পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে মানুষের ভোটাধিকার

মানুষের ভোটাধিকার লুণ্ঠন করা হয়েছে। হরণ করা হয়েছে গণতন্ত্র। স্বৈরতন্ত্রের খোলসের ভেতরে দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচার আজ মহামারি আকারে রূপ নিয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণ দরকার। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন রাতের আঁধারে লুট হয়ে যাওয়া মানুষের ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। লুণ্ঠিত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা।

যুগান্তরের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা, বিশিষ্ট আইনজীবী ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন।

তিনি আরও বলেন, দেশ আজ একটি দল ও পরিবারের হাতে জিম্মি। কোথাও কাউকে জবাবদিহিতা করতে হচ্ছে না। বিনা ভোটে জয়ী হওয়ার সংস্কৃতি চালু হয়েছে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে আইন এবং এ সংক্রান্ত বিধিবিধান থাকলে অনেক সংকটই এড়ানো যেত। ইসি গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির চলমান সংলাপ, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, চলমান রাজনীতিসহ দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির ওপর বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন ড. কামাল হোসেন।

বুধবার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বিশেষ প্রতিনিধি শেখ মামুনুর রশীদ। দীর্ঘ আলাপচারিতার চুম্বকীয় অংশ নিচে দেওয়া হলো-

ড. কামাল হোসেন বলেন, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হচ্ছে জনগণের শাসন। আর এই শাসন ব্যবস্থা আবর্তিত হয় মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের মধ্য দিয়ে। ‘আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকে দেবো’-এটাই মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার মূল শর্ত। দুর্ভাগ্য মানুষ এখন আর পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারছে না। এমনকি ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোটও দিতে পারছে না। আমরা দেখলাম, দিনের ভোট আগের দিন রাতেই হয়ে গেছে। এর মধ্য দিয়ে ভোটাধিকার হরণ করা হলো। গণতন্ত্রকে হত্যা করা হলো। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে এর চাইতে বড় লজ্জার বিষয় আর কিছু হতে পারে না। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আর এসব দেখে তিনি নিজেও লজ্জিত হতেন।

তিনি জানান, গণতন্ত্র বলেন, আইনের শাসন বলেন, সুশাসন বলেন, জবাবদিহিতা বলেন-এর সবকিছুই নির্ভর করছে মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগ নিশ্চিত করার ওপর। সে অধিকার এখন আর এ দেশের মানুষের নেই, কিংবা গায়ের জোরে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তাই সবার আগে লুট হয়ে যাওয়া ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছার পাশাপাশি একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন। সরকারি প্রভাবমুক্ত, কারসাজিমুক্ত নির্বাচন। কালোটাকা ও পেশিশক্তির প্রভাবমুক্ত নির্বাচন। যে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণ তাদের পছন্দের মানুষকে ভোট দিয়ে জয়ী করবেন। এই অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই বঙ্গবন্ধু আজীবন লড়াই করেছেন। জীবন দিয়েছেন। অথচ তার হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগ আইয়ুব-ইয়াহিয়ার পথ অনুসরণ করে গণমানুষের এই মৌলিক অধিকারটাই হরণ করেছে।

ইসি গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির চলমান সংলাপ সম্পর্কে জানতে চাইলে ড. কামাল হোসেন বলেন, প্রয়োজন ছিল আইন প্রণয়ন। সংবিধানেও সেই কথা বলা আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আজও আইনটি হয়নি, বিধিবিধান হয়নি। কোনো সরকারই এই আইন প্রণয়নে উদ্যোগ নেয়নি। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি একজন ভালো মানুষ। সজ্জন মানুষ। এর আগেও তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইসি গঠন নিয়ে সংলাপ করেছেন। এবারও করছেন। ফলাফল কী হবে, মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হবে কিনা-তা সময়ই বলবে। তবে অতীত অভিজ্ঞতা যে সুখকর ছিল না-তা আমরা সবাই জানি, দেখেছিও। বর্তমান নির্বাচন কমিশন একটি আজ্ঞাবাহী প্রতিষ্ঠাতে পরিণত হয়ে সরকারের একের পর এক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে। আগামী ইসিও যে একই পথে হাঁটবে না, এর নিশ্চয়তা কে দেবে?

ড. কামাল হোসেন বলেন, বর্তমান সরকার তো চাইবে আরও একটি আজ্ঞাবাহী ইসি গঠন করতে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে আজ্ঞাবাহী প্রশাসন। যাদের দিয়ে তারা আগামী দিনের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করাবে। এটা প্রতিহত করতে সবার আগে প্রয়োজন জনগণের ঐক্য। রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য। এই ঐক্যের মধ্য দিয়ে প্রয়োজন সংবিধানের আলোকে একটি আইন ও বিধিবিধান প্রণয়নে সরকারকে বাধ্য করা। নির্দলীয়-নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও শক্তিশালী ইসি গঠনের দাবি আদায় করা এবং পরবর্তীতে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং প্রশাসনিক প্রভাবমুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করা। এটি না করা পর্যন্ত আমরা ক্রমাগত অন্ধকারের দিকেই হাঁটব। মানুষের অধিকার বলে কিছু থাকবে না।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং প্রশাসনিক প্রভাবমুক্ত নির্বাচন চাই। তবে এটা নির্ভর করবে কাদের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তার ওপর। কারা ইসিতে থাকবেন এবং এই ইসির ভূমিকা কী হবে তার ওপর। প্রশাসনও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, আন্দোলন-সংগ্রাম ছাড়া অধিকার বাস্তবায়ন করা যায় না। রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সেই অধিকার আদায়ের পথে হাঁটতে হবে।

ড. কামাল হোসেন বলেন, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিকল্প নেই। এটি হলে সুশাসন, আইনের শাসন, জবাবদিহিতা আপনাআপনি নিশ্চিত হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, এখন দেশে এসবের কিছুই নেই। দেশ আজ একটি দল ও পরিবারের হাতে জিম্মি। কোথাও কাউকে জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। বিনা ভোটের জয়ী হওয়ার সংস্কৃতি চালু হয়েছে। আগে এমপি হতো বিনা ভোটে। এখন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরাও নির্বাচিত হচ্ছেন বিনা ভোটে। সরকারি দলের প্রার্থীরা জনগণের মতামত নেওয়ার বিষয়টি তোয়াক্কাই করছেন না। বঙ্গবন্ধু এমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেননি। তিনি বলেন, এটা ঠিক উন্নয়নমূলক বেশকিছু প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর চাইতেও কয়েক হাজার গুণ বেশি হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতি-লুটপাট, অর্থ পাচার, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি তো মহামারি আকারে রূপ নিয়েছে। প্রবৃদ্ধি ও রিজার্ভ বাড়ার কথা বলা হচ্ছে। এতে সরকারের কোনো অবদান নেই। প্রবাসীরা টাকা পাঠাচ্ছে। কৃষক ফসল ফলাচ্ছে। শ্রমিক উৎপাদন করছে। বেকারত্ব বহুগুণে বেড়েছে, সে কথা বলা হচ্ছে না। নতুন কোনো কর্মসংস্থান নেই। বিনিয়োগে হাজারটা বাধা। ধনী আরও ধনী হচ্ছে। গরিব আরও গরিব হচ্ছে। সরকারি দলের মন্ত্রী-এমপি-নেতারা বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ছে। বেগম পাড়ার ঘটনা তো সবারই জানা। এভাবে একটি দেশ চলতে পারে না। এসবের অবসান জরুরি।