মৃত্যুর আগে গৃহবধূ বলেছিলেন, আমাকে এখন না নিলে লাশ নিতে হবে

‘আমাকে নিয়ে যাও বাবা। তাড়াতাড়ি না নিলে লাশ নিতে হবে তোমাকে।’– মৃত্যুর ছয় ঘণ্টা আগে বাবাকে ফোন করে কথাগুলো বলেছিলেন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের গৃহবধূ রোকসানা আক্তার। আট মাসের এ অন্তঃসত্ত্বাকে বুধবার বিকেলে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।

এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার সীতাকুণ্ড থানায় মামলা করেছেন নিহতের বাবা রিকশাচালক নুরুল আলম। মামলায় তিনি রোকসানার ভাশুর মোহাম্মদ মোস্তফা ও তার স্ত্রী তৈয়্যবা আক্তার স্বপ্নাকে আসামি করেছেন।

সীতাকুণ্ড মডেল থানার ওসি তোফায়েল আহমেদ জানান, গৃহবধূ রোকসানা হত্যা মামলায় মোস্তফা ও তার স্ত্রী তৈয়্যবা আক্তার স্বপ্নাকে বিকেলে আদালতে হাজির করলে তারা দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। এ ছাড়া জবানবন্দি দিয়েছেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবেশী হোসনে আরা বেগম। চট্টগ্রাম চিফ জুড়িশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মাহমুদুল হক, আবদুল্লাহ খান ও ফারদিন মুস্তাকিম তাসনিম তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করেন।

তিনি জানান, জবানবন্দিতে মোস্তফা ও স্বপ্না পরিকল্পিতভাবে রোকসানাকে হত্যার কথা স্বীকার করেছে। এ দম্পতি কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন কিবরিয়াকে (রোকসানার স্বামী) সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার জন্য আগে থেকেই নানা ষড়যন্ত্র করে আসছিল। তিন মাস আগে রোকসানাকে হত্যা করতে ৫০ হাজার টাকায় লোকও ভাড়া করে। কয়েকদিন আগে বাড়িতে ড্রেন কাটা নিয়ে ঝামেলা হয়। এরপর মোস্তফা খুনের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গত বুধবার সকালে স্থানীয় বাঁশবাড়িয়া বাজার থেকে হাতের গ্লাভস ও ৯০ টাকার কেরোসিন তেল কিনে আনে মোস্তফা। এরপর কাঠের টুকরা নিয়ে রোকসানার ঘরে ঢোকে মোস্তফা দম্পতি। রোকসানার মাথায় কাঠ দিয়ে আঘাত করলে মাটিতে পড়ে জ্ঞান হারান। এরপর শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ঘরে তুলা থাকায় বাইরে ধোঁয়া বের হলে তা দেখে আশপাশের মানুষ ছুটে আসেন। প্রতিবেশী ভাড়াটিয়া হোসনে আরা বেগম এসে দেখে ফেলায় তাকে হত্যার হুমকি দিয়ে তাড়িয়ে দেয় মোস্তফা। মৃত্যু নিশ্চিতের পর লাশ খাটে রাখা হয়। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের মাধ্যমে সব জ্বালিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা মোস্তফা করেছিল বলে আদালতকে জানিয়েছে।

বুধবার উপজেলার বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের জোড়বটতল রহমতেরপাড়া গ্রামে স্বামীর ঘর থেকে আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা রোকসানার লাশ উদ্ধার করা হয়। তার গর্ভে যমজ সন্তানের ভ্রূণ ছিল। বৃহস্পতিবার সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ময়নাতদন্ত শেষে লাশ স্বজনের কাছে হস্তান্তর করে সীতাকুণ্ড মডেল থানা পুলিশ। পরে বিকেলে উপজেলার মাদামবিবিরহাট খাদেমপাড়া বাবার বাড়িতে লাশ দাফন করা হয়।

এ সময় নিহতের বাবা নুরুল আলম বলেন, সম্পত্তি দখলের জন্যই আমার মেয়েকে খুন করা হয়েছে। ভাশুর মোস্তফা ও জা স্বপ্না আগে থেকেই আমার মেয়েকে নির্যাতন করত। শুক্রবার ফোন করে বলেছিল, বাবা ভাশুর ও জা নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। ঘর থেকে বের করে দিচ্ছে। এরপর বুধবার সকাল ১০টার দিকেও ফোন করে বলেছিল, ‘আমাকে নিয়ে যাও বাবা। তাড়াতাড়ি না নিলে আমার লাশ নিতে হবে তোমাকে। আমি সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলাম, স্থানীয় মাতবরদের সঙ্গে কথা বলে শুক্রবার নিতে আসব। এর ছয় ঘণ্টা পরই মেয়ের মৃত্যুর খবর পাই।

কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, অভাবের সংসারে মেয়ে আমার সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য সব নির্যাতন সহ্য করেছে। কিন্তু তাকে রক্ষা করতে পারলাম না। আমি হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই।

এদিকে, ঘটনার পরপরই মোস্তফা দম্পতির সঙ্গে রোকসানার স্বামী আনোয়ার হোসেন কিবরিয়া, তার ভগ্নিপতি দলিল লেখক হারুন-অর রশিদকে আটক করে পুলিশ। মামলায় বাকি দু’জনকে আসামি না করায় আদালতের মাধ্যমে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়।