চার মাসে ২৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি চায় পিডিবি

মাত্র চার মাসে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) লোকসান হয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ অর্থ ভর্তুকি হিসেবে চেয়ে পিডিবির পক্ষে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। গত বছরের জুন থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে বেসরকারি খাতের ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্লান্ট (আইপিপি), রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্র, সরকারি বিভিন্ন কোম্পানি এবং ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করে বিতরণের পর ভর্তুকি বাবদ ২৫ হাজার ২২১ কোটি টাকার চাহিদাপত্র পাঠিয়েছে।

গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ১১ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ রাখা ছিল। এ অর্থ দিয়ে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ ছয় মাস ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব হয়। গত বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসের জন্য চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) বাজেট বরাদ্দ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের লোকসানের ভর্তুকি দেওয়া শুরু না হলেও বরাদ্দ প্রায় শেষ হয়ে গেছে।

অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, বিদ্যুতের ভর্তুকি বাবদ বাজেটে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়। পিডিবি থেকে প্রতি মাসে ভর্তুকির দাবি আসে। বাজেটে যে বরাদ্দ রাখা হয়, তা দিয়ে তাদের চাহিদা মেটে না। তাই পরবর্তী বাজেটের অর্থ দিয়ে আগের বাজেটের চাহিদা মেটাতে হয়। সারা বছরের আয়-ব্যয় প্রাক্কলন করেই বাজেট প্রণীত হয়। কোনো খাতে অতিরিক্ত অর্থ দিলে তখন বাজেট ব্যবস্থাপনায় চাপ বাড়ে।

বাংলাদেশের জন্য ঋণের অন্যতম শর্ত হিসেবে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমিয়ে আনতে বলেছে আইএমএফ। আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে গত ৩০ জানুয়ারি। আইএমএফ মনে করছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশও শর্ত পূরণে সম্মত। এর অংশ হিসেবে গত নভেম্বরে পাইকারি পর্যায়ে ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ায় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। গত জানুয়ারিতে গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি ইউনিটে গড়ে ৫ শতাংশ দাম বাড়িয়েছে সরকার।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম সমকালকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ ও মুনাফা যৌক্তিকীকরণ করা হলে এত ভর্তুকির প্রয়োজন হবে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিডিবির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, তাঁদের পরিচালন ব্যয়ের ক্ষেত্রে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত সাশ্রয় করতে বলা হয়েছে। এ পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হলে ভর্তুকির ওপর চাপ কিছুটা কমবে বলে তাঁরা মনে করেন।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, আইএমএফের শর্ত কার্যকর হবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে। কিন্তু এখন যে ভর্তুকির প্রস্তাব এসেছে, তা শর্তের আওতায় আসবে না। তবে ভর্তুকি বাবদ এত অর্থ চলতি অর্থবছরে দেওয়া সম্ভব হবে না। আগামীতে যেন আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়, এ জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পাশাপাশি এ খাতের অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ করে পিডিবির লোকসান কমিয়ে আনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

বিদ্যুৎ, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), নগদ সহায়তা, খাদ্য, রপ্তানি প্রণোদনা এসব মিলিয়ে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভর্তুকি বাবদ সরকারের বরাদ্দ রয়েছে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। গত কয়েক মাসে পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল ও কেরোসিন; গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ালেও চলতি অর্থবছরে সরকারকে ৪০ হাজার কোটি টাকার বাড়তি ভর্তুকি গুনতে হতে পারে বলে অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।

সরকারি-বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যে জানিয়েছে, সময়মতো ভর্তুকির অর্থ না পাওয়া ও চলমান ডলার সংকটে জ্বালানির অভাবে আগামীতে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে না। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে পর্যাপ্ত পরিমাণ তরল জ্বালানি মজুত রাখা প্রয়োজন। সরকারের আর্থিক সহায়তা সময়মতো না পেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হবে না।

বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) সভাপতি ফয়সাল খান সমকালকে বলেন, প্রয়োজন অনুযায়ী এলসি খোলার ডলার পাওয়া যাচ্ছে না; যা তাঁদের কার্যক্রম পরিচালনায় অন্যতম বাধা।