দাম সহনীয় রাখতে ভোজ্য তেলের ভ্যাট প্রত্যাহার করে নিচ্ছে সরকার। গতকাল বৃহস্পতিবার সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি এবং অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গতকাল রাত পর্যন্ত কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করেনি। রবিবার প্রজ্ঞাপন জারি করা হতে পারে।
প্রজ্ঞাপন জারি হলে আগামী সপ্তাহের শুরুতেই ভ্যাট প্রত্যাহারের প্রভাব বাজারে বোঝা যাবে।
অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘দাম যাতে সহনীয় পর্যায়ে থাকে সে জন্য যেসব পণ্যের ওপর ভ্যাট ছিল, সেগুলো তুলে নিয়েছি। ’ অর্থমন্ত্রী ভার্চুয়ালি সাংবাদিকদের সঙ্গে যুক্ত হন।
কোন কোন পণ্যের শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার হয়েছে—প্রশ্ন করা হলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘ভোজ্য তেল, চিনি, ছোলাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর আরোপিত ভ্যাট ও শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। মূলত রমজান মাসে যেসব পণ্য বেশি প্রয়োজন, সেসব পণ্যের বিষয়ে এই পদক্ষেপ নেওয়া হলো। ’ মন্ত্রী বলেন, সয়াবিনের উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, চিনির দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে আগেই ১০ শতাংশ শুল্ক কমানো হয়েছে। তা ১৫ মার্চ পর্যন্ত বলবৎ আছে। ছোলার আমদানি শুল্ক ছিল না।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে মানুষের কষ্ট হচ্ছে স্বীকার করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের যেসব
পণ্যের নিজস্ব উৎপাদন কম, সেগুলোর জন্য সমস্যায় পড়তে হয়। এসব পণ্য আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানি করে চাহিদা মিটিয়ে থাকি। কিন্তু এখন যুদ্ধ (রাশিয়া-ইউক্রেন) হচ্ছে। এ সময় জিনিসপত্র থাকলেও দাম বেড়ে যায়। পণ্য আনার খরচও বেড়ে যায়। আমদানিকারকরাও সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেন। ’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘টিসিবির কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হয়েছে। বণ্টনব্যবস্থা আরো বাড়াচ্ছি। প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়ে টিসিবি নিয়ে যাব, যাতে কোনো গরিব মানুষ কষ্ট না পায়। ’
মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এক কোটি পরিবারকে টিসিবির আওতায় নিয়ে আসতে যাচ্ছি। সেখানে ভোজ্য তেল থেকে শুরু করে অন্যান্য যে নিত্যপণ্য লাগবে তা ন্যায্য মূল্যে দেব। ’
তেল : অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, সয়াবিন তেলের ক্ষেত্রে উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট মওকুফ করা হয়েছে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ২০ শতাংশ পর্যন্ত ভ্যাট মওকুফ করা হয়েছে। আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে। ভোজ্য তেলে বর্তমানে আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ, উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ এবং বিক্রি পর্যায় ৫ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে।
বর্তমান বাজারে সয়াবিন তেলের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৬৮ টাকা। ভ্যাট প্রত্যাহার করা হলে প্রতি লিটারে তেলের দাম কত কমতে পারে জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) বিশ্বজিত সাহা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কালের কণ্ঠকে বলেন, শুল্কছাড় দেওয়া হলে সয়াবিন লিটারে ৩০ টাকা পর্যন্ত দাম কমতে পারে।
গত সোমবার এফবিসিসিআই ভবনের সম্মেলনকক্ষে ভোজ্য তেল ব্যবসায়ীদের সংগঠন এবং আমদানিকারক প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়সভায় ভোজ্য তেলের বাজারে অস্থিতিশীলতা ঠেকাতে আগামী তিন মাস মূল্য সংযোজন কর (মূসক) প্রত্যাহার করার পরামর্শ করেছিল ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভোজ্য তেলের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করতে এনবিআরকে চিঠিও দিয়েছিল। সরকারের কাছ থেকে গতকাল ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণা এলো।
দেশে ২০২২ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সয়াবিন ও পাম তেল মিলিয়ে ভোজ্য তেল আমদানি হয়েছে তিন লাখ ৮৮ হাজার টন। এটি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৬০ হাজার টন বেশি। সয়াবিন তেল উৎপাদনের কাঁচামাল সয়াবীজও ৩৯ হাজার টন বেশি আমদানি হয়েছে। ফলে আমদানিতে কোনো সংকট নেই।
বাজারে বিক্রি হওয়া প্রতি লিটার ১৬৮ টাকার সয়াবিন তেল থেকে আমদানি পর্যায়ে সরকার শুল্ক ও ভ্যাট বাবদ রাজস্ব পাচ্ছে প্রায় ১৭ টাকা। গত বছর প্রতি লিটার সয়াবিনের দাম যখন ১৩৫ টাকা ছিল, তখন সরকার রাজস্ব পেত ১৫ টাকা। অর্থাৎ আমদানি মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সরকারের রাজস্ব আদায়ও বাড়ছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে সয়াবিন আমদানি থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে ৬৫৯ কোটি টাকা। এখন ভ্যাট কমানোর ফলে সরকার এই রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে।
চিনি : রমজান ঘিরে চিনির দামে লাগাম টানতে সরকার গত সপ্তাহে রেগুলেটরি ডিউটি ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করেছে। যদিও আগে থেকেই সেই শুল্কহার ২০ শতাংশ ছিল। ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এর সময়সীমা ছিল। বাজার ঠিক রাখতে সরকার এই সুবিধা বাড়িয়ে ১৫ মে পর্যন্ত নির্ধারণ করেছে। এর ফলে বাজারে চিনির দর নতুন করে বাড়েনি।
দেশে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে চার লাখ ৮৮ হাজার টন, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় দুই লাখ ৬০ হাজার টন বেশি। অপরিশোধিত চিনির আমদানি মূল্য প্রতি কেজি গড়ে ১১ টাকা বেড়ে প্রায় ৩৯ টাকা দাঁড়িয়েছে। প্রতি কেজিতে শুল্ক-কর দিতে হয়েছে ১৯ টাকা। খুচরা বাজারে এখন চিনির কেজি ৭৮ থেকে ৮০ টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ১০ থেকে ১৩ টাকা বেশি।
খাতুনগঞ্জের আড়তদার জামাল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১০ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহারের পর দাম মণে দেড় শ টাকা কমেছে। আগে দুই হাজার ৭৮০ টাকা চিনির দর থাকলেও এখন আমরা বিক্রি করছি মণপ্রতি দুই হাজার ৬৩০ টাকায়। দাম যা কমার কমে গেছে। চিনি নিয়ে এখন তেমন সমস্যা নেই। সরবরাহও ভালো আছে। রমজান ঘিরেও আর দাম বাড়ার শঙ্কা দেখছি না। ’
ছোলা : ছোলার বাজার এবার স্থিতিশীল। এর প্রধান কারণ, গত বছর অবিক্রীত প্রচুর ছোলা রয়ে গেছে। আর এবার চাহিদার চেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে। এর পরও নতুন করে দাম বাড়ানো এড়াতে ছোলা আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহার করেছে সরকার।
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে বাজারে মণপ্রতি ৩০০ টাকা বাড়লেও তা এখন কমেছে। খাতুনগঞ্জে ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা ভালো মানের প্রতি মণ ছোলা বিক্রি হয়েছে দুই হাজার ২৫০ টাকায়। জানুয়ারির শেষ দিকে একই মানের ছোলা মণপ্রতি দুই হাজার ৪৫০ টাকার বেশি বিক্রি হয়েছিল। এখন মার্চে সেই ছোলা বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ৪০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকায়।
খাতুনগঞ্জে পায়েল ট্রেডার্সের মালিক আশুতোষ মহাজন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অন্য ভোগ্য পণ্য যেভাবে দাম বাড়ছে, এর প্রভাব তো ছোলায় একেবারেই নেই। যুদ্ধের প্রভাবও ছোলার বাজারে নেই। আশা করছি, রমজানেও বাজার এমনই থাকবে। ’
বাজারে প্রভাব
অর্থমন্ত্রী শুল্কছাড়ের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, শুল্কছাড়ের সুফল বাস্তবে কতটা পাবে ভোক্তারা। অতীতে যতবারই শুল্কছাড় দেওয়া হয়েছে, তার সুফল ভোক্তা পেয়েছে খুব সামান্যই। এবারও তার পুনরাবৃত্তি হবে কি না তা জানার জন্য আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, রোজা সামনে রেখে বেশির ভাগ পণ্য এরই মধ্যে বন্দর দিয়ে দেশে চলে এসেছে। শুল্কমুক্ত পণ্য আমদানি করে দেশের বাজারে আসতে সময় লাগবে। ফলে বাজারে এর প্রভাবও পড়বে কিছুটা দেরিতে।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ভোজ্য তেল, চিনি, ছোলার ওপর থেকে সরকারের শুল্ক প্রত্যাহার বাজারের জন্য ইতিবাচক। গতকাল বাজারে তেল সরবরাহ ছিল পর্যাপ্ত। এ ছাড়া ভ্যাট প্রত্যাহার করার ফলে কাল থেকে তেলের বাজার সহনীয় পর্যায়ে আসবে বলে মনে করেন তিনি। তবে বাজারে শুল্ক প্রত্যাহারের প্রভাব পড়তে ১৫ দিনের মতো সময় লাগতে পারে বলে জানান তিনি।
খাতুনগঞ্জে ভোজ্য তেলের বড় ব্যবসায়ী আরএম এন্টারপ্রাইজের পরিচালক সাহেদ উল আলম বলছেন, আরো আগে যদি এই শুল্ক প্রত্যাহার হতো, তাহলে বাজার এত চড়া হতো না। কম দামে তেল আমদানি হয়ে দেশেই মজুদ থাকত। এখন তো আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেল এক হাজার ৮০০ মার্কিন ডলারে কিনতে হচ্ছে। বাজারে দাম আরো কমবে কি না সেটা সামনে বোঝা যাবে।