রক্তএকধরনের লাল বর্ণের অস্বচ্ছ আন্তঃকোষীয় লবণাক্ত ও ক্ষারধর্মী তরল যোজক কলা। রক্তের লোহিত রক্ত কণিকায় হিমোগ্লোবিন নামক লৌহ ঘটিত প্রোটিন জাতীয় পদার্থ থাকায় রক্তের রং লাল হয়। একজন পূর্ণ বয়স্ক সুস্থ মানুষের দেহে প্রায় ৫-৬ লিটার রক্ত থাকে। যা মানুষের দেহের ওজনের শতকরা ৮ ভাগ। প্রত্যেক মানুষের রক্তের গ্রুপ জানা অতি জরুরি। আপনার রক্তের গ্রুপ জানা থাকলে হঠাৎ একজন মৃত্যুমুখী মানুষকে রক্তদিয়ে বাঁচানো সম্ভব হতে পারে। আবার আপনার প্রয়োজনেও অন্যরা এগিয়ে আসতে পারে। আমাদের জীবনে নানা দুর্ঘটনায় একজনের শরীর হতে অন্যজনের শরীরে রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। যেমন দুর্ঘটনায় আহতের অত্যাধিক রক্তক্ষরণ, সন্তান জন্ম দানকালে, মেয়েলি রোগ লিউকোমিয়া, ক্যান্সার, অপারেশনের সময় প্রচুর রক্তের প্রয়োজন হয়। রক্তের গ্রুপ জানা থাকলে একজন মানুষ অনায়াসে রক্তদান করতে পারে। একজন সুস্থ সবল পূর্ণবয়স্ক মানুষ প্রতি চার মাস পর পর রক্ত দিতে পারেন। এতে শরীরের কোন ক্ষতি হয় না। তবে রক্ত পরীক্ষা বা গ্রুপ না জেনে রক্ত গ্রহণ করা যাবে না। কোনো সংক্রামক রোগীর রক্ত গ্রহণ করা যাবে না। যেমন এইডস, সিফিলিস, যক্ষ্মা, হেপাটাইটিস বি, সি, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি। তবে মনে রাখবেন কোনো চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া রক্ত দেওয়া বা নেওয়া কোনোটাই করা যাবে না। মানব দেহের রক্তের এন্টিজেনকে এ ও বি নামে নামকরণ করা হয়। লোহিত কণিকায় রক্তের এন্টিজেনের উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে সমগ্র মানব জাতির রক্তকে চার ভাগে ভাগ করা হয়। এগুলো হলো এ, বি, এবি এবং ও। এটাকে এবিও গ্রুপিং বলে।
রক্তের উপাদান দুই প্রকার রক্ত রস ও রক্ত কণিকা। রক্ত কণিকা তিন প্রকার লোহিত রক্ত কণিকা, শ্বেত রক্ত কণিকা, অনুচক্রিকা। লোহিত রক্ত কণিকার প্লাজমা পর্দার বাইরে থাকে এন্টিজেন আর রক্তরসে থাকে এন্টিবডি। কোন মানুষের লোহিত রক্ত কণিকায় যদি এ এন্টিজেন থাকে তাহলে তার রক্তের গ্রুপ হবে এ। বি এটিজেন থাকলে তার রক্তের গ্রুপ হবে বি। এবি উভয় এন্টিজেন একসাথে থাকলে তার গ্রুপ হবে এবি এবং এবি কোনটাই না থাকলে তার রক্তের গ্রুপ হবে ও। এই এন্টিজেনগুলো উত্তরাধিকার সূত্রে মা বাবার নিকট থেকে সন্তানরা পেয়ে থাকে। এই রক্তের গ্রুপের ওপর নির্ভর করেই কে কাকে রক্ত দিতে পারবে বা নিতে পারবে তা নির্ভর করে। রক্তের আরেকটি অতিগুরুত্বপূর্ণ বিভাগ বা গ্রুপ হলো আরএইচ ফ্যাক্টর যা জানাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পারলে সন্তান নেবার পূর্বে অবশ্যই স্বামী ও স্ত্রীর আরএইচ ফ্যাক্টর পরীক্ষা করে জেনে নিতে হবে। আরএইচ ফ্যাক্টর না জানার কারনে সন্তান নেওয়ার সময় বড় সমস্যা হতে পারে। ১৯৪০ সালে কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার ও উইনার নামক দুইজন বিজ্ঞানী সর্বপ্রথম রেসাস নামক বানরের লোহিত রক্ত কণিকায় অস্থিত একধরনের এন্টিজেন আবিষ্কার করেন। এই রেসাস বানরের নাম অনুসারে এ এন্টিজেনকে রেসার্স ফ্যাক্টর বা আরএইচ ফ্যাক্টর বলে। এই ফ্যাক্টরের উপস্থিতির ভিত্তিতে রক্ত দুই প্রকার। আরএইচ পজেটিভ বা আরএইচ+ এবং আরএইচ নেগেটিভ বা আরএইচÑ। যাদের রক্তে আরএইচ এন্টিজেন থাকে তাদের গ্রুপকে পজিটিভ এবং আরএইচ এন্টিজেন না থাকলে এ গ্রুপকে বলা হয় আরএইচ নেগেটিভ।
সতর্কতা ঃ যদি কানো নেগেটিভ গ্রুপের ব্যক্তিকে পজিটিভ গ্রুপের রক্ত দেওয়া হয় তখন প্রথমবার গ্রহীতার দেহে সিমিত প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। তবে এতে রোগীর শরীরে আরএইচ পজেটিভ এন্টিজেনের বিপরীত অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হয়। যার ফলে ঐ রোগীর আবার কখনো যদি পজিটিভ গ্রুপের রক্ত নেয় তবে তার রক্তের কোষগুলো ভেঙে যাবে। এ কারণে কাঁপুনি, জ্বর কিংবা কিডনি অকেজো হয়ে যেতে পারে। মারাত্মক শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
স্বামী-স্ত্রীর আদর্শ রক্তের গ্রুপ ঃ স্বামীর রক্তের গ্রুপ যদি পজিটিভ হয় তাহলে স্ত্রীরও পজেটিভ হলে কোন সমস্যা নাই। আবার যদি স্বামীর রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ হয় তাহলে স্ত্রীর পজেটিভ বা নেগেটিভ যে কোন একটি হলেই হবে। তবে নেগেটিভ স্ত্রীর স্বামী সর্বদাই নেগেটিভ হলে ভাল হয়। তবে নেগেটিভ স্ত্রীর স্বামীর গ্রুপ যদি পজেটিভ হয় তাহলে প্রথম সন্তান জন্ম নেয়ার আগেই বা সাথে সাথে সন্তানের রক্তের গ্রুপ জানা জরুরী। কারণ বাচ্চা পজিটিভ গ্রুপের হলে ওকে ভাল মত ডাক্তারের পরামর্শ মত বিশেষ চিকিৎসা দিতে হতে পারে। আর মাকেও এন্টি ডি নামক এন্টিবডি ইন্জেকশন দিতে হয়। স্বামী স্ত্রী রক্তের কোন সমস্যা হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। তাই রক্তের গ্রুপ জেনে নিন আপনার অনাগত শিশুকে সুষ্ঠু সুন্দর সোনালী দিন উপহার দিন।
মোঃ জহিরুল আলম শাহীন
শিক্ষক ও স্বাস্থ্য বিষয়ক কলাম লেখক
ফুলসাইন্দ দ্বিপাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ।
গোলাপগঞ্জ, সিলেট