২০২২ হাংচৌ এশিয়ান গেমসে প্রথমবার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ই-স্পোর্টস। আট ইভেন্টে পদকের লড়াই হবে ২৪টি। বাংলাদেশও অংশ নিচ্ছে তিনটি ইভেন্টে। অনলাইন গেমসে বাংলাদেশের সম্ভাবনা নিয়ে দুই পর্বের আজ শেষ পর্ব
ফেডারেশন কাপ ফুটবলে এবার শিরোপা জিতেছে আবাহনী। প্রাইজ মানি হিসেবে ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি পায় পাঁচ লাখ টাকা। অথচ গত সপ্তাহে যমুনা ফিউচার পার্কে হওয়া অনলাইন গেমস ‘অ্যারেনা অব ভেলোর বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ’-এর প্রাইজ মানি ছিল ২৫ লাখ টাকা। চ্যাম্পিয়ন টিম ওরিয়েন্টাল ফিনিক্স পেয়েছে ১২ লাখ টাকা।
আর রানার্স আপ হওয়া উই ই-স্পোর্টস আর্মাডা পায় ছয় লাখ টাকা। চীনের টেক জায়ান্ট টেনসেন্ডের পৃষ্ঠপোষকতায় হওয়া টুর্নামেন্টের অন্যতম স্পন্সর ছিল মোবাইল ফোন কম্পানি ইনফিনিক্স।
ফ্লোরার উদ্যোগে ২০১৮ সালে এ রকম আরেকটি টুর্নামেন্টের প্রাইজ মানিও ছিল লোভনীয়। দেশে নতুন শুরু হওয়া অনলাইন গেমসের এত বিশাল অঙ্কের প্রাইজ মানি নিয়ে জনপ্রিয় খেলোয়াড় ও ই-স্পোর্টস কলামিস্ট কাজী আরাফাত হোসেন জানালেন, ‘অনলাইনের খেলায় উদ্যোক্তার অভাব নেই। আমাদের এখন একটা প্ল্যাটফর্ম দরকার। এশিয়ান গেমসে যেহেতু খেলাটা আছে, তাই নতুন ফেডারেশন গড়ার উদ্যোগ নিতে পারে বিওএ। ’
অ্যারেনা অব ভেলোর গেমসটি রয়েছে ২০২২ হাংচৌ এশিয়ান গেমসে। এই গেমসে বেশি খেলোয়াড় প্রয়োজন বলে বিওএ ইভেন্টটি নিয়ে ভাবছে না। তবে যে তিনটি ইভেন্টে অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশ, সেখানে ভালো করলে ভবিষ্যতে নতুন ফেডারেশন তৈরির কথা জানালেন বিওএর ডিরেক্টর জেনারেল ফখরুদ্দিন হায়দার, ‘অনলাইন গেমসের ফেডারেশন নেই দেশে। খেলাটা নতুন। ফেডারেশন করতে হলে ৬৪ জেলার মধ্যে অন্তত ৪৪টিতে শাখা থাকতে হবে, অল্প সময়ে খুব কঠিন এটা। এ জন্য চীনের হাংচৌতে বিওএর হয়েই খেলবেন আমাদের ছয় খেলোয়াড়। আমরা যদি ভালো ফল পাই তাহলে ভবিষ্যতে একটা কাঠামোর মধ্যে তো আনতেই হবে। অনেকে আমার কাছে নিজেদের খরচে এশিয়ান গেমসে যাওয়ার আগ্রহের কথা জানিয়েছে। আমরা আমলে নিচ্ছি না। খেলতে গিয়ে কেউ ফিরে না এলে দায় নেবে কে?’
ফেডারেশন যেহেতু নেই তাই মার্চে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপটা হবে কিভাবে? হাংচৌর জন্য খেলোয়াড় বাছাই তো সেখান থেকেই হবে। বিওএ এ জন্য নির্ভরশীল বাংলাদেশে অনলাইন গেমসের অন্যতম পথপ্রদর্শক শেখ রেজাউর রহমান রনির ওপর। সেই রনি নিজেদের পরিকল্পনা নিয়ে জানালেন, ‘বাস্কেটবল ফেডারেশনের কাছে চিঠি দেব। কর্তারা অনুমতি দিলে তাদের মাঠে বাছাই পর্বটা করব। আমরাই তত্ত্বাবধানে থাকব, তবে পৃষ্ঠপোষকতা করবে বিওএ। সেখানে উন্মুক্ত বাছাই পর্বের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন ছয় খেলোয়াড়। আর একটা কথা বলতে চাই, অনলাইন গেমস মানেই আসক্তি নয়। এখন মেসি যদি ২৪ ঘণ্টা ফুটবল নিয়ে থাকেন বা সাকিব ২৪ ঘণ্টা ব্যাট-বল নিয়ে মাঠে থাকেন তাহলে তো হবে না। অনলাইন গেমসও দিনে দুই-তিন ঘণ্টা খেললেই হয়। এটা নিয়ে অপপ্রচারের সুযোগ নেই। ’
২০০৭ সালে ওয়ার্ল্ড সাইবার গেমসে প্রথমবার অংশ নেয় বাংলাদেশ। ২০০৮ সালে একই টুর্নামেন্টে অংশ নেয় এক্সেল নামের একটি দল। এর পর থেকে রাফসান আগা, আব্দুর রহমান সাফি, ফারহান ইসলাম, আবরাররা অংশ নিয়ে আসছেন বিদেশের নানা টুর্নামেন্টে। ২০১৮ সালে দক্ষিণ এশিয়ার অনলাইন টুর্নামেন্টে রেড ভাইপার লীগ অব লিজেন্ডসে চ্যাম্পিয়ন হন রাফসান আগা। ডোটা-২-এ ভারতকেও হারানোর কৃতিত্ব আছে বাংলাদেশের। তবে এশিয়ান গেমসে মাত্র ছয়জন খেলোয়াড় বাংলাদেশের হয়ে তিনটি খেলায় অংশ নেবেন বলে সাফল্য নিয়ে শতভাগ নিশ্চিত নন রাফসান, ‘দেখুন ফুটবল, হকি, ক্রিকেট, সাঁতার—সব আলাদা খেলা। একজন খেলোয়াড় একসঙ্গে চারটিতে ভালো করতে পারবে না। অনলাইন গেমসগুলোও তা-ই। একেক খেলায় ভালো করেন একেকজন। ছয়জনে তিনটি খেলায় কতটা কী করতে পারবে আমি নিশ্চিত নই। তবে ২০২৬ সালের এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ পদকের লড়াইয়ে থাকবে—এটা আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি। ’
দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, চীনে ই-স্পোর্টসের বাজার রীতিমতো রমরমা। গেমস ও ই-স্পোর্টসের বাজার সংক্রান্ত গবেষণা করে নিউজু। তাদের তথ্য মতে, চীনে ২০১৭ সালে ই-স্পোর্টসের বাজার ছিল ৭০.৬১ বিলিয়ন ইয়েনের। ২০২২ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১৫.৭ বিলিয়ন ইয়েনে। তাই চীনের আগ্রহে তাদের দেশে হতে যাওয়া এশিয়ান গেমসে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ই-স্পোর্টসের আটটি ইভেন্ট। নিউজু জানিয়েছে, ২০২৩ সালের শেষে বিশ্বে অনলাইন গেমসের বাজার হবে ২০৪.৬ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ সাড়ে ১৭ লাখ কোটি টাকার মতো।
বিশাল এই বাজারে বাংলাদেশের অংশ কতটা? এ নিয়ে গবেষণা নেই। দেশে অনলাইন গেমস নিয়ে ব্যবসা করছে উল্কা গেমস, হাম্বা গেমস, প্লেইনজ, থান্ডার গেমস, ফ্রি পিক্সেল গেমস, রাইজ আপ ল্যাবস, আলফা পটেটোর মতো কিছু প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ কয়েকজন কর্তার ধারণা দেশে অনলাইন গেমসের বাজার অন্তত ৫০০ কোটি টাকার। উল্কা গেমসের প্রধান নির্বাহী জামিলুর রশিদ জানাচ্ছেন, ‘গত বছর আমাদের ৫০ কোটি টাকার মতো আয় হয়েছে। আমরা ট্যাক্স দিয়েছি ১১ কোটি টাকা। অন্য কম্পানিগুলোও ভালো ব্যবসা করছে। সব মিলিয়ে দেশে অনলাইন গেমসের বাজার ৫০০ কোটি টাকার কাছাকাছি হবে। ’
এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের প্রতিযোগীরা ভালো করলে এই বাজারের আকার আরো বাড়বে বলে বিশ্বাস শেখ রেজাউর রহমান রনির, ‘আমাদের অনেক খেলোয়াড় মাসে ৫০-৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করছে। ২০২৫ সালে খুব ভালো জায়গায় যেতে পারে অনলাইন গেমস। এশিয়ান গেমসে আমরা ভালো করলে দেশের বাজার হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। দেশের জন্য অপার সম্ভাবনাই হতে পারে ই-স্পোর্টস। ’