জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। মনোমুগ্ধকর এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। সবুজ বনভূমির মাঝে লাল ইটের তৈরি ইমারত মনোরম ক্যাম্পাসকে ভিন্ন রূপ দিয়েছে। চমৎকার বনজঙ্গল, ব্যতিক্রমধর্মী সব দালানের নকশা, বিস্তৃত লেক, অসংখ্য পরিযায়ী পাখির আনাগোনা, সন্ধ্যার পর শেয়াল-ঝিঁঝিঁ আর পাখপাখালির সম্মিলিত ঐকতান, জোনাকির মিটিমিটি আলো জ্বলা, জোছনা রাতে মায়াবি রূপ— সব মিলিয়ে এক অনন্য সাধারণ পরিবেশ! এখানে এলে যে কারো মন ভালো হয়ে যায়। জাহাঙ্গীরনগরের অপরূপ সৌন্দর্যের টানে এখনো অনেকে এখানে বেড়াতে যান। ছুটির দিনগুলোতে পুরো ক্যাম্পাস পরিণত হয় মেলায়।
কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ক্রমেই যেন নরককুণ্ডে পরিণত হচ্ছে। ছাত্রীনিপীড়ন ও ধর্ষণের কারণে সংবাদ-শিরোনাম হচ্ছে বার বার। প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যধন্য, শান্ত-স্থিত, লেখাপড়া-গবেষণা-ক্রীড়া-সংস্কৃতির সাধনায় মগ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত হচ্ছে। শিক্ষা, গবেষণা, ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও বিদ্যাচর্চা ছাড়া সব কিছুই এখানে হচ্ছে সুনিপুণভাবে।
সম্প্রতি সেখানে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান তার বহিরাগত বন্ধু মামুনুর রশিদের সহযোগিতায় এক দম্পতিকে ক্যাম্পাসে ডেকে এনে স্বামীকে আবাসিক হলে আটকে রাখেন। পরে মোস্তাফিজুর ও মামুন মিলে স্ত্রীকে ধর্ষণ করেন। এই ঘটনা জানাজানি হবার পর গত তিনিদন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়টি আবারো উত্তাল হয়ে উঠেছে। শিক্ষার্থীরা ধর্ষণ ও ধর্ষকমুক্ত ক্যাম্পাসের জন্য লাগাতার আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। শিক্ষকরাও যোগ দিচ্ছেন আন্দোলনে। এমন আন্দোলন অবশ্য এই বিশ্ববিদ্যলয়ে খুবই পরিচিত একটি বিষয়। ইতিহাসে এমন প্রতিবাদ এর আগেও অনেকবার হয়েছে। সবচেয়ে সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ আন্দোলন হয়েছে ১৯৯৮ সালে, ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জসিমউদদীন মানিকের ‘ধর্ষণের সেঞ্চুরি’র বিরুদ্ধে। বলা হয়ে থাকে মানিক সেই সময় দলীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে একশরও বেশি নারীকে ধর্ষণ করে তা উদযাপন করেছিল। এ জন্য তার নাম হয়েছিল ‘সেঞ্চুরি মানিক’। তীব্র আন্দোলনের মুখে অবশ্য ‘মানিক গ্রুপ’ ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল।
মানিক ক্যাম্পাস ছাড়লেও তার প্রেতাত্মারা ঠিকই রয়ে গিয়েছিল। তাইতো কিছু দিন পর পর জাহাঙ্গীরনগরে ধর্ষণ ও নারী লাঞ্ছনার ঘটে। আর প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে ছাত্রলীগের কোনো না কোনো নেতার নাম উচ্চারিত হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও ধর্ষণ যেন সমার্থক হয়ে গেছে!
গত নয় বছরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও বহিরাগত নারীকে শারীরিক হেনস্তার ১০টিরও বেশি ঘটনা ঘটেছে। যার সব ঘটনায় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এসব ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করলেও অধিকাংশই সময়েই পার পেয়ে যায় অভিযুক্তরা। কারণ তাদের সবাই ছাত্রলীগের নেতা ও কর্মী। অপরাধীদের অভয়স্থল হচ্ছে হলের ভিআইপি রুমগুলো! তারা একেকজন সিঙ্গেল রুম বা একাধিক রুম নিয়ে থাকেন। হলের বিভিন্ন ইস্যুতে তারাই প্রশাসনের সঙ্গে সভা করে, তারাই প্রশাসক হিসাবে ভূমিকা পালন করে!
এটা একটা আজব ব্যবস্থা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কখনোই ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারে না। কারণ তারা ছাত্রলীগের সমর্থন নিয়ে এখন প্রশাসন চালায়। ছাত্রলীগের সমর্থন হারালে তাদের গদি হারানোর ভয় থাকে। আর ছাত্রলীগ প্রথমে দায় অস্বীকার করে। বেশি বিপদে পড়লে অভিযুক্ত এক-দুইজনকে সামায়িক বহিষ্কার করে দায়মুক্তি নেওয়ার চেষ্টা করে। এবারও তার ব্যতিক্রম কিছু হবে বলে মনে হয় না।
সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে এত এত অভিযোগ, তবু এই সংগঠনের নেতাকর্মীদের কোনো অনুশোচনা নেই, কোনো ভাবান্তর নেই। যেন তারা যা করছে, যা করেছে সবই ঠিক করছে। উচিত কাজ করছে। এই সংগঠনটির যারা ‘মা-বাপ’ তারাও নির্বিকার! সন্তানের ‘বীরত্ব’ নিশ্চয়ই তাদের গৌরবান্বিত করছে! তা না হলে তারাও তো কিছু বলতেন, কিছু একটা করতেন!