মসলিন মুসলিম বাংলার ঐতিহ্য। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের জন্মস্থান কাপাসিয়া সম্প্রতি স্বীকৃতি পেয়েছে মসলিন তৈরির ফুটি কার্পাস তুলার আদি আবাসস্থলের।
ইরাকের বিখ্যাত ব্যবসাকেন্দ্র মসুলে পাওয়া যেত অতিসূক্ষ্ম কাপড়। মসুলের সূক্ষ্ম কাপড়তুল্য ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় তৈরি বাংলার ঐতিহ্যবাহী বস্ত্র নাম-বিবর্তনের ধারায় হয় মসলিন। রাজকীয় পোশাক ঢাকাই মসলিন, ফুটি কার্পাস চড়কায় কেটে সর্বনিম্ন ৩০০ কাউন্টের সুতায় হাতে বোনা স্বচ্ছ ও অতিসূক্ষ্ম কাপড়।
মুসলিম বাংলার ঐতিহ্য মসলিনের আছে দীর্ঘ ইতিহাস। রোম সাম্রাজ্যের সোনালি অতীতেও রোমান নারীদের প্রিয় পোশাকের নাম ঢাকাই মসলিন। তখন মোটা মসলিন-মলোচিনা, প্রশস্ত-মসৃণ মসলিন-মোনাচি, সর্বোত্কৃষ্ট মসলিনকে গঙ্গাজলি বলা হতো।
নবম শতকে রচিত আরব ভৌগোলিক সোলাইমানের ‘সিলসিলাতুত তাওয়ারিখ’ বর্ণিত একটি রাজ্যের নাম রুমি। এই রুমি রাজ্যকে বাংলাদেশের সঙ্গে অভিন্ন ধরা চলে। এখানেই এমন সূক্ষ্ম-মিহি বস্ত্র পাওয়া যেত, তা ছিল চার হাজার দুই হাত এবং এক টুকরা কাপড় সহজেই আংটির ভেতর দিয়ে নাড়াচড়া করা যেত। বিখ্যাত পর্যটক ইবনু বতুতা সোনারগাঁয়ের বস্ত্রশিল্পের প্রশংসা করেছেন। সম্রাট আকবরের সভাসদ আবুল ফজলও সোনারগাঁয়ের সূক্ষ্ম বস্ত্রের প্রশংসা করতে কম যাননি।
মুসলিম বাংলার গর্ব মসলিন ১৭৫৭ সালে পলাশীর বিপর্যয়ের ধারায় হারিয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের বর্ণনায় ইতিহাসবিদ আব্দুল করিম রচনা করেছেন ‘ঢাকাই মসলিন’ গ্রন্থ। জানা যায়, উনিশ শতকে তৈরি একটি মসলিন ১৮৫১ সালে বিলেতে প্রদর্শিত হয়েছিল। এক হাজার এক গজ এই মসলিনের ওজন ছিল আট তোলা। ঢাকা জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত এক হাজার দুই গজ মসলিনের ওজন সাত তোলা। কথিত আছে, ৫০ মিটার দীর্ঘ একটি মসলিন অনায়াসে একটি দিয়াশলাই বাক্সে রাখা যেত।
সূক্ষ্মতা, বুননশৈলী, নকশার পার্থক্যে মসলিন অন্তত ২৮ প্রকারের হতো। নামকরণে ব্যবহৃত হতো আরবি, ফারসি শব্দ। যেমন—
মলবুস খাস : আসল পোশাক, এটি তৈরি হতো সম্রাটদের জন্য। আঠারো শতকের শেষে মলবুস খাসের মতো তৈরি আরো উন্নত মানের মসলিনকে বলা হতো ‘মলমল খাস’।
সরকার-ই-আলা : মলবুস খাসের মতোই উন্নত সরকার-ই-আলা মসলিন তৈরি হতো বাংলার নবাব ও সুবাদারদের জন্য।
ঝুনা : হিন্দি ঝিনা থেকে ঝুনা অর্থ সূক্ষ্ম। ঝুনা মসলিন তৈরিতে ব্যবহৃত হতো স্বল্প সুতা ও সূক্ষ্ম বয়ন কৌশল। কাপড় হতো হালকা জালের মতো। মোগল রাজদরবার ও হারেমের মহিলারা গরমকালে ঝুনা মসলিনের জামা গায় দিতেন।
আব-ই-রাওয়ান : ফারসি আব-ই-রাওয়ান অর্থ প্রবাহিত পানি। সূক্ষ্মতায় আব-ই-রাওয়ান মসলিন পানির মতো টলমলে স্বচ্ছ। বলা হয়, নবাব আলীবর্দী খানের সময় এই মসলিন মাঠে শুকাতে দিলে ঘাস-কাপড়ের পার্থক্য না বুঝে অবলীলায় গরু ঘাস খেতে গিয়ে আব-ই-রাওয়ান খেয়ে ফেলেছিল।
খাসসা : ফারসি শব্দ খাসসা। ঘন বুনন, সূক্ষ্ম-মিহি বৈশিষ্ট্যে খাসসা মসলিন ছিল আসলেই খাসা। এই মসলিনকে ইংরেজরা বলত ‘কুষা’।
শবনম : শবনম অর্থ শিশির। ভোরের ঘাসে শুকাতে দিলে সূক্ষ্মতার জন্য শিশিরভেজা ঘাসের মধ্যে এই মসলিন দেখাই যেত না।
নয়ন সুখ : গলাবন্ধ, রুমাল ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হতো নয়ন সুখ। মসলিনের এই নামটিই শুধু বাংলা।
বদন খাস : বদন অর্থ শরীর। সম্ভবত এ রকম মসলিন শুধু জামা তৈরির কাজে ব্যবহৃত হতো।
সরবন্ধ : শব্দটি ফারসি সিরবন্ধ থেকে, অর্থ মাথাবাঁধা। প্রাচীন বাংলার রাজকর্মচারীদের পাগড়ি তৈরিতে ব্যবহৃত হতো সরবন্ধ।
ডোরিয়া : ডোরাকাটা মসলিন। এটি ব্যবহৃত হতো নানা শৌখিন কাজে।
জামদানি : বর্তমানে কার্পাস তুলায় তৈরি বিশেষ শৌখিন কাপড়কে জামদানি বলা হলেও প্রাচীনকালে পাগড়ি, রুমাল, পর্দা, ওড়না, কুর্তা, শেরওয়ানি ইত্যাদিতে নকশা ফুটিয়ে তুলে তৈরি বিশেষ মসলিনকে জামদানি বলা হতো।
আরো কিছু মসলিনের নাম পাওয়া যায়—মলমল (সূক্ষ্মতম), রঙ্গ (স্বচ্ছ, জালিজাতীয়), আলাবালি (অতিমিহি), তরাদ্দাম ও তনজেব (দেহের অলংকারসদৃশ), সরবুটি, চারকোন (ছক কাটা) ইত্যাদি বস্ত্র।
দুঃখজনক, ব্রিটিশরা শুধু আমাদের স্বাধীনতা হরণ করেনি, তারা আমাদের ঐতিহ্যকেও কবর দিয়েছে। বিপুল করারোপ ও বয়নশিল্পীদের আঙুল কেটে দেওয়ায় মসলিন, মসলিনের কারিগর হারিয়ে যায় কালস্রোতের গভীরে। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মঞ্জুর হোসেনের নেতৃত্বে একদল নিঃস্বার্থ, দেশপ্রেমী গবেষকের দীর্ঘ ছয় বছরের সাধনায় মুসলিম বাংলার ঐতিহ্য মসলিন আবার ফিরে আসছে। ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর ‘ঢাকাই মসলিন’কে জিআই (ভৌগোলিক নির্দেশক) স্বত্বের অনুমোদন দেওয়া হয়।