গ্রাম ভালো লাগে কিন্তু শহরে থাকতে ইচ্ছা হয়, সে প্রবল ইচ্ছাতেই হোক বা অনিচ্ছাতে। নাগরিক সুযোগ সুবিধা, আয় নানান সম্ভাবনা বিচারে বসবাসের জন্য শহরকেই অগ্রারিধাকার দেয়া হয়ে থাকে। একটা সময় এই কংক্রিটের ভীতে দাঁড়িয়ে থাকা শহরই হয়ে ওঠে থিতু ঠিকানা। যদিও উন্নত বিশ্বের শহরগুলো আরো বেশি সুন্দর। কিন্তু ঠিক এই কারণটাতেই যে একটা সময় গ্রামের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেতে পারে ভেবে দেখেছেন কখনও?
ইউরোপ মহাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের দেশ স্পেন । শাসন ব্যবস্থার ধরন অনুযায়ী দেশটিতে সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজতন্ত্র বিরাজমান। এটি ইবেরীয় উপদ্বীপের প্রায় ৮৫ শতাংশ এলাকাজুড়ে অবস্থিত। স্পেনের উত্তরে বিস্কায়া উপসাগর এবং উত্তর-পূর্বে পিরিনীয় পর্বতমালা দেশটির সঙ্গে ফ্রান্স এবং অতিক্ষুদ্র রাষ্ট্র অ্যান্ডোরার একটি প্রাকৃতিক সীমানা গঠন করেছে। এছাড়া পূর্ব দিকে ভূমধ্যসাগর, দক্ষিণে ভূমধ্যসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগর এবং পশ্চিমে পর্তুগাল ও আটলান্টিক মহাসাগর স্পেনের বাকী সীমানা নির্ধারণ করেছে।
আয়তনের বিচারে রাশিয়া, ইউক্রেন ও ফ্রান্সের পরে স্পেন ইউরোপের চতুর্থ বৃহত্তম এবং দক্ষিণ ইউরোপের বৃহত্তম দেশ। স্পেনের আয়তন ৫ লাখ ৫ হাজার ৯৯০ বর্গকিলোমিটার। আর এই দীর্ঘ আয়তনের দেশটিতে বসবাস ৮ কোটি ২৭ লাখের অধিক মানুষের। পুরো স্পেনের ৭০ ভাগ জায়গা খালি রেখে ৩০ শতাংশ স্থানে বসবাস করে দেশটির সকল জনগণ। বলা যায় প্রায় সব দেশেই রুটিরুজির তাগিদে মানুষ শহরে ভিড় করছেন। আর এই সুযোগে গ্রামের পৈতৃক ভিটে অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। আগের সঙ্গে পরে একটা সময় গ্রামের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। আগে যেখানে চাষবাস, পশুপালন হতো৷ কিন্তু শতাব্দী শেষে পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। চাষবাসের গুরুত্ব কমে যায় এবং অবহেলার ফলে মানুষ শিল্পক্ষেত্রে কাজের সন্ধান করতে লাগে আর এই সুযোগে পরিতক্ত হয়ে পড়ে দেশটির অনেক সাজানো গোছানো গ্রাম। স্পেনের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর মাদ্রিদ। এছাড়া বার্সেলোনা, বালেন্সিয়া, সেবিইয়া, বিলবাও এবং মালাগা অন্যান্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে বাড়তে থাকে মানুষের ভিড়।
গত অর্ধ শতাব্দীজুড়ে, স্পেনের গ্রামীণ এলাকাগুলি প্রায় ৩০ শতাংশ জনসংখ্যা হারিয়েছে, কারণ তরুণরা বার্সেলোনা এবং ভ্যালেন্সিয়া বা রাজধানী মাদ্রিদের মতো উপকূলীয় শহরগুলিতে চলে গেছে৷ এই প্রবণতাটি দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ এখন মাত্র ৩০ শতাংশ জমিতে বসবাস করে। সেই হিসেবে অবশিষ্ট ৭০ ভাগ জমি এখন অব্যহৃত যাকে এস্পানা ভাসিয়া বা “খালি স্পেন” বলে অভিহিত করা হয়। সারাদেশে হাজার হাজার পুয়েব্লো অর্থাৎ খালি গ্রীষ্মকালীন বাড়ি, বন্ধ দোকান এবং বয়স্ক বাসিন্দাদের ক্রমহ্রাসমান জনসংখ্যার সমন্বয়ে তৈরি একটি শান্ত অস্তিত্বে নিযুক্ত করা হয়েছে। তারা প্রায়শই ভাবতে থাকে যে তারা মারা যাওয়ার পরে যে জায়গাগুলিকে তারা বাড়ি বলে ডাকে তাদের কী হবে।
স্পেনে বর্তমানে পরিত্যক্ত রয়েছে ছবির মতো সুন্দর ছোট ছোট ৩ হাজার ৫শ’ ৬২টি গ্রাম । আর প্রতিটি গ্রাম নিজ নিজ সৌন্দর্যে তুলনাহীন। জনমানুষহীন গ্রামগুলোতে বসবাসের অভাবে সৌন্দর্যেও যেন ভাটা পড়েছে। জীবিকার তাগিদে বা বিশ্বায়নের প্রভাবে অনেকেই গ্রাম ছেড়ে শুরু করেন শহরে যেতে। শহরে যাওয়ার সংখ্যা একের পর এক বাড়তে থাকায়। সেখানকার অধিবাসীরা নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। শহুরে নাগরিক জীবনের নিত্য ব্যস্ততায় জন্মভূমির মায়া হালকা হয়েছে অনেকেরই। একসময় গ্রামে যাওয়া ছেড়েই দেন তারা। আস্তে আস্তে গ্রামগুলো হতে থাকে জনশূন্য।
ইতিমধ্যেই স্থানীয়রা সুন্দর ওই গ্রামগুলোকে জীবন দিতে উদ্যোগ নিয়েছে এমনকি সহায়তা করছেন সরকার নিজেও। পূর্বের প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনতে বিক্রি হচ্ছে স্পেনের ওই গ্রামগুলো। স্পেনের গালিসিয়া, কাসতিলা লিও, অ্যারাগন ও আসতুরিয়াস অঞ্চলে অবস্থিত সেই গ্রামগুলো।
এ গ্রামগুলো কিনতে পারবে যেকোনো দেশের নাগরিক। একই সাথে ক্রেতা পাবে স্পেনের নাগরিকত্বও। ইতিমধ্যে অনেকে অবকাশ জীবন কাটানোর জন্য, আবার অনেকে পর্যটন ব্যবসার জন্য কিনছে গ্রামের বাড়িগুলো। আগ্রহী ক্রেতাদের মধ্যে অধিকাংশই আরবের ও রুশ বিনিয়োগকারী। পরিত্যক্ত গ্রামগুলোর বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের একটি আলদেয়াস অ্যাবানদোনাদাস। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ সালে বিক্রি করেছে প্রায় ৪০টি গ্রাম। ক্রেতাদের ৯০ শতাংশই বিদেশি।