আধুনিক সমাজে দ্বিন প্রচারে করণীয় ও বর্জনীয়

বিগত এক দশক আগেকার সঙ্গে তুলনা করলেও সমাজ ও সামাজিক পরিবেশের পার্থক্য সহজেই বোঝা যায়। পরিবর্তিত নতুন সমাজব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের কর্মকৌশল বদলে নিচ্ছে সব সামাজিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো। সুতরাং দ্বিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও দ্বিনি কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদেরও প্রয়োজন নতুন কর্মনীতি ও কর্মকৌশল নির্ধারণ করা। কেননা মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘আপনি আপনার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করুন প্রজ্ঞা ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সঙ্গে বিতর্ক করুন উত্তম পন্থায়।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ১২৫)

 

দ্বিন প্রচারে করণীয় ও বর্জনীয়

আধুনিক এই সময়ে যারা দ্বিন প্রচারে নিজেদের নিয়োজিত করতে চায় তারা নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অনুসরণ করতে পারে।

১. দ্বিন বুঝুন সালাফদের পদ্ধতিতে : সালাফ মানে সাহাবি, তাবেয়ি, মুজতাহিদ ইমামরা। এতটুকু খুব নিরাপদ। পরবর্তীদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সালাফদের সঙ্গে মেলাতে হয়। কোরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যা, আকিদা-বিশ্বাস, ফিকহ সব ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। আখিরুজ জামান বা কিয়ামতের পূর্বে পৃথিবীর অবস্থা বিষয়ক আলোচনায় সাহাবি-তাবেয়িদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা আরো নিরাপদ।

২. সামষ্টিক অর্থ গ্রহণ করুন : কোরআন-সুন্নাহের বিভিন্নমুখী ভাষ্য আছে। একই প্রসঙ্গে কয়েকটি বাহ্যত পরস্পরবিরোধী ভাষ্য পাওয়া যায়। কোনো একটি ভাষ্যের প্রতি ঢলে পড়লে সঠিক সিদ্ধান্তে না-ও পৌঁছাতে পারেন। এ কারণে মুজতাহিদ ইমামরা দ্বিনের সামষ্টিক উপলব্ধির ভিত্তিতে সমাধানে পৌঁছাতেন। বিপরীতে জাহেরি বা বাহ্যিক অর্থগ্রহণকারীরা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। নতুন জাহেরিদেরও সর্বজনীনতা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

৩. মধ্যপন্থী হোন : সর্ব ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী হোন। আকিদার মৌলিক ইস্যুগুলো গ্রহণ করে নিন। আল্লাহর একত্ববাদ, রিসালাত, পরকাল, ফেরেশতা, আল্লাহর কিতাব ও পুনরুত্থান মেনে নিন। এগুলোর শাখা-প্রশাখা বিষয়ক মূল আলোচনাগুলো জেনে নিন। আধুনিক অনেক উপশাখা আছে, সেসব অলিগলি উচ্চমার্গীয়দের জন্য তুলে রাখুন। ফরজ ও সুন্নাহ অপরিহার্যভাবে আঁকড়ে ধরুন। নফল ও মুস্তাহাবগুলোর ব্যাপারে তর্ক এড়িয়ে যথাসম্ভব বেশি বেশি নিজে আমল করুন। সাহাবিদের আমলের বৈচিত্র্য দেখে সবাইকে এক কাতারে আনার চেষ্টা বাদ দিন।

৪. আলিমদের সাহচর্য নিন : ইলম হচ্ছে আল্লাহর এমন দান, যা পৃথিবীতে আসতে নবুয়তের প্রয়োজন হয়েছে। আলিমরা নববী ইলমের উত্তরাধিকারী। ইলমের জন্য প্রতিটি যুগে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সুহবতের প্রয়োজন হয়েছে। নবুয়তের পরিসমাপ্তির পর ইলম ইস্তিম্বাত বা গবেষণা ও উদ্ভাবননির্ভর হওয়ায় সুহবত-সান্নিধ্যের প্রশিক্ষণ ছাড়া বিশুদ্ধ হওয়া সম্ভব নয়। শায়খের অনুমোদনের পর অন্যকে তালিম দিন। আলিমের সাহচর্য ছাড়া জ্ঞানের বিশাল সৌধ অর্জন সম্ভব নয়, তবে তার সূক্ষ্ম কোনো ছেদ দিয়ে এমন দূষিত প্রস্রবণ বয়ে আসতে পারে, যার ব্যবস্থাপত্র অসম্ভব। একাধিক শায়খের ইলম থেকে উপকৃত হোন। বিচার-বিশ্লেষণহীন গ্রহণ এড়িয়ে চলুন। কাউকে সব বিষয়ে মাপকাঠি মনে করা সঠিক নয়, তেমনি ভুল নিয়ে মাতামাতিতে লিপ্ত হওয়া গর্হিত।

৫. ব্যাপক অধ্যয়ন করুন : ব্যাপক অধ্যয়ন মানে বিভিন্ন শাখায় জ্ঞান অর্জনে সচেষ্ট হওয়া। ধর্মতত্ত্বের পাশাপাশি বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, কলার বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার জ্ঞান-গবেষণা জানা। শুধু ধর্মতত্ত্ব দিয়ে অর্থনীতির জটিল সব সমাধান কিংবা রাষ্ট্রের নিয়ম-নীতির ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রচেষ্টায় ভুল হতে পারে। ইসলাম যে পরিপূর্ণ দ্বিন তা জ্ঞানের সব শাখার জ্ঞান প্রয়োগের মাধ্যমে। আল্লাহ তাআলা মানুষকে এসব জ্ঞান দিয়েছেন, যা মানুষ চিন্তা-গবেষণার মাধ্যমে অর্জন করেছে।

৬. মৌলিক সমস্যা সমাধানে বাস্তব পদক্ষেপ নিন : দাওয়াত ও কর্মনীতিতে জনগণের আর্থ-সামাজিক ও সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের মৌলিক ইস্যুগুলোতে বাস্তব সমস্যা ও সমাধানে অংশগ্রহণ করুন। কোরআন-হাদিসে লাখ লাখ প্রসঙ্গ আছে। সেসব থেকে সমকালীন সমাধানে বাস্তব পদক্ষেপ ব্যাখ্যা করুন। গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পকে গুরুত্বহীন কিংবা অপেক্ষাকৃত অপ্রয়োজনীয় ইস্যুকে বিশেষায়িত করা থেকে বিরত থাকুন।

৭. অজ্ঞাত বিষয়ে সুনির্দিষ্টকরণ ছেড়ে দিন : দ্বিনের বহু বিষয় আছে, আছে ইসারাত তথা শুধু ইংগিতপূর্ণ এবং বহু কিছু কিনায়াত তথা অস্পষ্ট আছে। এসবের সঙ্গে আহকামসংশ্লিষ্ট কিছু থাকলে এরই মধ্যে ইমামরা তা বিশ্লেষণ করছেন। আর এমন কিছু ছেড়ে দিয়েছেন, যা নবীজি (সা.) এবং সাহাবিরা ছেড়ে রেখেছেন। নবীজি (সা.) যতটুকু বলেছেন, ততটুকু বলুন। আল্লাহ তাআলা যা ঢেকে রেখেছেন, তা তিনি প্রকাশ না করা পর্যন্ত অনাবৃত থাকবে।

৮. একপেশে নীতি ত্যাগ করুন : কিছু ঘটুক তার জন্য শুধু একটি কারণ চিহ্নিত করা একপেশে নীতির ফল। পৃথিবীর কোনো ঘটনা শুধু একটি কারণে ঘটে না। কোনো ঘটনার একাধিক কারণ থাকতে পারে। কোনো ঘটনার একাধিক সমাধান থাকে। একমাত্র কারণ আর একমাত্র সমাধান সংকীর্ণ চিন্তাপ্রসূত। সংকীর্ণ চিন্তা অনেক সময় পশ্চাৎপদ জনসমষ্টির চিত্তকে তুষ্ট করতে সফল হয়। তবে আখেরে তা তাদের ব্যাপক হতাশা ও পিছিয়ে দেওয়ার কারণ হয়ে ওঠে।

৯. বিষয়ভিত্তিক ও সবিস্তারে বলুন : দ্বিনের কোনো বিষয়ে বলার সময় পরিকল্পিতভাবে সাজিয়ে উপস্থাপন করুন। একটি ইস্যুর বিস্তৃত ব্যাখ্যায় সীমাবদ্ধ থাকুন। কিয়ামতের ছোট আলামতগুলোর প্রতি গুরুত্ব দিন। এগুলো উম্মাহর সংশোধনে উপকারী। বড় আলামতগুলো তাসবিহের দানার মতো ঘটবে। সেগুলোর জন্য অপেক্ষা নয়; বরং জনজীবনে ইসলামের বিধান প্রায়োগিক রাখতে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপগুলোর সঙ্গে থাকুন।

১০. ঈমান ও আমলের দাওয়াত দিন : নিঃসন্দেহে দাঈ বা দ্বিন প্রচারককে একজন অভিজ্ঞ লোক হতে হয়। তবে একটি আয়াত জানা থাকলে তারও দাওয়াত দেওয়া যায়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে দাঈ সর্ব বিষয়ে পারদর্শীর মতো আচরণ করবেন না; বরং এখনকার সময়ে কারো সর্বজ্ঞ মনে করা বোকামি। কোরআন সর্বত্র ঈমান ও আমলের কথা বলেছে। মানুষকে ঈমান ও আমলপূর্ণ রাখার বিষয়ে দাওয়াত দেওয়া অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আল্লাহ তাআলা সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।