ফিরছে বিলুপ্তপ্রায় তিন জাতের মাছ

এবার একসঙ্গে ফিরছে বিলুপ্তপ্রায় তিন প্রজাতির মাছ বটিয়া পুইয়া, লইট্যা ট্যাংরা ও কুর্শা। ভোজনরসিক তো বটেই, গবেষকদের জন্যও এটা কম আনন্দের নয়। নীলফামারীর সৈয়দপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ মৎস গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্বাদুপানি উপকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি বিলুপ্তপ্রায় মাছ তিনটির প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন করেছেন। আর এর মধ্যে দিয়ে বিলুপ্তপ্রায় ৬৪ প্রজাতির মাছের মধ্যে ৩৪টি জাত ফিরে আসল।

স্বাদুপানি উপকেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. খোন্দকার রশীদুল হাসানের নেতৃত্বে ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ইশতিয়াক হায়দার, শওকত আহমেদ ও মালিহা হোসেন মৌ গবেষণায় অংশ নেন। বিজ্ঞানীরা জানান, বিলুপ্তপ্রায় এই মাছগুলোর প্রজনন কৌশল উদ্ভাবনের জন্য তিস্তা, রংপুরের চিকলী নদী, নীলফামারীর বরাতি ও বুড়িখোরা নদী থেকে ‘মা মাছ’ সংগ্রহ করা হয়। এরপর মাছগুলো থেকে বিশেষ কায়দায় ডিম ফুটিয়ে রেণু পোনা উত্পাদন করা হয়। তা উপকেন্দ্রের পুকুরে ছেড়ে বড় করা হয়।

মাছ তিনটির মধ্যে বটিয়া পুইয়া এলাকাভেদে নাটোয়া, খলই মুচরী, বিলভারি ইত্যাদি নামে পরিচিত। সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার পাহাড়ি ছোট নদীতে এবং দিনাজপুর, রংপুর ও ময়মনসিংহ জেলার ছোট নদীতে এ মাছটি পাওয়া যায়। পুইয়া মাছের ডিম ধারণক্ষমতা ৫ হাজার থেকে ৮ হাজার পর্যন্ত হয়ে থাকে। মাছটির প্রজননকাল মে থেকে আগস্ট। তবে সর্বোচ্চ প্রজননকাল জুন মাসে।

লইট্যা ট্যাংরা হচ্ছে স্বাদু পানির আরেকটি সুস্বাদু মাছ। অঞ্চলভেদে এ মাছটি নদীর ট্যাংরা, লইট্যা ট্যাংরা নামে পরিচিত। দেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্বের জেলাগুলোতে স্বাদুপানির নদী ও সংযুক্ত জলাশয়ে বিশেষ করে বর্ষা ও শীত মৌসুমে এদের পাওয়া যায়। উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন নদী যেমন- তিস্তা, বুড়িখোরা, বারাতি, চিকলী ও ভুসি নদীতে এ মাছ পাওয়া যায়। ২০২০ সালে প্রজনন মৌসুমে দেশে প্রথমবারের মতো কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে লইট্যা মাছের পোনা উত্পাদনে প্রাথমিক সফলতা অর্জিত হয়। প্রযুক্তিটি প্রমিতকরণের মাধ্যমে চলতি প্রজনন মৌসুমে তা চূড়ান্ত করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, একটি পরিপক্ব (২০-৩০ গ্রাম) ওজনের লইট্যা ট্যাংরার ডিম ধারণক্ষমতা ২৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার পর্যন্ত হয়ে থাকে।

কুর্শা মিঠাপানির একটি মাছ যা অঞ্চলভেদে কুর্শা, খুর্শা বা কাতাল খুশি ইত্যাদি নামে পরিচিত। দেশের উত্তরাঞ্চলে মাছটি কুর্শা, খুর্শা নামে পরিচিত। মিঠাপানির জলাশয় বিশেষ করে পাহাড়ি ঝরনা ও অগভীর স্বচ্ছ নদী এদের আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। মাছটি সুস্বাদু ও মানবদেহের জন্য উপকারী অনুপুষ্টি উত্পাদন সমৃদ্ধ। গবেষণায় দেখা গেছে, একটি পরিপক্ব কুর্শা মাছের ডিম ধারণক্ষমতা ৫০ হাজার থেকে ৮০ হাজার পর্যন্ত হয়ে থাকে। মাছটির প্রজননকাল মে থেকে আগস্ট। তবে সর্বোচ্চ প্রজননকাল জুন মাসে।

গবেষণা দলের প্রধান স্বাদুপানি উপকেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. খোন্দকার রশীদুল হাসান ও ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শওকত আহমেদ ইত্তেফাককে বলেন, নির্বিচারে মাছ নিধন, বিশেষ করে নদীতে বানা ও কারেন্ট জাল দিয়ে মাছ, জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরা, কীটনাশক ব্যবহার ও জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবে দেশি মাছগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। সুখবর হলো, কৃত্রিম প্রজনন কৌশল উদ্ভাবনের মাধ্যমে মাছগুলো আবার ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। দেশের মত্স্য খাতে এসব মাছ যথেষ্ট অবদান রাখবে বলে জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, নতুন করে তিনটিসহ ৩৪ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় মাছে প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন করেছি আমরা। এখনো ৩০ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তপ্রায়। তবে আশা করছি, বিলুপ্তপ্রায় সব মাছকেই আমরা ফিরিয়ে আনতে পারব।