মানবজীবনে পরকালে বিশ্বাসের প্রভাব

পরকালে বিশ্বাস মানুষের জীবনের বাঁক বদলে দেয়। মানুষকে নিয়মমাফিক ও বিধিবদ্ধ জীবনাচারে বাধ্য করে। যেকোনো পরিস্থিতিতে মানুষকে সৎকর্মশীলতার ওপর দৃঢ় রাখে তার বিশ্বাস। এটা না থাকলে ঝুঁকির মুখে পদস্খলন ঘটার সমূহসম্ভাবনা থাকে। নিম্নে আমরা পরকালে বিশ্বাসের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব—

 

শরিয়তের ফায়সালা হাসিমুখে গ্রহণ করে

মায়াজ আসলামি, গামেদি প্রমুখ নারী রাসুল (সা.)-এর যুগে স্বেচ্ছায় নিজের মৃত্যুদণ্ডের মতো কঠিন শাস্তি চেয়ে নিয়েছেন শুধু আখিরাতে মুক্তি লাভের আশায়। এভাবেই মানুষ ইসলামী শরিয়তের ফায়সালা হাসিমুখে গ্রহণ করে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীরা, তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর এবং আনুগত্য করো রাসুলের ও তোমাদের নেতৃবৃন্দের। অতঃপর যদি কোনো বিষয়ে তোমরা বিতণ্ডা করো, তাহলে বিষয়টি আল্লাহ ও রাসুলের দিকে ফিরিয়ে দাও। যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। এটাই কল্যাণকর ও পরিণতির দিক দিয়ে সর্বোত্তম।’ (সুরা নিসা, হাদিস : ৫৯)

এখানে ফায়সালা মেনে নেওয়ার জন্য আখিরাতের বিশ্বাসকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কেননা আখিরাতের স্বার্থেই মানুষ দুনিয়াবী স্বার্থ ত্যাগ করে।

 

সৎকর্মে দৃঢ়তা সৃষ্টি করে

বদরের যুদ্ধে রাসুল (সা.) কম্যান্ড দেন, ‘তোমরা দাঁড়িয়ে যাও জান্নাতের পানে। যার প্রশস্ততা নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলব্যাপী বিস্তৃত।’ এ নির্দেশ শুনে সাহাবি ওমায়ের ইবনুল হুমাম আনসারি বলে ওঠেন, হে আল্লাহর রাসুল, জান্নাতের প্রশস্ততা কি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলব্যাপী? তিনি বলেন, হ্যাঁ। তখন তিনি বলেন, ছাড়! ছাড়! (বাখ, বাখ)! রাসুল (সা.) তাকে বলেন, তুমি এরূপ বললে কেন? তিনি বলেন, আল্লাহর কসম! হে আল্লাহর রাসুল, জান্নাতের অধিবাসী হওয়ার আশায়। তিনি বলেন, নিশ্চয়ই তুমি তার অধিবাসী। তখন ওমায়ের স্বীয় কোষ থেকে কতগুলো খেজুর বের করেন ও তা খেতে থাকেন। কিছু পরে বলেন, আমি যদি এই খেজুরগুলো খাওয়া পর্যন্ত বেঁচে থাকি, তবে অবশ্যই সেটি হবে দীর্ঘ হায়াত। অতঃপর তিনি বাকি খেজুরগুলো ছুড়ে ফেলে দিলেন ও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। অবশেষে তিনি শহীদ হয়ে গেলেন। (মুসলিম, হাদিস : ১৯০১)

 

বিপদে ধৈর্য ধারণের শক্তি বৃদ্ধি পায়

পরকালে বিশ্বাস বিপদে ধৈর্য ধারণের শক্তি জোগায়। আল্লাহ বলেন, ‘বলো, হে আমার বিশ্বাসী বান্দারা, তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো। (মনে রেখো) যারা এ দুনিয়ায় সৎকাজ করে, তাদের জন্য আছে পুণ্য। আর আল্লাহর পৃথিবী প্রশস্ত। নিঃসন্দেহে ধৈর্যশীলরা তাদের পুরস্কার পাবে অপরিমিতভাবে।’ (সুরা জুমার, আয়াত : ১০)

মক্কায় নির্যাতিত অবস্থায় ইয়াসির পরিবারকে লক্ষ্য করে রাসুল (সা.) বলেন, ‘ধৈর্য ধরো, হে ইয়াসির পরিবার! নিশ্চয়ই তোমাদের ঠিকানা হলো জান্নাত।’ (মুসতাদরাক হাকেম, হাদিস : ৫৬৪৬)

 

সর্বাবস্থায় আল্লাহভীতি অর্জন

আখিরাতে বিশ্বাস মানুষকে সর্বাবস্থায় আল্লাহভীরু বানায় এবং সে প্রবৃত্তির তাড়না থেকে সংযত থাকে। আল্লাহ বলেন, ‘পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তার রবের সামনে দণ্ডায়মান হওয়ার ভয় করেছে এবং নিজেকে প্রবৃত্তির গোলামি থেকে বিরত রেখেছে, জান্নাত তার ঠিকানা হবে।’ (সুরা নাজেআত, আয়াত : ৪০-৪১)

 

অল্পে তুষ্ট থাকার গুণ অর্জিত হয়

একদিন ওমর (রা.) রাসুল (সা.)-এর কাছে গেলেন। সে সময় তাঁর মাথার নিচে ছিল একটা খেজুর পাতা ভরা চামড়ার বালিশ। আর পিঠে ও পার্শ্বদেশে ছিল চাটাইয়ের দাগ। এটা দেখে ওমর কেঁদে উঠলেন। রাসুল (সা.) বলেন, তুমি কাঁদছ কেন? ওমর বলেন, ‘পারস্য সম্রাট কিসরা ও রোম সম্রাট কায়সার কী অবস্থায় আছে, আর আপনি কী অবস্থায় আছেন। অথচ আপনি আল্লাহর রাসুল! জবাবে রাসুল (সা.) বলেন, ‘তুমি কি চাও না যে তাদের জন্য হোক দুনিয়া ও তোমার জন্য হোক আখিরাত!’ (বুখারি, হাদিস : ৪৯১৩)। এভাবেই পরকালে বিশ্বাস অল্পে তুষ্ট থাকতে অনুপ্রাণিত করে।

 

আখিরাতে বিশ্বাস মজলুমের জন্য সান্ত্বনার স্থল

আখিরাতে বিশ্বাস মজলুমের জন্য সান্ত্বনার স্থল। ইহকালে বা পরকালে জুলুমের বিচার হবেই। ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি অবশ্যই এ কথা ভেবো না যে জালিমরা যা করে আল্লাহ সে বিষয়ে উদাসীন। তবে তিনি তাদের সেদিন পর্যন্ত অবকাশ দেন, যেদিন তাদের চোখ বস্ফািরিত হবে। যেদিন ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ভীত-বিহ্বলচিত্তে তারা দৌড়াতে থাকবে। নিজেদের দিকে দৃষ্টি ফেরানোর সময় তাদের হবে না। যেদিন কঠিন ভয়ে তারা শূন্যহৃদয় হয়ে যাবে।’ (সুরা ইবরাহিম, আয়াত : ৪২-৪৩)

 

ব্যক্তি ও সমাজজীবনে আমূল পরিবর্তন আসে

রাসুল (সা.)-এর মাক্কি জীবনের বেশির ভাগ সুরা নাজিল হয়েছে আখিরাত বিশ্বাসের ওপর। এর পথ ধরে আবু বকর, ওমর, ওসমান, আলী, ইবনে মাসউদ, বেলাল, খাব্বাব, আম্মার, মুসআব প্রমুখ জান্নাতপাগল নিখাদ মানুষগুলোর হাতেই পুরা আরব জাহানে আমূল পরিবর্তন আসে। যা সর্বাত্মক সমাজ বিপ্লবের সূচনা করে। এর ঢেউ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ইসলাম বিশ্বধর্মে পরিণত হয়।

যখন যে সমাজে সত্যিকারের আখিরাত পিয়াসী একদল মুমিন তৈরি হয়, তখন সেই সমাজে আমূল পরিবর্তন আসে এবং সমাজ বিপ্লব সাধিত হয়। আল্লাহ বলেন,  ‘আর তোমরা ওই দিনকে ভয় করো, যেদিন তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে ফিরে  যাবে। অতঃপর সেদিন প্রত্যেকে নিজ নিজ কর্মের ফল পুরোপুরি পাবে এবং তাদের প্রতি কোনো ধরনের অবিচার করা  হবে না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত :

২৮১)