বাবা তুমি ওকে একটু বোঝাও। ও যেন এখন থেকে আরেকটু মনোযোগ দিয়ে পড়ে। রাহীম ফাহিমকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে শুরু করলো। ফাহিম প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে গেলো।

কারন সে কখনো রাহীমকে এভাবে কাঁদতে দেখিনি। পরে ফাহিম রাহীমের অশ্রুভেজা চোখ দুটো মছে দিয়ে বললো, ‘আরে বোকা কাঁদছিস কেন ? তুই এবার এসএসসি পরীক্ষায় ঠিকই পাস করবি। আমি তোকে সাহায্য করবো’। ক্লাসের সকল ছাত্র কোচিং ক্লাসে করলেও রাহীমের মতো ভ্যানচালক দিনমজুর বাবার ছেলেরা কোচিং করতে পারেনা। এদিকে রাহীম ফাহিমের সহযোগীতায় তার পড়ালেখায় চালিয়ে যেতে থাকল নতুন উদ্যমে।

প্রতিদিনই ক্লাস শেষে ও বিরতির ফাঁকে ফাঁকে ফাহিম রাহীমকে গনিত, ইংরেজী সহপদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়নের মতো কঠিন বিষয় গুলো বুঝিয়ে দিতে লাগল। এভাবে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে ফাহিমের সহযোগীতায় রাহীমের সবগুলো বিষয় একভার রিভাইজ দেওয়া শেষ হয়ে যায়। পরীক্ষায় শুরু হতে এর মাত্র পাঁচদিন বাঁকী।

সব অলসতা আর উদাসীনতা ঝেড়ে সারাদিন বই নিয়ে বসে থাকে রাহীম। তার মাকে আর তাকে সারাদিন পড়তে বস, পড়তে বস বলে বলে চিৎকার চেঁচামেচি করতে হয়না। সে তার ভিতর এক নতুন পড়ার উদ্যম অনুভব করে। যার মূলে রয়েছে তার বন্ধু ফাহিমের সহযোগীতা আর তার নিজের প্রচেষ্টা। সে ভাবে বন্ধু হলে এমনই হওয়া উচিত। সেদিন যদি ফাহিম এগিয়ে না আসতো তাহলে হয়তো তার আর তার বাবার স্বপ্ন গুলো আজীবন স্বপ্ন হয়েই থেকে যেতো। বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতায় রাহীমের চোখ দুটো ভিজে গেলো।

পরীক্ষা শুরু হলো আজ ৩ দিন। এরই মধ্যে ৩ বিষয়ের পরীক্ষা শেষ হয়েও গিয়েছে। চতুর্থ দিন পরীক্ষা শেষে বাড়ী ফেরার পথে প্রধান শিক্ষকের সাথে দেখা হলো, তাদের দুই বন্ধুর। দুজনেই স্যারকে দেখে সালাম দিল। স্যার সালামের উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করলে, ‘তোমাদের পরীক্ষা কেমন হচ্ছে ?’ তারা দুজনেই উত্তর দিল, ‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো স্যার।’ স্যার ফাহিমকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ+ থাকবে তো ফাহিম ?’ ফাহিম বললো, ‘ইনশাআল্লাহ্ থাকবে স্যার’। এবার স্যার রাহীমকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘রাহীম তোমার পরীক্ষা কেমন হচ্ছে ?’ রাহীম কিছু বলেনা শুধু মাথা নেড়ে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ’।

আজ দেশের প্রায় সবকটি পত্রিকায় বড় বড় অক্ষরে ছাপা হয়েছে যে, আজ এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হবে। প্রথমে শিক্ষামন্ত্রী দুপুর ১২টায় আনুষ্ঠানিক ভাবে ফলাফল প্রধানমন্ত্রীর হাতে হস্তান্তর করবেন। বেলা ২ টা থেকে ফলাফল ইন্টারনেট বা পরীক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে জানা যাবে। ফলাফল প্রকাশের দিন সকাল থেকেই রাহীমের কেমন অস্থির-অস্থির লাগছে। কোনো কিছু খেতে ও চাইছেনা, কারো সাথে কাথাও বলছেনা। সকাল থেকেই সে গভীর চিন্তায় মগ্ন।

মনের ভিতর এক অজানা সঙ্কা যেন বাসা বেঁধে আছে। বার-বার শুধু একটাই চিন্তা করছে, ‘পাস করেছি ? না করিনি ?’ ফাহিম ও রাহীম ফলাফল প্রকাশের নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই পরীক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে হাজির হয়। ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকদের হট্রগোলে পুরো হলরুম গম-গম করছে। হঠাৎ পুরো হল রুম স্তব্ধ হয়ে যায়! চারদিকে বিরাজ করছে কেবল নিরবতা।

প্রধান শিক্ষক ফলাফল পত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি প্রথমে ঘোষণা করলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়ের সুযোগ্য ছাত্র আমাদের গৌরব ফাহিম বরাবরের মতো এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ+ পেয়ে এবিদ্যালয় ও তার পিতা মাতার মুখ উজ্জ্বল করতে সক্ষম হয়েছে’। ফাহিমের বাবা মা সঙ্গে-সঙ্গে ফাহিমকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে শুরু করলো। একে-একে সবার ফলাফল ঘোষণার পর সবার শেষে এলো রাহীমের সিরিয়াল।

প্রধান শিক্ষক আবেগে আপ্লুত হয়ে বললেন যে, ‘আজকের সাথে আগামীর পার্থক্য হবে এটাই চিরন্তন সত্য’। ৯০ নম্বর সিরিয়ালের রাহীম জিপিএ ৫.০০ পেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হয়েছে। সাথে-সাথে রাহীম ফাহিমকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে ফেলল। সে যেন বিশ্ব জয় করে ফেলেছে।

মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর দুই তিন সপ্তাহ খানেক কেটে গেলো। সবাই এখন কোনোনা কোনো কলেজে ভর্তি হবার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কেউ কেউ আবার পড়ালেখা ছেড়েও দিয়েছে। এদিকে ফাহিম দের অর্থনৈতিক ভাবে অবস্থান ভালোই ছিল। যার কারণে সে শহরের নামকরা কলেজে ভর্তি হতে পেরেছিল। কিন্তু পারিবারিক ও আর্থিক অসচ্ছলতার কারনে রাহীম গ্রামের একটি কলেজে ভর্তি হয়। সবাই বলে দূরে থাকলে নাকি বন্ধুত্তের ফাটল ধরে। কিন্তু ফাহিম ও রাহীমের বেলায় সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

ফাহিম সময় পেলেই রাহীমের সাথে দেখা করতে গ্রামে চলে আসে। এমনি ভাবে কেটে যায় অনেক দিন। দুজনেই আলাদা-আলাদা কলেজে পড়ালেখা করতেও অনেক ভালো ভাবে পড়ালেখা করতে থাকে। একসময় তাদের এইচএসসি পরীক্ষার সময় চলে আসে। তারা দুজনেই খুব ভালো প্রিপারেশন নেয়। আজ থেকে তাদের এইচএসসি পরীক্ষা শুরু। তাদের দুজনেরই পরীক্ষা খুব ভালো হচ্ছে। কারন তারা মনোযোগ দিয়ে তাদের সব পড়া সময়ে-সময়ে সঠিকভাবে আদায় করেছে।

পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর এখন তারা দজনেই অবসর এই সময় রাহীম ফাহিমকে গ্রামে আসতে বলে। ফাহিম আর এ লোভ সামলাতে না পেরে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ফাহিমের বাবা-মা তার গ্রামে যাওয়া নিয়ে দ্বিমত করেনি। কারণ তারা ফাহিম আর রাহীমের বন্ধুত্ব সস্পর্কে ভালো করেই জানত। তাই তারা আর ফাহিমকে বাধা দেয়নি।

গ্রামে রাহীমদের বাড়ীতে এসে ফাহিম ও রাহীম দুজনে অনেক মজা করে সময় কাটাতে থাকে। মলিদের বাগান থেকে আম পেড়ে খাওয়া, নরহরিদের পুকুর থেকে বড়শি দিয়ে মাছ ধরা সহ আর কত কি! এরই মধ্যে কেটে যায় কয়েক দিন। রাহীম এখন টিউশন করে কোনোমতে পড়ার খরচ চালায়। তার বাবা আগের মতোই এখনো কোনোমতে সংসার টার বোঝা বয়ে চলেছেন। এদিকে রাহীম ও ফাহিম দুজনেই ভালো ফলাফল প্রত্যাশী। আর তাই তারা দুজনেই প্রস্তুতি মূলক ক্লাস করার জন্য ঢাকায় যাবে। তাদের দুজনেরই ইচ্ছে তারা মেডিকেলে ভর্তি হবে।

আজ রাহীম ও ফাহীম দুজনে একসাথে ঢাকায় যাবে। দুজনেই রাহীমের বাবা-মাকে সালাম দিয়ে বিদায় নিয়ে বাস স্টেশানের দিকে রওনা দিল। বাস আসার পর দুজনেই বাসে উঠল। তারা দিব্যি গাড়িতে বসে কথা বলতে-বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস মহুর্তের মধ্যে সবকিছু লন্ডন্ড করে দিয়ে গেলো। পথিমধ্যেই তাদের গাড়িটি মারাত্নক দূর্ঘটনার শিকার হয়। এই দূর্ঘটনায় অনেকরই প্রাণহাণি হয়। এই দূর্ঘটনায় যাদের প্রাণহাণি হয়, ফাহিম তাদের মধ্যে একজন। রাহীম এ দূর্ঘটনায় কোনো মতে বেঁচে গেলেও জীবন যদ্ধে হেরে গিয়ে এ পৃথিবী ছেড়ে চির দিনের জন্য চলে গেলো ফাহিম। রাহীমের এই মুহুর্তে কিছুই করার ছিলো না।

ভাগ্যের এই নির্মম খেলা মুহুর্তের মধ্যেই পাল্টে দেয় সবকিছু, তার প্রিয় বন্ধুটিকে তার থেকে ছিনিয়ে নেয়। প্রিয় বন্ধুটিকে হারিয়ে রহীম আজ খুবই একা। ফাহিমের সাথে কাটানো দিনগুলোর স্মৃতি যেন রাহীমের হৃদয়ের পাতায় এক একটি আঁচড় কেটে চলেছে। তবুও জীবন যেহেতু থেমে নেই তাই সময়ের সাথে এগিয়ে যেতে থাকে রাহীমের জীবন।

আজ রাহীম শহরের একজন অনেক বড় ডাক্তার। হয়তোবা আজ ফাহিম বেঁচে থাকলে সবচাইতে বেশি খুঁশি হতো। রাহীম আজ এটা বিশ্বাস করে যে, সৃষ্টিরকর্তার ইচ্ছায় আর ফাহিমের সহযোগিতায়ই সে আজ তার জীবনে এই অবস্থানে আসতে পেরেছে। আজ রাহীম তার স্মৃতিকাতর হৃদয় নিয়ে বিষন্ন হয়ে বসে বসে ভাবে। ভালো মানুষেরা হয়তো বেশি দিন বাঁচেনা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কখন কাকে কার মাধ্যমে হেদায়েত দান করেন সেটা তিনি নিজেই জানেন। জীবন যাতে থেমে থাকেনা তাই জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে সফলতা লাভ করা যায়। কারন জীবনে সফলতার সাথে আলিঙ্গন করার মতো সুখবর কিছুই হয়না।

রাইসা মেহেজাবিন
নবম শ্রেণী
প্রতাপগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় (চন্দ্রগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর)
সদস্য : প্রদীপ্ত লেখক ফোরাম