তালেবানের উত্থান: পাকিস্তানের জন্য আশির্বাদ নাকি অভিশাপ

পশ্চিমা বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ আফগানিস্তানে নতুন তালেবান সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করার আশা করছে। সেক্ষেত্রে তাদের চাওয়া, পাকিস্তান মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করুক। কারণ, আফগানিস্তানের সঙ্গে দেশটির অনন্য সম্পর্ক রয়েছে।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে ২ হাজার ৫৭০ কিলোমিটার (এক হাজার ৬০০ মাইল) সীমান্ত রয়েছে। তারা বাণিজ্য পার্টনার এবং উভয়ের মধ্যে অসংখ্য সাংস্কৃতিক, জাতিগত ও ধর্মীয় সংযোগ রয়েছে। আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই এই সম্পর্ককে বর্ণনা করেছেন ‘অবিচ্ছেদ্য ভাই’ হিসেবে।

এর বাইরে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাকিস্তানকে দৃঢ় মিত্র হিসেবে কখনোই দেখা যায়নি। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো অভিযোগ করে যে, তালেবানকে পাকিস্তান সহায়তা করে। যদিও এই অভিযোগ সবসময় অস্বীকার করে আসছে ইসলামাবাদ।

 

তবুও পশ্চিমা কূটনীতিকরা তালেবানকে তাদের নাগরিকদের আফগানিস্তান ত্যাগের অনুমতি দিতে রাজি করাতে চায়। একই সঙ্গে মানবিক সহায়তা দেওয়া এবং পরিমিত শাসনও চায়। এক্ষেত্রে তাদের পাকিস্তান এবং এই অঞ্চলের অন্যান্যদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
আফগানিস্তান ও তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক

2০০১ সালের সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কের টুইন-টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা আফগানিস্তান থেকেই হয় বলে অভিযোগ। সে সময় তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হিসেবে পাকিস্তান অবস্থান নেয়। কিন্তু ঠিক একই সময়ে দেশটির সামরিক ও গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানের কিছু অংশ তালেবানের মতো আফগানিস্তানের ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। যার কারণে অভিযোগ উঠে, গোষ্ঠীগুলোকে লজিস্টিক সহায়তা দিত ইসলামাবাদ।

কূটনীতিকদের মাঝে বিশ্বাস ছিল যে, পাকিস্তান আফগানিস্তানে একটি অংশীদারিত্ব চায়। যেন তারা এটা নিশ্চিত হতে পারে যে দেশটি এমন সরকারের সঙ্গে শেষ হবে না, যারা ভারতপন্থী। ফলে তালেবানকে পাকিস্তানের সমর্থন এবং সময়কাল বিতর্কিত রয়ে গেছে। এটিও সত্য যে, ২০ বছর আগে তালেবান যখন সর্বশেষ ক্ষমতায় ছিল তখন তাদের যে অল্প কয়েকটি দেশ স্বীকৃতি দিয়েছিল, পাকিস্তান তার মধ্যে অন্যতম। এমনকি গত মাসে তালেবানরা কাবুল দখল করার পর পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন, ‘আফগানিস্তানে গোষ্ঠীটি দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে দিয়েছে’।

পাকিস্তানের চিন্তার কারণ

তালেবানের জন্য পাকিস্তানের ঐতিহাসিক সমর্থনের অর্থ এই নয় যে, তারা কাবুলে গোষ্ঠীটির দখল নেওয়ার ব্যাপারে সম্পূর্ণ খুশি। আফগানিস্তান থেকে সীমান্তে হামলা চালানো ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর হাতে বছরের পর বছর ধরে পাকিস্তানিরা চরম ভোগান্তিতে ছিল। এমতাবস্থায় কাবুলের নতুন সরকারকে আল কায়েদা এবং আইএসআইএস-কে এর মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই ও তাদের দমন করতে ইসলামাবাদ পদক্ষেপ নিতে পারে। ফলে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, তালেবানের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে কাজ করতে আগ্রহী পাকিস্তান।

পাকিস্তানের আরেকটি বড় উদ্বেগ শরণার্থী সংকট। দেশটিতে আগে থেকেই প্রায় ৩ মিলিয়ন আফগান শরণার্থী রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের ভঙ্গুর অর্থনীতির সঙ্গে নতুন করে শরণার্থী নেওয়ার সামর্থ্য আর নেই।

সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত মোয়াজ্জেম আহমদ খান বলেছেন, আমাদের আসলে বেশি শরণার্থী নেওয়ার সক্ষমতা নেই। এ জন্যই আমরা পরামর্শ দিচ্ছি এবং অনুরোধ করছি যে, আসুন একসঙ্গে বসে কাজ করি।

পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এর প্রভাব

পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়। সম্ভবত সবচেয়ে খারাপ অবস্থা তাদের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেই। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত তিনি পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ফোনকলও দেননি।

 

চলতি সপ্তাহে একটি পলিসি এক্সচেঞ্জ সেমিনারে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল এইচ আর ম্যাকমাস্টার বলেছেন, পাকিস্তান যদি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সমর্থন বন্ধ না করে, তাহলে তাদের জাতিচ্যুত রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।

 

আমাদের পাকিস্তানকে অংশীদার বলা বন্ধ করতে হবে। কারণ, তারা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে সংগঠিত, প্রশিক্ষণ ও সজ্জিত করে। পাশাপাশি ইসলামাবাদ তাদের পররাষ্ট্র নীতির একটি বাহু হিসেবে ব্যবহার করে আমাদের বিরুদ্ধে শত্রু জাতি হিসেবে কাজ করছে, যোগ করেন তিনি।

অবশ্য মার্কিনীদের দৃষ্টিভঙ্গি অন্যান্য পশ্চিমা শক্তিকে পাকিস্তানের দরজায় কড়া নাড়তে বাধা দেয়নি। তালেবানরা কাবুল দখল করার পর ইতিমধ্যে ইসলামাবাদ সফর করে গেছেন ব্রিটেন ও জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী। শিগগিরই ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রীও আসবেন বলে জানা গেছে।

কূটনীতিকরা বিশ্বাস করেন, পাকিস্তান এখনো তালেবানের ওপর কিছুটা প্রভাব বিস্তার করে। তারা এটাও আশঙ্কা করছে যে, পাকিস্তানকে এড়িয়ে গেলে দেশটি চীনের আরও কাছাকাছি যেতে উৎসাহিত হবে। যা পশ্চিমা বিশ্ব মোটেই চায় না।