১৫১ বছরের সাক্ষ্য আইন বদলে হবে যুগোপযোগী

ব্রিটিশ আমলে প্রণীত ১৫১ বছর আগের পুরোনো সাক্ষ্য আইন বাতিল করে যুগোপযোগী নতুন সাক্ষ্য আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার। এ লক্ষ্যে ‘সাক্ষ্য আইন ২০২৪’ নামে প্রথমবারের মতো বাংলায় একটি আইনের খসড়াও চূড়ান্ত করেছে আইন কমিশন। এতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারকে আইনি কাঠামোর আওতায় আনার পাশাপাশি সাক্ষী হাজিরে অনুপস্থিতি ও ব্যর্থতা, সাক্ষ্য গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা, সাক্ষীর ঠিকানা বদলসহ নানা ইস্যুতে কর্মপন্থা স্পষ্ট করা হয়েছে। ফলে সাক্ষ্য আইনের অপব্যবহার এবং সংক্ষুব্ধ পক্ষ ও সাক্ষীদের আইন অমান্য করার প্রবণতা অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের কমিশন এই খসড়া চূড়ান্ত করে। এর পর গত ৩১ ডিসেম্বর আইন কমিশন থেকে ৮৭ পৃষ্ঠার খসড়া আইনসহ ১৩১ পৃষ্ঠার ধারণাপত্র ও সুপারিশ আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এর আলোকে প্রচলিত সাক্ষ্য আইন যুগোপযোগী বা খসড়াটি পর্যালোচনা করে তা পাসের জন্য সংসদে উপস্থাপনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে আইন মন্ত্রণালয়।

এ বিষয়ে এ বি এম খায়রুল হক সমকালকে বলেন, খসড়াটি চূড়ান্ত করতে কর্মরত বিচারকসহ ফৌজদারি ও দেওয়ানি আইন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ে সুপারিশসহ খসড়াটি পাঠানো হয়েছে। এখন আইন মন্ত্রণালয়ই এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, সাক্ষ্য আইন যুগোপযোগী করার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা করা গেলে আইনি কার্যক্রমে কিছু ফাঁকফোকর কমতে পারে। খসড়াটি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

জানা গেছে, ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনটি দেশের বিচার ব্যবস্থায় অন্যতম পদ্ধতিগত আইন হিসেবে বিভিন্ন বিচার আদালতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। কালের বিবর্তনে অপরাধ ও সামাজিক বিরোধের ধরন ও প্রকৃতি পরিবর্তিত হওয়ায় বহুল ব্যবহৃত এই আইন প্রায়ই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। এর মধ্যে প্রায় দুই দশক আগে ব্রিটিশ আমলে প্রণীত এই সাক্ষ্য আইনটি যুগোপযোগী করে ভারত সরকার। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশেও দীর্ঘদিন ধরে সাক্ষ্য আইন যুগোপযোগী করার বিষয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু হয়। যার ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালের ৩ নভেম্বর আদালতের অনুমতি ছাড়া ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টা মামলায় জেরার সময় ভুক্তভোগীকে তার চরিত্র ও অতীত যৌন আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না, এমন বিধান যুক্ত করে সাক্ষ্য আইন সংশোধন করে সরকার। তবে এবার তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিদ্যমান অন্যান্য আইনের কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নতুন সাক্ষ্য আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বিদ্যমান আইনটি ইংরেজিতে থাকলেও এবার তা বাংলায় করা হচ্ছে।

খসড়া পর্যালোচনায় দেখা যায়, আইন কমিশন প্রণীত সাক্ষ্য আইনের খসড়ায় মোট তিনটি ভাগ, ১৯টি অধ্যায় এবং ১৮০টি ধারা সন্নিবেশ করা হয়েছে। এ খসড়া করতে সাক্ষ্য আইন, কারা আইন, ফৌজদারি কার্যবিধি, দেওয়ানি কার্যবিধিসহ ১১টি আইন এবং বিভিন্ন দেশের, বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্যের আইনগুলো পর্যালোচনা করা হয়। দেশি-বিদেশি গবেষক, বিশেষজ্ঞ, বিচারকদের সঙ্গেও মতবিনিময় করেছে কমিশন।

আইন প্রণয়নের সুপারিশ
পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও বাংলাদেশের বর্তমানে প্রচলিত সাক্ষ্য আইন ও বিদ্যমান বিচারব্যবস্থা বিস্তারিত পর্যালোচনা করে খসড়াটি প্রস্তুত করেছে আইন কমিশন। প্রস্তাবিত সাক্ষ্য আইন প্রণয়ন করা হলে আইনের শাসন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাসহ সামগ্রিক বিচার কার্যক্রমে গতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে আইনটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে বলে মনে করে সংস্থাটি। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে ডিজিটাল সাক্ষ্যের অপরিহার্যতা বিবেচনায় সাম্প্রতিক সময়ে সাক্ষ্য আইনে ডিজিটাল সাক্ষ্য-সংক্রান্ত বিধানগুলো সংযোজন করা হলেও অপরাধ বা ঘটনার বিভিন্ন ভিডিওচিত্র, স্থিরচিত্র ও অডিও বা বিভিন্ন ডিজিটাল বিষয় বাস্তব ক্ষেত্রে বিচার প্রক্রিয়ায় দালিলিক প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার কিছুটা জটিল হওয়ায় প্রচলিত আইনের ধারাগুলোকে আরও সহজতর করা প্রয়োজন। এ ছাড়া প্রচলিত আইনের কিছু ধারা বর্তমান পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক অধস্তন আদালতের বিচারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৮৭২ সালে প্রণীত সাক্ষ্য আইন সংশোধনের মাধ্যমে যুগোপযোগী করা হলে মামলাজট নিরসনেও এটি ভূমিকা রাখবে। উন্নত দেশগুলো আগে থেকেই বিচার ব্যবস্থায় আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে আসছে। গত বছর সাক্ষ্য আইনে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়টি যুক্ত করা হলেও এর প্রয়োগে নানা বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। যার সুযোগ নিচ্ছেন সংক্ষুব্ধ পক্ষের আইনজীবীরা।

ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর আলী আসগর স্বপন সমকালকে বলেন, বর্তমান সাক্ষ্য আইনের ১৬১ ধারায় তদন্ত কর্মকর্তা অনেক সময় তাঁর ইচ্ছামতো সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণ করেন। পরে সেই সাক্ষী তা অস্বীকার করেন বা গরমিল দেখা যায়। এমন আরও অনেক বিষয় আছে, যেগুলো বিচারের ক্ষেত্রে ব্যাঘাত তৈরি করে। এ জন্য সাক্ষ্য আইনটি যুগোপযোগী হওয়া প্রয়োজন।