চীন অনেকদিন ধরেই সিঙ্গাপুরকে নিজের প্রভাব বলয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। বেইজিং বিষয়টিকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই নিয়েছে এবং সিঙ্গাপুরকে যথেষ্ট চাপে রেখেছে। অন্যদিকে এ বিষয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকেও। বলা যায় ক্ষুদ্র দ্বীপ দেশটি দুই সুপার পাওয়ারের রশি টানাটানির মধ্যে আটকে গেছে।
সিঙ্গাপুরে জাতিগত চীনাদের সংখ্যা বেশি। সংগত কারণে সেখানে চীনের প্রতি সমর্থনও বেশি। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও তাদের সম্পর্ক যথেষ্ট গভীর। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গত মাসে পিউ রিসার্চ সেন্টার একটি জরিপ করে। ১৭টি অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসরমান দেশের ওপর পরিচালিত ঐ সমীক্ষায় চীনের বিষয়ে গড়পড়তা ২৭ ভাগ ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়। তবে সিঙ্গাপুরের ক্ষেত্রে নির্দিষ্টভাবে এই হার ছিল ৬৪ শতাংশ। ১৭টি দেশের মধ্যে সিঙ্গাপুরেই চীনের প্রতি সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করা হয়। বিপরীতে জাপানে এই হার দেখা যায় ১০ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ায় ২১ ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ২২ শতাংশ।
সিঙ্গাপুরের গবেষণা সংস্থা আইএসইএএস-ইউসোফ ইসহাকের চলতি বছরের স্টেট অব সাউথইস্ট এশিয়া সার্ভে রিপোর্টে পিউ রিসার্চের অনেকটা বিপরীত চিত্র উঠে এসেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের ১০টি দেশের শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের ওপর করা জরিপে দেখা গেছে, ৫৭ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন না চীনা নেতৃবৃন্দ বিশ্বশান্তি রক্ষায় যথা সময়ে ঠিক কাজটি করবেন। এটি সিঙ্গাপুরের এলিট শ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গি। ১০টি দেশ হিসাবে নিলে গড়পড়তা সংখ্যাটি ৬৩ শতাংশে পৌঁছায়।
সিঙ্গাপুরে সর্ববৃহত্ বৈদেশিক বিনিয়োগকারী যুক্তরাষ্ট্র। এক জন সিনিয়র মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, সিঙ্গাপুর তাদের মিত্রজোটের বাইরে একটি অংশীদার হলেও তারা মিত্রের চেয়ে কোনো দিক দিয়েই কম নয়। ২০০৪ সালে দুদেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিটি ছিল এশিয়ায় কোনো দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য চুক্তি। দুদেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতাও যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ। লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইআইএসএসের নির্বাহী পরিচালক টিম হাক্সেলি তার লিওন সিটি : দ্য আর্মড ফোর্সেস অব সিঙ্গাপুর বইতেও বিষয়টি দেখিয়েছেন।
বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকায় সিঙ্গাপুর পরীক্ষার মুখে পড়েছে। দেশটির এক জন অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক বিলাহারি কাউসিকান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে একই সঙ্গে খুশি রাখার কোনো চটজলদি ফর্মুলা সিঙ্গাপুরের হাতে নেই। বস্তুত সিঙ্গাপুর এই দুই পক্ষের সঙ্গে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করছে। যেমন ২০১৯ সালে সিঙ্গাপুর ১৯৯০ সালে সম্পাদিত সামরিক সহযোগিতা চুক্তি নবায়ন করে। এ চুক্তি বলে যুক্তরাষ্ট্র সিঙ্গাপুরের বিমান ও নৌঘাঁটিগুলো ব্যবহার করতে পারে। বিনিময় সিঙ্গাপুর যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সব ধরনের সামরিক সহযোগিতা পাবে।
এ চুক্তি নবায়নের এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে সিঙ্গাপুর চীনের সঙ্গেও করা একটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি নবায়ন করে। এ চুক্তির আওতায় দুই দেশ সামরিক প্রশিক্ষণ, নিয়মিত মন্ত্রী পর্যায় বৈঠক ও পারস্পরিক সামরিক পরিদর্শনে সম্মত হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, সিঙ্গাপুরকে দুই সুপার পাওয়ারের সঙ্গে যেভাবে ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে হচ্ছে আসিয়ানের কোনো দেশ এতটা চাপের মধ্যে নাই। যুক্তরাষ্ট্র চায় সিঙ্গাপুর তাদের ‘মুক্ত ও অবাধ ইন্দো প্যাসিফিক কৌশল’ সমর্থন করুক।
বলা হচ্ছে, এর লক্ষ্য প্রশান্ত মহাসাগরে অবাধ নৌচলাচল, সমুদ্র নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল থাকা। কিন্তু ঐ অঞ্চলে চীনের রাশ টেনে ধরাই যে এর অন্যতম লক্ষ্য সেটা এখন ওপেন-সিক্রেট। এ কারণে সিঙ্গাপুর এখনো এই নীতির প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেনি। তাছাড়া দ্বীপ দেশটি ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাটোবহির্ভূত মিত্র হওয়ার প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছিল।