আনোয়ার হোসেন :
প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ উপহার বৃক্ষ। বৃক্ষ ছাড়া প্রাণিকুলের জীবন-জীবিকার কোনো উপায় নেই। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী বৃক্ষের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভশীল। বৃক্ষ পরিবেশ ও প্রকৃতির পরম বন্ধু। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্বাহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বৃক্ষ৷
লক্ষ্মীপুরের ১৪নং মান্দারী ইউনিয়নের বাসিন্দা লিয়াকত আলী মাস্টার৷ পেশায় বেগমগঞ্জের দুর্গাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষাক৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডাকে সাড়া দিয়ে বৃক্ষরোপণ শুরু করেন লিয়াকত আলী৷ বৃক্ষরোপণ করতে গিয়ে তিনি নির্বাচন করেন, পরিবেশবান্ধব এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ বজ্রপাত থেকে রক্ষাকারী পরম বন্ধু তালগাছ। জানা যায়, লিয়াকত আলী মাস্টার ২০১৯ সাল থেকে ১৪নং মান্দারী ইউনিয়নের বিভিন্ন সড়কের পাশে স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় প্রায় ১ হাজার তালের আঁটি রোপন করেন৷ যা বর্তমানে এক বছর বয়সী তালগাছে পরিণত হয়েছে৷
আগামীদিনে ঘন সবুজে আবৃত বিস্তীর্ণ মেঠোপথের দু’পাশে মাথা উঁচু করে থাকবে এ তালগাছগুলো; যা আমাদের উপকূল ও গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি। এমন সুন্দর ও নৈসর্গিক দৃশ্য এখন খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। এ কারণে বজ্রপাতের (বিদ্যুৎস্পর্শ) হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না মানুষ, পশু-পাখিসহ জীববৈচিত্র্য। বজ্রপাতে ২০১০-২০১৯ এক দশকে ২,৫৭১ জন মানুষ প্রাণ হারায়। প্রতি বছর গড়ে এর সংখ্যা ২৫০ এর বেশি। সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে ২০১৮ সালে ৩৫৯ জন। ২০১৬ সালে আশঙ্কাজনক ভাবে মৃত্যুহার বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার ২০১৬ সালের ১৭ মে বাংলাদেশের জাতীয় দুর্যোগের তালিকায় বজ্রপাতকে অন্তর্ভুক্ত করে। এটিকে দেশের জন্য নতুন দূর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
চলতি বছর (২০২০) প্রথম ছয় মাসেই সারাদেশে বজ্রাঘাতে প্রাণ হারায় ১৯১ জন। দেশে প্রতি বছর বজ্রপাতে মৃত্যুর ৯৩ শতাংশ ঘটে থাকে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীতে; তার প্রায় ৮৪ শতাংশই পুরুষ। আবার মোট মৃত্যুর প্রায় ৮৬ শতাংশ ঘটছে উন্মুক্ত স্থানে অবস্থানের কারণে যার মূল শিকার কৃষক, জেলে ও শ্রমিক শ্রেণির মানুষ। সাধারণত একটি তালগাছ ৯০ থেকে ১০০ ফুট উঁচু হয়। উঁচু গাছ হওয়ায় বজ্রপাত সরাসরি এ গাছের মাধ্যমে মাটিতে গিয়ে আমাদের রক্ষা করে। এ ছাড়াও ভূমিক্ষয়, ভূমিধস, ভূগর্ভস্থ পানির মজুদ বৃদ্ধি ও মাটির উর্বরতা রক্ষা করে। তালগাছের আকর্ষণে বাড়ে মেঘের ঘনঘটা; ঘটে বৃষ্টিপাতও। তালগাছের শিকড় মাটির অনেক নিচ পর্যন্ত প্রবেশ করায় ঝড়ে হেলে পড়ে না কিংবা ভেঙে পড়ে না। যেখানে কোনোকিছু চাষ হয় না সেখানেও তালগাছ তার শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে যায়। নতুন রাস্তার ল্যান্ডস্কেপ, বাঁধ ও নদীভাঙন ঠেকাতে এর রয়েছে সফল প্রয়োগ।
মান্দারী আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান লিয়াকত আলী মাস্টারের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, অর্থনৈতিক সুবিধার পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়, ঝড়ো হাওয়া ও জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলীয় বাড়িঘর, শস্য রক্ষা করতে পরিবেশ উন্নয়নে তালগাছের ভূমিকা অনন্য। তাল এক পরম পরোপকারী বৃক্ষ। বজ্রপাত থেকে জীবন রক্ষায় উঁচু তালগাছের বিকল্প নেই। বেশি করে তালগাছ লাগাই, বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাই।
তিনি আরও বলেন, আমাদের সকলের উচিত লিয়াকত আলী মাস্টারকে সহযোগিতা করা৷ তালের আঁটি রোপন-ই শেষ কাজ নয় সঠিক পরিচর্চার অভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে পরিবেশবান্ধব এ উদ্যোগ৷
লিয়াকত আলী মাস্টার জানান, আইয়ুব আলী মেম্বার স্মৃতি পাঠাগারের সহযোগিতায় এ পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার সড়কের পাশে ৩ হাজারের মতো তালগাছ ও অন্যান্য গাছ লাগিয়েছেন৷ বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, আইলা, সিডর, নার্গিস, আম্ফান মোকাবেলায় তালগাছ মাথা উঁচু করে বুক পেতে দেবে মানব আর মানব বসতি রক্ষায়। শুধু এতেই শেষ না; পাখিদের নিরাপদ আবাস গড়বে তালগাছের নিবিড় বনায়ন। পরিকল্পনা করে ঝুঁকিবিহীনভাবে তালগাছভিত্তিক কার্যক্রম হাতে নেওয়া উচিত। গ্রামীণ অর্থনীতি ও পরিবেশ উন্নয়নে তালগাছ হবে আগামী দিনের কৃষি, কৃষক ও পরিবেশের পরম বান্ধব। তাঁর এই উদ্যোগকে সহযোগিতা করতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি৷