আনোয়ার হোসেন
অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা এবং লাইসেন্স নবায়ন না করে লক্ষ্মীপুর জেলার পূর্বাঞ্চল চন্দ্রগঞ্জ থানা এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠছে মানহীন বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। চন্দ্রগঞ্জ থানাধীন ৯ ইউনিয়নের হাটে-বাজারে নিবন্ধন ও লাইসেন্স পুনঃনবায়ন ছাড়াই চলছে বহু বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, মান্দারী, চন্দ্রগঞ্জ, দাসের হাট, পোদ্দার বাজার।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি ক্লিনিকের নিবন্ধন পেতে প্রয়োজনীয় ভৌত সুবিধা, সার্বক্ষণিক ডাক্তার, ডিপ্লোমা নার্স, ওয়ার্ডবয়, আয়া, ক্লিনারসহ প্রয়োজনীয় জনবল, যন্ত্রপাতি, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ থাকা আবশ্যক।
এছাড়াও ১০ বেডের একটি ক্লিনিকের অনুমোদনের ক্ষেত্রে শুধু রোগীর ওয়ার্ডের জন্য প্রতি বেডে ৮০ বর্গফুট করে মোট ৮০০ বর্গফুট জায়গা লাগবে। সেই সঙ্গে ওটি রুম, পোস্ট ওপারেটিভ রুম, ওয়াস রুম, ইনস্ট্রুমেন্ট রুম, লেবার রুম, ডক্টরস ডিউটি রুম, নার্সেস ডিউটি রুম, অপেক্ষমাণ কক্ষ, অভ্যর্থনাকক্ষ, অফিস কক্ষ, চেইনঞ্জিং রুম, স্টেরিলাইজার রুম, ভান্ডার রুমসহ সামঞ্জস্যপূর্ণ অন্তত ১৩টি রুম থাকতে হবে।
এছাড়া পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা প্রয়োজনীয়সংখ্যক টয়লেট, প্রশস্ত সিঁড়ি, জেনারেটরসহ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে (বিল্ডিং তিনতলার অধিক হলে) লিফটের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ওটি রুমে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, ওটি টেবিল, পর্যাপ্ত ওটি লাইট, সাকার মেশিন, অ্যানেসথেসিয়া মেশিন, ডায়াথারমি মেশিন, জরুরি ওষুধসমূহের ট্রে, রানিং ওয়াটার, অক্সিজেন, আইপিএসের ব্যবস্থা থাকতে হবে। সাধারণ বর্জ্য, ধারালো বর্জ্য, জীবাণুযুক্ত বর্জ্য, তরল বর্জ্যসহ সব ধরনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও থাকা অত্যাবশ্যকীয়। জনবলকাঠামোতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, তিন জন ডিউটি ডাক্তার, ছয় জন ডিপ্লোমা নার্স, প্রয়োজনীয় অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী, ওয়ার্ডবয়, আয়া, ক্লিনার, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ ২৩শে অগাস্ট (রোববার) রাত ১২টার মধ্যে যারা নিবন্ধন ও লাইসেন্স নবায়ন প্রক্রিয়ায় আবেদন সম্পন্ন করবেন না তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ বাজারে অবস্থিত শর্ম্মা মেডিকেল হল, এস.এম.কে হাসপাতাল, আল-রাজী মেডিকেল সার্ভিসেস, মেডিএইড ডায়াগনস্টিক সেন্টার এন্ড কনসালটেশন, রয়েল হসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও চন্দ্রগঞ্জ জেনারেল হসপিটাল এন্ড ডায়াবেটিক সেন্টার। এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানের নেই নিবন্ধন, অথবা করা হয়নি লাইসেন্স নবায়ন। বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ পাওয়া যায় অদক্ষ নার্স এবং টেকনিশিয়ান দিয়ে চলে পরীক্ষা নিরীক্ষা। অনেক সময় দেয়া হচ্ছে ভুল রিপোর্ট। ভুল চিকিৎসার কারণে ঘটছে প্রাণহানি। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, প্রশাসন নিরব থাকায় দিন দিন এসব ক্লিনিকগুলো আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় এস.এম.কে হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে ফাতেমা বেগম নামের এক রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ পাওয়া যায়। একই অভিযোগ রয়েল হাসপাতালের বিরুদ্ধে; ২০১৯ সালের মে মাসে ভুল চিকিৎসায় রুবিনা আক্তার নামে এক প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে বলে।
জানা যায়, আগস্ট ২০১৬ সালে সদর উপজেলা নিবাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ নুরুজ্জামান এক ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন৷ এতে অবৈধভাবে ক্লিনিক পরিচালনার দায়ে শর্ম্মা মেডিকেল হলে সিলগালা ও লাইসেন্স নবায়ন না থাকায় এবং ভুয়া টেকনিশিয়ান দ্বারা মেডিকেল রিপোর্ট করার অভিযোগে আল-রাজী মেডিকেল সার্ভিসেস ও মেডিএইড নামে আরো দুইটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার সাময়িক বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই শুরু করে তাদের অবৈধ কার্যক্রম৷
অনুসন্ধানে দেখা যায়, হাতুড়ে ডাক্তার রণজিৎ শ্মর্মাধিকারি ও প্রণব শর্ম্মাধিকারী চন্দ্রগঞ্জ শর্ম্মা মেডিকেল হল নামে নিবন্ধনহীন প্রতিষ্ঠান চালিয়ে আসছে দীর্ঘদিন৷ নামের আগে লিখেছেন ডাক্তার। ডিগ্রীও আছে ডিএমএস, বিএইচই (স্বাস্থ্য)। সপ্তম শ্রেণি পাশ স্ত্রী সুমিতা রানী শর্ম্মাধিকারী, তিনিও ডাক্তার লিখেছেন নামের আগে। কন্ট্রাকে চিকিৎসা করা হয় এখানে। রোগীর ধরণ বুঝে চুক্তিভিত্তিক চিকিৎসা করা হয়। ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা কন্ট্রাকে চিকিৎসা দেওয়ার নামে রোগীদের সাথে চলছে চরম প্রতারণা। দীর্ঘদিন যাবত চিকিৎসার নামে রোগীদের সাথে এমন প্রতারণা চলে আসলেও কেউ তাদের কিছুই করতে পারেনি।
কথিত ডাক্তার রণজিৎ শ্মর্মাধিকারি ও প্রণব শর্ম্মাধিকারী সব রোগের প্রেসক্রিপশন (এ্যালোপ্যাথিক ওষুধ) লিখেন। জ্বর, সর্দি, কাশি, বাত ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, অর্শ, গেজ, ওরিশ ও ভগন্দর রোগসহ যাবতীয় চিকিৎসা করেন তারা। কেউ প্রতিবাদ করলে দমন করার জন্য কয়েকজন ভাড়াটিয়া লাঠিয়ালও নিয়মিত পোষেন কথিত এই ডাক্তারগণ।
এবিষয়ে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর জেলা সিভিল সার্জন ডা. আবদুল গফফার বলেন, বৈধ ডাক্তারও অনুমোদনহীন এরকম হাসপাতাল চালু করার কোনো বৈধতা নেই৷ খোঁজখবর নিয়ে এদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।