ফাঁসির মঞ্চে কলম

কেমন সাংবাদিকতা ? যে সাংবাদিকতায় দু’বেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে পারেনা ! পড়াশুনা করে চাকরি করতে পারবি না; কি করতে পারবি তুই ? তোর এ বাড়িতে আর জায়গা নেই ! যেদিন ভালো একটা চাকরি করতে পারবি সেই দিন বাড়িতে আসবি; এর আগে যেন বাড়ির আশে-পাশেও না দেখি তোকে।

মনজু’কে তার ‘মা’ এভাবে বকা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। মনজু সৈয়দপুর গ্রামের কৃষক গিয়াস উদ্দিনের একমাত্র ছেলে। দারিদ্রতাকে বুকে নিয়ে মনজু’র বেড়ে উঠা কিন্তু স্বপ্ন তার আকাশচুম্বী। দেশ-বিদেশে সবাই তাকে এক নামে চিনবে, দেশ ও মানুষের মঙ্গলের জন্য নিজকে উৎসর্গ করবে। গরিব ও অসহায় মানুষের সেবায় রাখবে নিজকে, এমনি সব স্বপ্নগুলিকে লালন করছে মনজু।

২০১৩ সনে দাখিল পাশ করার পরে মা-বাবা’র ইচ্ছায় ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্নে লক্ষ্মীপুর পলিটেকনিক ইনিষ্টিটিউট-এ ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে (ইলেক্ট্রনিক্স বিভাগে) ভর্তি হয় মনজু। তার পড়াশুনার সাথে সমানভাবে চলতে থাকে লেখালেখিও। কেননা তার ভালোলাগা ও ভালোবাসার মধ্যে ছিল ছবি তোলা এবং লেখালেখি করা। কিন্তু কেউ তার এই প্রতিভা উপলদ্ধি করে নাই।

 

একদিন লক্ষ্মীপুর থেকে বাড়ি যাওয়া উদ্দেশ্যে মনজু আনন্দ বাসে উঠলো; বাস হঠাৎ করে ব্রেক করার সাথে-সাথে মনজু মধ্যবয়সী একব্যক্তির উপর পড়লো ! এরপরে মনজু বললো, আমি দুঃখিত ! মধ্যবয়সী লোকটি বললেন, কোন সমস্যা নেই, তুমি তো ইচ্ছেকৃত গায়ে পড়নাই – গাড়ী ব্রেক করাতে পড়েছ; বসো এখানে।
এর পরে তিনি জানতে চাইলেন মনজু কি করে ?
মনজু বললো, আমি ছাত্র; কলেজ থেকে বাড়ি যাচ্ছি।
আপনি কি করেন, কোথায় যাচ্ছেন ?
তিনি বললেন, আমি একটি পত্রিকায় কাজ করি; এখন চন্দ্রগঞ্জ যাবো।
মনজু : আপনি সাংবাদিক ?
লোকটি বললেন : হুম।
মনজু : আপনার নাম কি ?
তিনি বললেন, কবির আহমদ ফারুক।
মনজু : ভালোই হলো, আপনার সাথে পরিচিত হয়ে। আমি লেখালেখি এবং ছবি তুলতে খুব পছন্দ করি। আপনি যদি আমাকে একটু সহযোগিতা করেন তবে আমার স্বপ্ন পূরণে কিছুটা হলেও এগিয়ে যেতে পারতাম।
কবির আহমদ ফারুক : যদি তোমার মাঝে সততা, চেষ্টা এবং পরিশ্রম থাকে তবে আমি তোমার নামে পত্রিকায় লেখা আসবে এই পথ দেখিয়ে দিতে পারবো।
মনজু : সততা, চেষ্টা এবং পরিশ্রম দিয়ে আমি চেষ্টা করবো; আপনি শুধু আমার পাশে থেকে আমাকে পরামর্শ দিলেই হবে। কথা বলতে-বলতে স্টেশন চলে আসলে মনজু বাস থেকে নেমে যায়।

একই দিন সন্ধায় কবির আহমদ ফারুক মনজু’কে ফোন করে চন্দ্রগঞ্জ আসার জন্য বলে। মনজু দু’দিন পরে চন্দ্রগঞ্জ এসে দেখা করে; প্রথমে (মনজু) বললো আচ্ছা আমি আপনাকে কি বলে কথা বলবো ? তিনি একটি মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, ভাইয়া বলতে পারো। এখানে কেউ শিক্ষক বা ছাত্র নয়, সবাই সমান। আমি যদি আমার কর্মের মাধ্যমে তোমার মন জয় করতে পারি, তাহলে তুমি নিজ থেকে আমাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করবে।

আমি জোর করে সম্মান নিতে চাইনা এ বলে তিনি আবারও বললেন, আমাকে তোমার বন্ধুর মতো দেখতে পারো। তাহলে তুমি আমাকে তোমার যে কোন সমস্যার কথাগুলো বলতে সহজ হবে। এরপর থেকে মনজু এবং কবির আহমদ ফারুক মাঝে নতুন এক বন্ধুত্বের সম্পর্কের সূচনা হয়। শুরু হয় মনজু’র নতুন এক পথচলা, যে পথের সামনে কি আছে তা অজানা। কিন্তু সে এই অজানা পথ চলবে বলেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিছু দিনের মধ্যে সাংবাদিকতার অল্প কিছু বিষয়ে জানতে শুরু করলো আর তাতেই মনজু বুঝতে পারলো এ পথ সহজ নয় !

তার প্রথম সংবাদ ছিল ‘পরিবেশ ও সাধারণ মানুষের জীবন রক্ষা প্রসঙ্গে’ এক শ্রেণির কিছু ব্যবসায়ী নিজেকে সম্পদশালী করতে গিয়ে দেশের পরিবেশ ও মানুষের জীবনকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয় তুলে ধরে সংবাদ করা হয় ‘দৈনিক ডাক প্রতিদিন’ পত্রিকায়। কিন্তু এই সংবাদ তৈরী করার পিছনে ফারুক ভাইয়ের সহযোগিতা ছিল অনেক।

এভাবে একেরপর এক সংবাদ লেখা ও সমাজের সাথে মিশতে থাকে মনজু এবং আবিষ্কার করতে থাকে নিজেকে। সমাজ ও দেশের, ভালো-মন্ধসহ অনেক বিষয়ে বুঝতে থাকে। দিন যত যাচ্ছে তত এই পেশার প্রতি মনজু’র আগ্রহ নেশায় রূপ নিচ্ছে। সে যেন সবকিছু ছেড়ে দিতে পারেবে কিন্তু লেখালেখি ছাড়তে হলে মনে হয় সে আর বাঁচবেনা।

এদিকে তার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশুনা শেষ এখন করতে হবে চাকরি ! তবে সাংবাদিকতার কি হবে ? যে ছেলেটি একটি প্রেমও করে নাই যদি তার সাংবাদিকতার উপর কোন প্রভাব পড়ে সেই ভয়ে; আজ তাকে সাংবাদিকতা ছেড়ে চলে যেতে হবে কেমন করে ! এমন চিন্তায় মনজু অসুস্থ হয়ে গেল।

কি করবে কিছু বুঝে উঠতে পারছেনা। শেষ পর্যন্ত কর্মের খোঁজে ঢাকায় যেতে হয় মনজু’কে। শুরু হলো, যন্ত্রের সাথে পথচলা কিন্তু এই পথচলা ছিল কয়েক মাসের জন্য। এরপর আবার ফিরে এলো ভালোবাসার সাংবাদিকতায়। মনজু’র এমন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারে নাই তার মা-বাবা। তাই প্রিয় বসত ঘরটিতেও আজ সে ঘুমাতে পারছেনা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে আসে নিজ জেলা শহর লক্ষ্মীপুরে। শুরু হয় জীবন যুদ্ধ, এ যুদ্ধে মনজু’র প্রতিপক্ষ যেন সারাটা জগত; আর একায় যুদ্ধ করতে হচ্ছে তাকে।

ভালো কোন প্রতিষ্ঠান না পেয়ে স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় কাজ করতে শুরু করে। মাস শেষে বাসা ভাড়ার টাকা থাকে না পকেটে। এমন দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে কাটছে তার দিন-রাত্রি। কিন্তু নিজের প্রতি ছিল অগাধ বিশ্বাস। হয়তো একদিন আসবে আমার সব দুঃখ-কষ্ট মুছে যাবে এবং আমি মা-বাবার মুখে হাসি ফুটাতে পারবো।

কিন্তু নিয়তির এমন কঠিন খেলায় আজ মনজু স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই জীবন বাঁচানো কঠিন হয়ে আসছে। আজ থেমে যাচ্ছে মনজু’র স্বপ্নের লেখক হওয়ার সেই কলমটিও। যে কলমকে বুকে নিয়ে সব দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে থাকতো। তার হাজারও স্বপ্ন এখন উঠে এসেছে ফাঁসির মঞ্চে আর সেই ফাঁসির মঞ্চ হচ্ছে দারিদ্রতার নিষ্ঠুর কষাঘাত।

 

আনোয়ার হোসেন

লেখক পরিচিতি
আনোয়ার হোসেন, লক্ষ্মীপুর জেলার চন্দ্রগঞ্জ থানা এলাকায় সৈয়দপুর গ্রামের কাশেম ভূঁইয়া বাড়ীতে ১ মে ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা – মো. গিয়াস উদ্দিন। মাতা – আমেনা বেগম। শৈশব থেকেই তাঁর লেখালেখি শুরু। বিভিন্ন দৈনিক আঞ্চলিক, সাপ্তাহিক পত্রিকাসহ ম্যাগাজিন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখছেন নিয়মিত।