এক যুগেরও বেশি সময় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বিদেশি প্রতারকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশের মানুষের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বিপ্লব লস্কর।
হয়েছেন বিপুল সম্পত্তির মালিক। বিপ্লব ছাড়াও এমন প্রতারণায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে দেশি-বিদেশি আরও ১০ প্রতারককে।
পূর্বাচলে বিলাসবহুল একটি ডুপ্লেক্স বাড়ির মালিক বিপ্লব লস্কর। কয়েক কোটি টাকা খরচ করে তিনি বাড়িটি নির্মাণ করেছেন তিনি।
বাংলাদেশে অবৈধভাবে বসবাসরত আফ্রিকার কয়েকটি দেশের নাগরিকদের মাধ্যমে দেশে যে পার্সেল প্রতারণা হয়ে আসছে, তার মূল হোতা বিপ্লব লস্কর।
এই প্রতারণার একটি বড় অংকের টাকার ভাগ পায় বিপ্লব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে গেল ১৫ বছর ধরে ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল লস্কর।
অবশেষে গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ তাকে গ্রেফতার করেছে। সাথে গ্রেফতার হয়েছে দেশি-বিদেশি আরও ১০ জন।
সোমবার রাতে তাদেরকে রাজধানীর মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগের ওয়েব বেজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম।
পরের দিন মঙ্গলবার দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এনিয়ে বিস্তারিত জানান গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি প্রধান) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
তিনি বলেন, পার্সেল প্রতারক কখনো দেশে কখনো দেশের বাইরে থেকে সামাজিক মাধ্যমে বন্ধুত্ব গড়ে পার্সেলে ডলার বা উপহার পাঠানোর ফাঁদ পেতে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
দেশি-বিদেশি প্রতারক সদস্যরা বিভিন্ন পন্থায় ফেসবুক আইডি, হোয়াটসঅ্যাপ, ই-মেইল সংগ্রহ করে ইউএস আর্মি, ইউএস নেভিসহ বিভিন্ন পরিচয়ে ধর্ণাঢ্য ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পর্ক করতো।
সম্পর্কে একটি পর্যায়ে দামি উপহার স্বর্ণ, মূল্যবান পাথর, হিরা, বিশাল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা, ডলার-ইউরো ইত্যাদি পাঠানোর কথা বলে ফাঁদে ফেলে।
এরপর সেগুলো ব্যক্তির নাম ঠিকানা উল্লেখ করে ভুয়া পার্সেলের ছবি পাঠায়। প্রতারিত ব্যক্তিরা সরল বিশ্বাসে পার্সের গ্রহণের অপেক্ষায় থাকেন।
প্রতারক চক্রের কলিং বিভাগে কর্মরত বাংলাদেশী প্রতারকরা বিভিন্ন অপারেটরের নম্বর ব্যবহার করে নিজেকে কাস্টমস অফিসার পরিচয় দিয়ে ফোন করতো।
বলা হতো কিং এক্সপ্রেস সার্ভিস থেকে একটি পার্সেল এসেছে। পার্সেলটি ছাড়াতে কাস্টমস হাউজ ফি বাবদ মোটা অংকের টাকা পরিশোধ করতে হবে।
ডিবিপ্রধান বলেন, পার্সেল পাওয়ার আশায় কথিত কাস্টমস কর্মকর্তার দাবি করা টাকা পাঠিয়ে দেয়। এরপর কাস্টমস কর্মকর্তা পরিচয়দানকারী ব্যক্তি আবারও ফোন করে।
জানায়, বিদেশি বন্ধুর পাঠানো পার্সেলে বিপুল পরিমাণ অবৈধ ডলার রয়েছে। যা ছাড়াতে আরো বেশি টাকা প্রয়োজন। এই টাকা দিতে ব্যর্থ হলে মিথ্যা মামলার ভয়ভীতি দেখানো হতো।
প্রতারিত ব্যক্তিরা মামলার ভয়ে প্রতারকদের দেয়া বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে দাবি করা টাকা পাঠালে আবারও ফোন করে পুলিশ এবং সাংবাদিককে ম্যানেজের কথা বলে আরো টাকা চাইতো।
প্রতারকরা তাদের দাবি করা টাকা তাদের সরবরাহকৃত ব্যাংক আ্যকাউন্টে জমা হকার সঙ্গে সঙ্গে প্রতারণার শিকার হওয়া ব্যক্তিকে সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্লক করে দিত।
হারুন বলেন, কুলি থেকে কোটিপতি হয়েছেন গ্রেপ্তার বিপ্লব লস্কর। রাজধানীতে তার রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট ও প্লট। বিদেশিদের প্রতারণার শতাধিক ঘটনার সঙ্গে বিপ্লব জড়িত।
নিজেরে গ্রেপ্তার এড়াতে গাড়িতে ও তার সঙ্গে সব সময় নেটওয়ার্ক জ্যামার ব্যবহার করতেন। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরেও তাকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।
গেলো পাঁচ বছরে কোনো বাংলাদেশী ফোন নাম্বার ব্যবহার করেনি বিপ্লব। রাউটার ব্যবহার করে ইন্টারনেট ফোনের মাধ্যমে সে প্রতারকদের সাথে যোগাযোগ করতো।
বাবা ও ভাইদের সাথে কুলির কাজ করতো বিপ্লব। দুই হাজার সালে তার পোশাক ব্যবসা শুরু করে। এ সময় পরিচয় হয় ক’জন নাইজেরিয় নাগরিকের সঙ্গে। তারপরে শুরু প্রতারণা ব্যবসা।
চক্রটিকে সহায়তা করা বিপ্লব লস্করের নিয়ন্ত্রণে ছিলো ব্যাংক হিসাবগুলো। টাকা তুলে বিদেশি সদস্যদের পৌঁছে দিয়ে পেতেন মোটা অঙ্কের কমিশন।
পরে প্রতারণা থেকে প্রাপ্ত অর্থ, বাংলাদেশে থাকা প্রতারকরা ব্যবসায়ের নামে পাঠিয়ে দেয় নিজ দেশে। বিপ্লবের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলাসহ অপহরণ, অস্ত্র ও প্রতারণার মামলাও রয়েছে।
পাশাপাশি বিদেশি প্রতারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস মিলেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে। জানা গেছে, এই প্রতারণার সাথে জড়িত বাকিদের ধরতে চলমান রয়েছে অভিযান।
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশীদ আরও বলেন, বিদেশি প্রতারক চক্রটি গ্রেপ্তার নুসরাতের মতো বহু বাংলাদেশিদের সহায়তায় এভাবে দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণা করে আসছিলো।
চক্রটি প্রতারণায় ব্যবহৃত ব্যাংক আ্যকাউন্টগুলো বিভিন্ন ব্যক্তির পাসপোর্ট জাল করে বিভিন্ন ব্যাংকে শত শত আ্যকাউন্ট ও ক্রেডিট কার্ড নিয়েছে।
এ সব ব্যাংকের চেক ও এটিএম কার্ড ব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে অর্জিত টাকা তুলে নিত। আর এই টাকা তোলা ও টাকা ভাগাভাগির কাজটি করত বিপ্লব লস্কর।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন- বাংলাদেশি মূলহোতা বিপ্লব লস্কর, তার সহযোগী সুমন হোসেন ইমরান, মহসীন হোসেন শাওন, ইমরান হাসান ইকবাল, নাজমুল হক রনি, মোসা. নুসরাত জাহান।
এছাড়া নাইজেরিয়ান নাগরিক চিডি, ইমানুয়েল, জন, আঙ্গোলিনার নাগরিক উইলসন ডে কনসিকাউ, ক্যামেরুনের নাগরিক গুলগ্নি পাপিনি।
গ্রেপ্তারের সময় একটি বিদেশি পিস্তল-গুলি, ২৮টি মোবাইল, কম্পিউটার, ৪৯১টি এটিএম কার্ড, ২৬টি চেক বই, তিনটি রাউটার, একটি প্রাইভেটকার, সাড়ে ৩ লাখ জাল টাকা, নগদ ১১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা ও ২৬৩টি সিমকার্ড জব্দ করা হয়।
বিদেশী সুন্দরী নারীর ছবি দিয়ে খোলা ফেসবুক একাউন্টের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেয়ে বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক স্থাপনে সতর্ক থাকার পরামর্শও দিয়েছেন এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।