করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকায় দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ‘শাটডাউন’ দিয়ে অন্তত ১৪ দিন সারা দেশের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ রাখতে সুপারিশ করেছেন। তবে সরকার ঠিক সেই পথে হাঁটছে না। মানুষের জীবন-জীবিকাসহ দেশের বাস্তবতায় আরো কিছু বিষয় আমলে নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত আসতে যাচ্ছে। আগামীকাল সোমবার থেকে সীমিত পরিসরে এবং আগামী বৃহস্পতিবার থেকে সর্বাত্মক লকডাউনে যাওয়ার সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে সরকার। আগামী ৭ জুলাই পর্যন্ত এই লকডাউন চলবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে আজ রবিবার এসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে। তবে চলতি অর্থবছরের আর্থিক কার্যক্রম ঠিকভাবে শেষ করতে আগামী বুধবার পর্যন্ত সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে। গত রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নেতৃত্বে হওয়া উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে ৩০ জুন পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
গত বুধবার বৈঠক করে করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি সারা দেশে শাটডাউনের পরামর্শ দেওয়ার আগে থেকেই ঢাকার আশপাশের সাতটি জেলাসহ দেশের আরো কয়েকটি জেলায় লকডাউন চলছে। আর সারা দেশে লকডাউন জারির নীতিগত সিদ্ধান্ত গত শুক্রবার সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
গতকাল শনিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নেতৃত্বে ২০ জনের বেশি সচিব ও সচিব মর্যাদার কর্মকর্তা, করোনা বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী, বিভাগীয় কমিশনারদের নিয়ে বৈঠক হয়েছে। এ বৈঠকের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে লকডাউনের কঠোরতা বৃহস্পতিবার থেকে প্রয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে আসা প্রস্তাবসহ আজ প্রধানমন্ত্রীর কাছে লকডাউনসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারির প্রস্তাব যাবে। প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিলে আজ দুপুরের মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে।
কঠোর লকডাউনের মধ্যেও কিছু খাত খোলা রাখার চিন্তা সরকারের রয়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে গার্মেন্টসহ সব ধরনের রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানা, হিসাব বিভাগের সব অফিস, খাদ্যপণ্য পরিবহন, কৃষি, পোল্ট্রিসহ প্রাণিসম্পদের যানবাহন, ওষুধ, হাসপাতাল ও চিকিৎসাসেবা রয়েছে। এ ছাড়া গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের চলাফেরায় কোনো বাধা থাকবে না। প্রবাসীদের মধ্যে যাঁদের বিমান টিকিট থাকবে তাঁদেরও চলাচল অব্যাহত রাখার চিন্তা করছে সরকার। আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল চালু থাকবে। আদালত চলবে কি না তা-ও গতকাল পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। সরকারি সিদ্ধান্তের পর আদালত নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত নেবেন।
বৈঠকে থাকা একটি সূত্র জানায়, কাল থেকে সারা দেশে গণপরিবহন বন্ধ হয়ে যাবে, দোকানপাট-শপিং মল সীমিত পরিসরে চালু থাকতে পারে। আর অর্থবছরের কার্যক্রম শেষ হলে বৃহস্পতিবার থেকে সর্বাত্মক লকডাউন শুরু হবে। অন্য একটি সূত্র জানায়, রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানা খোলা থাকলেও শ্রমিকদের হেঁটে কর্মস্থলে যাওয়া-আসা করতে হবে। কারখানার মালিক বা শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদেরও কারখানায় থেকে কাজ করতে হবে। কেউ গাড়ি নিয়ে চলাচল করতে পারবে না। সরকারি কর্মচারীদের ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে কেউ বের হতে পারবেন না। শুধু জরুরি কাজের সঙ্গে যুক্তরা প্রয়োজনীয় গাড়ি ব্যবহার করতে পারবেন। প্রজ্ঞাপন জারির বিষয়ে একজন কর্মকর্তা বলেন, আজ প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার কথা রয়েছে, কোনো কারণে সেটা পেছাতেও পারে।
অর্থবছরের শেষ মাস হিসেবে জুন ক্লোজিং বিবেচনায় নিয়ে আর্থিক কার্যাবলির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের ৩০ জুন পর্যন্ত লকডাউনের আওতার বাইরে রাখা হবে। অন্যদিকে সীমিত পরিসরে ব্যাংক খোলা থাকার সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে আলাদা নির্দেশনা দেবে বলে জানা গেছে।
এবার লকডাউন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে আগেরবারের চেয়ে বেশি কড়াকড়ি হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, লকডাউন কার্যক্রম কড়াভাবে নিশ্চিত করার জন্য মাঠে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরা থাকবেন। প্রয়োজন অনুযায়ী সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও মাঠে নামানোর প্রস্তুতি থাকবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) সোহেল রানা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঘোষণা অনুযায়ী কঠোর বিধি-নিষেধের নির্দেশনা পালনের ক্ষেত্রে পুলিশ আগের মতোই প্রস্তুত। আদেশ পেলে জনকল্যাণে সরকার যে নির্দেশনা দেবে সে অনুসারেই আমরা কাজ করব।’
এর আগে বিভিন্ন সময়ে কঠোর লকডাউনে দূরপাল্লার বাস ও অন্যান্য গণপরিবহন নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলেও ছোট গাড়ির চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। এবার ছোট গাড়ির চলাচলও নিয়ন্ত্রণের চিন্তা করছে সরকার।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আগামী মাসে হতে যাওয়া ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করেই দ্রুত লকডাউনে যাচ্ছে সরকার। ঈদের সময় মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তাই ঈদের আগে আগে যদি করোনা সংক্রমণের হার নিম্নগামী করা যায় তাহলে গরুর হাট বসানো এবং ঈদে বাড়ি যাওয়া-আসার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন খুলে দিতে চায় সরকার। সারা দেশে কঠোর লকডাউন থাকলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবারও তৈরি পোশাক কারখানা খোলা থাকবে বলে আশা পোশাক খাতের নেতাদের।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি মো. ফারুক হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, এবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে পোশাক কারখানা খোলা রাখার ব্যাপারে সরকারের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। তবে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে আজ (শনিবার) রাতে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বৈঠকের পর। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় তথ্য অধিদপ্তরের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা সুরথ কুমার সরকারের সই করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কঠোর লকডাউনের সময় জরুরি সেবা ছাড়া সরকারি-বেসরকারি সব অফিস বন্ধ থাকবে। জরুরি পণ্যবাহী গাড়ি ছাড়া সব ধরনের যান চলাচলও বন্ধ থাকবে। অ্যাম্বুল্যান্স ও চিকিৎসাসংক্রান্ত কাজে শুধু যানবাহন চলাচল করতে পারবে। জরুরি কারণ ছাড়া বাইরে কেউ বের হতে পারবে না।
বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, পোশাক কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হলে শ্রমিকরা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে। এর ফলে সংক্রমণ বরং আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে সংক্রমণ একেবারে শূন্য বলা যায়। কারখানা ও শ্রমিকদের আবাস এলাকা করোনার শঙ্কামুক্ত।
নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় গার্মেন্ট কারখানা খোলা রাখার অনুমতি আমরা পেয়েছি।’
মন্ত্রিপরিষদের সচিব জানিয়েছেন, কঠোর লকডাউনের মধ্যেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিল্প-কারখানা খোলা থাকবে।
প্রসঙ্গত, গত বছর করোনা পরিস্থিতিতে পোশাক কারখানা বন্ধ হওয়ায় গ্রামে চলে গিয়েছিলেন হাজার হাজার শ্রমিক। আবার বেতন দেওয়ার খবরে ট্রাকে গাদাগাদি করে এবং হেঁটে হুড়মুড় করে কর্মস্থলে ফিরে আসেন সবাই। কিন্তু ঢাকায় পৌঁছে তাঁরা জানতে পারেন যে কারখানা বন্ধ। ফলে ওই সময় হাজার হাজার শ্রমিক অনিশ্চয়তায় পড়েন।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের অতিরিক্ত পরিচালক মনসুর আহম্মেদ এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, দেশে টেক্সটাইল মিলগুলো লকডাউনের আওতার বাইরে থাকবে। তবে এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি পরিপূর্ণভাবে মানতে হবে। তা না হলে যেকোনো পরিস্থিতির দায়ভার অ্যাসোসিয়েশন বহন করবে না।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েতউল্লাহ বলেন, ‘সরকার লকডাউন দিয়েছে। এটা জাতির স্বার্থে, আমরা পরিবহন মালিকদের লকডাউন মেনে চলার জন্য চিঠি দিয়েছি। তবে এটা সত্য যে দীর্ঘদিন দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকায় বাস মালিক ও শ্রমিকরা খুবই দুরবস্থার মধ্যে রয়েছে।’
সীমিত পরিসরে ব্যাংক খোলা রাখার বিষয়ে আজ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সার্কুলার জারি করা হবে। তবে কঠোর লকডাউনে সব ধরনের যান বন্ধ রাখার ঘোষণা আসায় নির্বিঘ্নে কর্মস্থলে যাতায়াত নিয়ে শঙ্কায় আছেন ব্যাংকের কর্মীরা। তাঁরা বলছেন, ব্যাংকাররা সেবা দিতে প্রস্তুত। গণপরিবহন বন্ধ থাকলে নির্বিঘ্নে ব্যাংকে যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাংকের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত হবে তা জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রজ্ঞাপন জারির পর সেই অনুসারে আমাদের সিদ্ধান্ত আসবে।’