রেমিট্যান্স প্রবাহে ধস, আট মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম

অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি প্রবাসী আয়। কয়েকমাস উর্ধ্বমূখী থাকলেও হঠাৎ ধস নেমেছে রেমিট্যান্স প্রবাহে। গত সেপ্টেম্বর মাসের ধারবাহিকতায় সদ্য সমাপ্ত অক্টোবার মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে আসা বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ আরও কমে গেছে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় সাড়ে সাত শতাংশ কমে গেছে। এতে এতটাই ধস নেমেছে যে অক্টোবরে আসা প্রবাসী আয়ের পরিমাণ গত আট মাসের মধ্যে সর্বনিম্ম। মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

এতে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের চতুর্থ মাস অক্টেবরে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশে ১৫২ কোটি ৫৪ লাখ (এক দশমিক সাড়ে ৫২ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। প্রবাসী আয়ের এ অঙ্ক আগের মাস সেপ্টেম্বরের তুলনায় ১৪ দশমিক ১৭ মিলিয়ন বা ১ কোটি ৪১ লাখ ডলার কম।

আর গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ কোটি ১৪ লাখ ডলার বা ৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ কম। গত বছরের অক্টোবরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৬৪ কোটি ৬৮ লাখ ডলার। এ ছাড়া আট মাস আগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশে ১৪৯ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল।

তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের টানা দুই মাস ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স বৈধ পথে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। গত আগস্ট মাসে ২০৩ কোটি ৭৮ লাখ (২ দশমিক ০৩ বিলিয়ন) ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে।

তার আগের মাস জুলাইয়ে এসেছিল ২০৯ কোটি ৬৩ লাখ ডলার। জুলাই মাসে পবিত্র ঈদুল আজহার কারণে দেশে বিপুল পরিমাণ প্রবাসী আয় এসেছিল। তবে আগস্টে বড় উৎসব ছিল না, তারপরও প্রবাসী আয় ২০০ কোটি ডলার ছাড়ায়। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে এতে ধস নামে। এক ধাক্কায় প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার কমে যায়।

নানা প্রচেষ্টা সত্তেও সে ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পাড়েনি প্রবাসী আয় খাত। বিশ্লেষকরা বলছেন পণ্যের দাম বাড়িয়ে অর্থপাচারের মাধমে দেশের ডলার বাজারে যে সংকট তৈরী করা হয়েছে তার প্রভাব পড়ছে বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহে।

সংকটের সুযোগ নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে হুণ্ডিচক্র। আর উর্ধ্ব মূল্যস্ফীতির কারণে বেশি টাকার আশায় ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে টাকা পাঠাচ্ছেন প্রবাসী বাংলাদেশীরা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, অক্টোবর মাসে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাঁচ বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ৩০ কোটি ৭২ লাখ মার্কিন ডলার।

বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১১৮ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার। বিদেশি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৭১ লাখ মার্কিন ডলার। আর বিশেষায়িত একটি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ২ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার।

আলোচিত সময়ে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে বরাবরের মতো বেসরকারি ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। ব্যাংকটির মাধ্যমে প্রবাসীরা ৩৫ কোটি ৮৪ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন।

এরপর রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকে ১০ কোটি ৬৪ লাখ ডলার, সোনালী ব্যাংকে ৮ কোটি ৯৪ লাখ, ডাচ-বাংলা ব্যাংকে ৮ কোটি ৬৫ লাখ এবং আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকে এসেছে ৮ কোটি ৪৮ লাখ ডলার প্রবাসী আয়। আলোচিত সময়ে সরকারি বিডিবিএল, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, বিদেশি ব্যাংক আল-ফালাহ, হাবিব ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান ও স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার মাধ্যমে কোনো রেমিট্যান্স আসেনি।

প্রসঙ্গত, প্রণোদনা ও ডলারের দাম বাড়ার পরও ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে বড় পতন হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ (২১ দশমিক ৩ বিলিয়ন) মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১১ শতাংশ কম। ২০২০-২১ অর্থবছরে দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ (২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন) ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।

বৈধ পথে রেমিট্যান্স আনতে ডলারের দাম বাড়ানোসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এখন বিদেশ থেকে যেকোনো পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠাতে কোনো ধরনের কাগজপত্র লাগে না। এছাড়া আবার প্রবাসী আয়ের ওপর আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার।

ডলারের সংকট নিরসন ও প্রবাসী আয় বাড়াতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নিজেরাই বসে ডলারের দাম নির্ধারণ করছে। ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) যৌথ সভায় এ দাম নির্ধারণ করে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় ব্যাংকেও এক্সচেঞ্জ হাউজের সমপরিমান ১০৭ টাকায় রেমিট্যান্স সংগ্রহের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

বাফেদার ঘোষিত দাম অনুযায়ী, এখন থেকে দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে প্রতি ডলার সর্বোচ্চ ১০৭ টাকা কিনতে পারবে ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনযায়ী, গতকাল আন্তব্যাংকে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য ছিল সর্বোচ্চ ১০৪ টাকা ৩৫ পয়সা এবং সর্বনিম্ন ১০৩ টাকা ১০ পয়সা।