বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সরকার বাস, ট্রেন ও লঞ্চে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচলের নির্দেশ দিয়েছে। এর বিপরীতে বাসে ও লঞ্চে বাড়ানো হয়েছে ভাড়া। তবে বাড়ানো হয়নি সরকারি বাহন ট্রেনে। মানতে বলা হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি। এদিকে ট্রেন ও দূরপাল্লার বাসে স্বাস্থ্যবিধি মানা হলেও লোকাল বাসে তা রীতিমতো উপেক্ষিত। পাশাপাশি যাত্রীদের মাস্ক পরা কিংবা স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে এখনো ঢিলেঢালা ভাব। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অনেক যাত্রীর মধ্যে এখনো রয়েছে সচেতনতার অভাব। আবার অনেকে ট্রেন, বাস ও লঞ্চে উঠার পরই খুলে ফেলে মাস্ক। এদিকে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের কারণে বন্ধ থাকার পর দেশের সব নদীবন্দর থেকে যাত্রীবাহী নৌযান চলাচলের শুরু হয়েছে। গত শুক্রবার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর লঞ্চ চলাচল শুরু হয়।
ট্রেন
সাত সপ্তাহ বন্ধ থাকার পর গত সোমবার থেকে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে সারা দেশে ২৮ জোড়া আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। পাশাপাশি চলছে কমিউটার ট্রেন। আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট বিক্রি হচ্ছে অনলাইনে। তবে কমিউটার ট্রেনের টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে স্টেশন কাউন্টার থেকে। বর্তমানে কমলাপুর স্টেশন থেকে চলাচল করছে ১৯ জোড়া আন্তঃনগর ট্রেন ও চার জোড়া কমিউটার ট্রেন। কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে খুব সতর্কতার সঙ্গে যাত্রীদের ট্রেনে তোলা হচ্ছে। স্টেশনে মেডিক্যাল টিমসহ রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কাজ করছেন।
কমলাপুর রেল স্টেশনের ম্যানেজার মাসুদ সারোয়ার বলেন, ট্রেন চালুর প্রথম চার দিন যাত্রীসংখ্যা কম ছিল। কিন্তু শুক্রবার থেকে বাড়তে শুরু করেছে। অনলাইনে আন্তঃনগর ট্রেনের অর্ধেক টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, টিকিট ছাড়া কাউকেই স্টেশনে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। স্টেশনে প্রবেশের আগে যাত্রীদের শরীরের তাপমাত্রা মাপা হচ্ছে। আর ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার আগে প্রতিটি বগিতে জীবাণুনাশক স্প্রে করা হচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমানে এ স্টেশন থেকে ১৯ জোড়া আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করছে। পাশাপাশি চলছে কয়েকটি কমিউটার ট্রেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রথম তিন দিন ঢাকা থেকে গন্তব্যে যাওয়া এবং ঢাকার বাইরে থেকে ঢাকায় আসা যাত্রীর সংখ্যা কমছিল। তবে গতকাল থেকে এ সংখ্যা প্রায় সমান সমান।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে রেলের এ কর্মকর্তা বলেন, ট্রেনে ওঠা পর্যন্ত যাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য সব ধরনের চেষ্টা আমাদের রয়েছে। কিন্তু ট্রেনে ওঠার পর অনেক যাত্রী মাস্ক খুলে ফেলেন। এটাতো আমাদের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা কোনোভাবেই সম্ভব না। তিনি বলেন, প্রশ্ন করা হলে যাত্রীরা এক্ষেত্রে বিভিন্ন অজুহাত দেখানোর চেষ্টা করেন।
স্টেশনের নিরাপত্তা কর্মকর্তা (আরএনবি) নুর মোহাম্মদ কাজল বলেন, যেসব যাত্রীর মাস্ক নেই তাদেরকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। পাশাপাশি যাত্রীদেরকে ট্রেনে ওঠার আগে হাত ধোয়ার বিষয়টি মনিটরিং করা হচ্ছে। তবে তিনি বলেন, যাত্রীরা সচেতন না হলে কোনোভাবেই শতভাগ মাস্ক পরানো সম্ভব না।
উল্লেখ্য, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকাতে গত ৫ এপ্রিল থেকে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, রেলওয়ের ৩৬২টি ট্রেনের মধ্যে স্বাভাবিক সময়ে ১০২টি আন্তঃনগর ট্রেন এবং ২৬০টি লোকাল, কমিউটার ট্রেন ও মালবাহী ট্রেন চলাচল করে।
বাস
এদিকে রাজধানীর সায়েদাবাদ ঘুরে দেখা যায়, রাজধানী থেকে ছেড়ে যাওয়া দূরপাল্লার বাসে ৬০ শতাংশ বাড়তি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। সকালে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফেনী, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, সিলেটসহ বিভিন্ন জেলার উদ্দেশ্যে বাস ছেড়ে যায়। তবে যাত্রী ছিল কম ও অনেকক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। হানিফ পরিবহনের সায়েদাবাদ কাউন্টারের ম্যানেজার আবুল কাশেম বলেন, যাত্রী কম। মানুষ বাড়তি ভাড়া দিতে চাচ্ছে না। তবে অনেক যাত্রীর মুখেই মাস্ক দেখা যায়নি। এ ব্যাপারে তিশা পরিবহনের যাত্রী রোকসানা বলেন, মাস্ক পরে ছিলাম। মাথাব্যথা করছে, তাই খুলে রেখেছি।
এদিকে রাজধানীর গণপরিবহনে একেবারেই স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবহনের একজন শীর্ষ নেতা বলেন, সরকারি বিধিনিষেধ ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমরা গণপরিবহন চালানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু সকালে ও বিকালে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাত্রী পরিবহন অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকালে বেশির ভাগ মানুষ অফিসে যান। এ সময় সবাই তাড়াহুড়ো করে গাড়িতে উঠতে চান। ঐ পরিবহন নেতা আরো বলেন, একটা গাড়িতে একজন ড্রাইভার, একজন হেলপার ও টিকিট কালেক্টর থাকেন। অনক সময় যাত্রীরা ধাক্কা দিয়ে গাড়িতে উঠে যান। তারা এত যাত্রী সামাল দিতে পারেন না। এই সমস্যা শুধু বাসে নয়, সবখানেই আছে। তিনি বলেন, আমরা তো যাত্রীদের গাড়ি থেকে জোর করে নামিয়ে দিতে পারি না। তবে আমরা শ্রমিকদের বলেছি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে গাড়ি চালানোর জন্য।
বাংলাদেশ বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও শ্যামলী পরিবহনের মালিক রমেশ চন্দ্র ঘোষ বলেন, দূরপাল্লার বাসে শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মেনেই যাত্রী বহন করা হচ্ছে। যেসব যাত্রীর মাস্ক নেই, তাদেরকে আমরা মাস্ক সরবরাহ করছি। তবে লোকাল বাসে কোনোভাবেই স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
নৌযান চলাচল শুরু
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের কারণে বন্ধ থাকার পর দেশের সব নদীবন্দর থেকে যাত্রীবাহী নৌযান চলাচলের শুরু হয়েছে। শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর লঞ্চ চলাচল শুরু হয়। এর আগে বৃহস্পতিবার নদীতে দুই ইঞ্জিনের লঞ্চ চলাচলের অনুমতি দেয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। অন্যসব নৌযান চলাচলেরও অনুমতি মিলল। বিষয়টি নিশ্চিত করে ঢাকা নদীবন্দরের নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম পরিচালক জয়নাল আবেদীন বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় নৌ-চলাচল শুরু হয়েছে। সকাল সাড়ে ৯টার পর দেশের অভ্যন্তরীণ সব রুটে লঞ্চ চলাচল শুরু করে।
বিআইডব্লিউটিএর সদরঘাট টার্মিনালের পরিদর্শক (টিআই) দিনেশ কুমার সাহা বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনেই লঞ্চে যাত্রী তোলা হচ্ছে। এ ব্যাপারে যাত্রীদের সচেতন করার জন্য মাইকিং করা হচ্ছে। কিন্তু লঞ্চে ওঠার পর অনেকেই মাস্ক খুলে ফেলেন। এটা দেখার দায়িত্ব লঞ্চ কর্তৃপক্ষের। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যত কঠোরতা দেখানো হোক না কেন, অধিকাংশ যাত্রী দীর্ঘক্ষণ মাস্ক পরতে চান না।